দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা পরও ধর্ষণ কমছে না৷ বরং আরো বাড়ছে বলে মানবাধিকার কর্মী ও নারী নেত্রীরা মনে করছেন৷ পরিসংখ্যানও তাই বলছে৷
বিজ্ঞাপন
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে৷ ১৩ অক্টোবর গেজেট প্রকাশের পরই সেটা কার্যকরও হয়েছে৷ সংসদ অধিবেশন না থাকায় এটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে করা হয়৷ সংসদেও এখন পাঠানো হচ্ছে৷ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তারপরও ধর্ষকরা কঠোর শাস্তির বিধানে ভীত হচ্ছে না৷
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছে, অক্টোবর মাসেই সারাদেশে ২১৬ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ এরমধ্যে ১০১টি শিশু৷ ২৫টি শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ এছাড়া ১৬ টি শিশুসহ ২৩ জন ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে গত ১০ মাসে এক হাজার ৩৪৯ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৬ জনকে৷ অত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১৩ জন৷ আর ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ২৭১ জন৷ তবে ধর্ষণের ঘটনায় এই সময়ে মামলা হয়েছে ৯৪৮টি৷
কঠোর শাস্তির বিধানের কারণে অপরাধীরা নিবৃত হবে সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই: নূর খান
আসকের হিসাব অনুযায়ী আগস্ট মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৪৮টি, সেপ্টেম্বর মাসে ১৮৬টি৷ আর অক্টোবর মাসে ৩৭৪টি৷ যা আগের মাসের দ্বিগুণ৷মৃত্যুদণ্ডের বিধান হওয়ার পরের ১৫ দিনে ১৫০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে৷
মানবাধিকার কর্মী এবং আসকের সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ‘‘কঠোর শাস্তির বিধানের কারণে অপরাধীরা নিবৃত হবে সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই৷ তারা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে মাসলম্যানদের দৌরাত্ম্য, ক্ষমতার দাপট৷ টাকার জোরে এবং রাজনৈতিক কারণে অনেকেই পার পেয়ে যায়৷ তারাও মনে করে অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে৷ তাই কঠোর শাস্তি তাদের মনে কোনো ভীতির সৃষ্টি করে না৷’’
বাংলাদেশে এখনো গড়ে প্রতিদিন ৪-৫টি ধর্ষণের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে৷ কিন্তু শাস্তির হার মাত্র শতকরা তিন ভাগ৷ এখনো সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োগ হয়নি৷ কারন মৃত্যুদন্ডের বিধান হওয়ার পর কোনো মামলার বিচার হতে কত দিন লাগে তার কোনো নিশ্চয়তা নাই৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে জেলায় জেলায় আলাদা বিশেষ ট্রাইবুন্যাল করা প্রয়োজন৷ তাহলে বিচার দ্রুত গতিতে হবে৷ আর নিম্ন আদালতে বিচার হলেই তো তা কার্যকর হবে না৷ হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে যাবে৷ সেখানে অনেক সময় লাগে৷ কারণ আলাদা কোনো বেঞ্চ নাই৷ এরমধ্যে আসামিরা জামিনে ছাড়া পায় ৷ ফলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়৷’’
ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করে প্রতীকী শাস্তি দেখিয়ে প্রচার করতে হবে: এলিনা খান
তারা প্রশ্ন করেন, হত্যার শাস্তিও তো মৃত্যুদণ্ড৷ আরো অনেক অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ তাই বলে কি সেই সব অপরাধ কমেছে? আসলে আইনের শাসন এবং অপরাধ করে পার না পাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে৷ তা না হলে কোনো কঠোর আইনই অপরাধ কমাতে পারেনা৷ ধর্ষণের ক্ষেত্রেই কঠোর শাস্তি ও অপরাধী পার না পাওয়া দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে৷
নারী নেত্রী এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলে, ‘‘এখন দরকার ব্যাপক গণসচেতনতা৷ দেশের তৃণমূল পর্যন্ত প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে৷ ঢাকায় বসে শুধু কথা বললে হবে না৷ ছোট ছোট ভিডিও তৈরি করে প্রতীকী শাস্তি দেখিয়ে প্রচার করতে হবে৷ অপরাধীদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে হবে৷’’
তার মতে, কঠোর আইন করার পরও ধর্ষণের অপরাধীদের শাস্তি দিতে হলে সাক্ষ্য আইন সংস্কার করতে হবে৷ তদন্ত ব্যবস্থা আরো আধুনিক করতে হবে৷ এমনকি ধর্ষণের বিচারিক প্রক্রিয়াও সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি৷
ধর্ষক কেন, কী ভেবে ধর্ষণ করে?
ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সময় কীভাবে কাজ করে ধর্ষকের মন ও মস্তিষ্ক? এ সম্পর্কে বিভিন্ন বিজ্ঞানী কী বলেছেন তা বিস্তারিত জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Getty Images/China Photos
সব সময় যৌনসুখ মুখ্য নয়
সাইকোলজি অফ ভায়োলেন্স জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেরি হামবির মতে, ‘‘ধর্ষণ যৌনসুখের উদ্দেশ্যে নয়, বরং অপরপক্ষকে দমিয়ে রাখতে ক্ষমতার প্রদর্শন হিসাবে করা হয়৷’’ কিছু ক্ষেত্রে এই ক্ষমতার প্রকাশ শুধু নারীদের বিরুদ্ধে হয়৷ অন্যদিকে, ধর্ষণ কাজ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘জাতে ওঠার’ পন্থা হিসাবে৷ এছাড়া ধর্ষণের পেছনে রয়েছে নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, যা বুঝতে বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন৷
ছবি: Getty Images
কে ধর্ষক?
মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক ড. স্যামুয়েল ডি. স্মিথিম্যান একটি গবেষণার জন্য ৫০জন ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নেন৷ সেখানে তিনি বুঝতে পারেন যে, কয়েকটি নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক বা ভাষা বা ধর্মগোষ্ঠী থেকেই উঠে আসবে ধর্ষকামী চিন্তা, তা নয়৷ ধর্ষক উঠে আসতে পারে যে কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকে৷ পাশাপাশি এক ধর্ষক থেকে আরেক ধর্ষকের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যও লক্ষ্য করেন তিনি৷ ধর্ষণের উদ্দেশ্যও সেখানে থাকে ভিন্ন৷
ছবি: Gina Sanders - Fotolia.com
উদ্দেশ্য ভিন্ন, কিন্তু চারিত্রিক মিল
ড. স্মিথিম্যানের গবেষণা বলছে, প্রতিটি ধর্ষণের উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও বেশির ভাগ ধর্ষকের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়৷ এর মধ্যে রয়েছে নার্সিসিজম বা আত্মমুগ্ধতা, নারীবিদ্বেষ ও অন্যের প্রতি সার্বিক সহানুভূতির অভাব৷ এছাড়া, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ধর্ষকদের মধ্যে নিজের অপরাধের প্রতি ঔদাসীন্য লক্ষ্য করেন৷
ছবি: Getty Images
ধর্ষণ করে ‘জাতে ওঠা’!
গবেষক শেরি হামবি বলেন, ‘‘তরুণরা যৌন অভিজ্ঞতার সাথে সম্মানকে মেলায়৷ এটিকে এক ধরনের জয় হিসাবে দেখে তারা৷ যাদের বেশি যৌন অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা হয়৷’’ এই ‘জাতে উঠতে চাওয়ার’ আকাঙ্খা থেকে ধর্ষণ করাকে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বা ক্ষতিকারক পৌরুষের লক্ষণ হিসাবে দেখেন তিনি৷ ওপরের ছবিতে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক নারী৷
ছবি: AFP/Abaad/P. Baz
ধর্ষণ একটি অপরাধ
শেরি হামবি এবং স্মিথিম্যান মনে করেন, ধর্ষণ কোনো বিশেষ মানসিক রোগ নয়, এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ কোনো কোনো ধর্ষকের মধ্যে বিশেষ কিছু মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা গেলেও এমন কোনো নির্দিষ্ট মানসিক রোগের সন্ধান পাওয়া যায়নি যা ধর্ষণ করতে বাধ্য করে৷
ছবি: Getty Images/China Photos
নানা ধরনের ধর্ষকামী মানসিকতা
ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জয়দীপ সরকার ধর্ষকামী মানসিকতার মোট ছয়টি রূপকে চিহ্নিত করেছেন৷ এর মধ্যে রয়েছে সুযোগসন্ধানী ধর্ষক, স্যাডিস্টিক ধর্ষক, প্রতিহিংসাকামী ধর্ষক, কল্পনাপ্রবণ ধর্ষক, ক্ষমতালোভী ধর্ষক ও ক্ষুব্ধ ধর্ষক৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন ধর্ষকের মধ্যে একাধিক ধর্ষকামী মানসিকতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়, বলে জানাচ্ছে সেই গবেষণা৷
ছবি: picture-alliance/F. May
বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব
ধর্ষকের মনস্তত্ত্বকে বোঝার উপায় কী হবে, এই প্রশ্ন বিভক্ত করেছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার গবেষকদের৷ সমাজতাত্ত্বিক, মনোবিদরা ধর্ষণকে যৌনতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে একে নিছক ক্ষমতার প্রকাশ হিসাবে দেখেন৷ অন্যদিকে, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের গবেষক র্যান্ডি থর্নহিল ও ক্রেগ পামারের মতে, ধর্ষণের মূল উদ্দেশ্য যৌনতাই৷ ওপরের ছবিতে ব্রাজিলের সাওপাওলো শহরে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক নারী৷
ছবি: Imago/ZumaPress
ধর্ষণের যত ‘মিথ’
ধর্ষণ বিষয়ে বেশ কিছু মিথ বা ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত রয়েছে৷ উদাহরণস্বরূপ, অনেক ক্ষেত্রেই একটি মিথ কাজ করে, যেখানে ধর্ষক আশ্বস্ত হয় যে, অপর পক্ষ যতই বারণ করুক বা বাধা দিক না কেন, বাস্তবে তারও এতে সম্মতি রয়েছে৷ মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক আন্টোনিয়া অ্যাবের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এমন মিথে বিশ্বাসী এক ধর্ষকের বয়ান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Klose
গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা
মনস্তত্ত্বের আনাচ-কানাচ নিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে বহু গবেষণা৷ এর একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ধর্ষণকে বুঝতে চাওয়া চেষ্টা৷ বিভিন্ন চিন্তাধারার বা অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন নিজেদের মতো করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে৷ এতে করে গভীরে গিয়ে চিহ্নিত করা যাচ্ছে ধর্ষণের নানা দিক৷ ধর্ষণ রুখতে ও ধর্ষকের মনস্তাত্ত্বিক ঝোঁক চিহ্নিত করতে কাজে লাগানো হচ্ছে এমন গবেষণাকে৷