রাঙামাটির নানিয়ারচরের ছেলে রমেল চাকমার মৃত্যুর পর থেকেই ফেসবুকে চলছে নানাবিধ আলোচনা৷ কেউ সশস্ত্র রমেলের কথিত ছবি প্রকাশ করে দাবি করছেন, তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন৷
বিজ্ঞাপন
কারো চোখে রমেলকে নির্যাতনের প্রতিবাদের অর্থ হচ্ছে দেশপ্রেমি সেনাবাহিনীর নামে কুৎসা রটানোর অপচেষ্টা৷ রমেল চাকমা মারা যান গত ১৯ এপ্রিল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে৷ তার আগে অবশ্য কিছুদিন হাসপাতালে কাটিয়েছেন তিনি৷ অভিযোগ রয়েছে, ৫ এপ্রিল সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ তারপরে কী ঘটেছে তা নিয়ে রয়েছে নানা বক্তব্য৷
এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল বাজারে গিয়েছিলেন কেনাকাটা করতে৷ সেখান থেকেই তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ গণমাধ্যমের বরাতেই জানা যাচ্ছে, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে তাকে৷ অবস্থা এমন যে, রাতের বেলা রমেলকে যখন স্থানীয় থানায় হস্তান্তর করার চেষ্টা করে সেনাসদস্যরা, পুলিশ তখন তাকে গ্রহণ করেনি, কেননা, তার শারীরিক অবস্থা খুবই সঙ্গীন ছিল৷ পরবর্তীতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ আর সেখানে কয়েকদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই তরুণ৷
বাংলাদেশের আদিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাপন
বাংলাদেশে আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে প্রত্যেকের জীবনযাপন ও ধর্মীয় উৎসবে রয়েছে ভিন্নতা৷ ছবিঘরে রয়েছে আদিবাসী বিভিন্ন গোষ্ঠীর জীবনযাপন ও তাদের উপর নির্যাতনের কথা৷ অধিকাংশ ছবি পাঠিয়েছেন সঞ্চয় চাকমা৷
ছবি: Sanchay Chakma
ধান চাষ
চাকমাদের জীবিকা প্রধানত কৃষি কাজ৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের সমতল অংশে স্বাভাবিক সেচ পদ্ধতিতে মৌসুমী কৃষি কাজ, এবং পাহাড়ি অঞ্চলে জুম চাষের মাধ্যমে চাকমা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন খাদ্যশস্য ও রবিশস্য উৎপাদন করে থাকে৷
ছবি: Sanchay Chakma
পুরুষ-নারী সমানে সমান
আদিবাসী নারীরা পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে৷ এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে নারী পুরুষ একসাথে ধানের জমিতে কাজ করছে৷
ছবি: Sanchay Chakma
বাঁশের অঙ্কুর সংগ্রহ
তিন চাকমা নারী বাঁশের অঙ্কুর নিয়ে নৌকায় করে যাচ্ছেন৷
ছবি: Sanchay Chakma
হলুদ সংগ্রহ
এক চাকমা পুরুষ হলুদ সংগ্রহ করে ঝর্ণার পানিতে সেগুলো ধুয়ে নিচ্ছেন৷
ছবি: Sanchay Chakma
স্কুলে যাওয়া
একটি আদিবাসী কিশোরী স্কুলে যাচ্ছে৷
ছবি: Sanchay Chakma
চিংড়ি মাছ সংগ্রহ
দুইটি আদিবাসী বালক-বালিকা ঝিরি (ছোট ঝর্ণা) থেকে চিংড়ি মাছ সংগ্রহ করছে৷
ছবি: Sanchay Chakma
ঐতিহ্যবাহী কম্বল বোনা
এক চাকমা নারী তাদের ঐতিহ্যবাহী কম্বল বুনছেন৷
ছবি: Sanchay Chakma
জাল দিয়ে মাছ ধরা
জাল দিয়ে নদীতে মাছ ধরছেন আদিবাসী নারী-পুরুষ৷
ছবি: Sanchay Chakma
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
বৈসাবি উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনা৷
ছবি: Sanchay Chakma
ধর্ষণের শিকার
২১ আগস্ট ২০১২ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সি এই ত্রিপুরা মেয়েটি খাগড়াছড়িতে এক পুলিশ কনস্টেবলের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল৷ (ছবি: সুমিত চাকমা)
ছবি: Sumit Chakma
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বিক্ষোভ
২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে রাঙামাটিতে পাহাড়িদের উপর জমি নিয়ে বিরোধের জেরে বাঙালিদের হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ৷ (ছবি: পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ)
ছবি: Sumaiya Sayed
ধর্ষণের প্রতিবাদ
২০১২ সালে রাঙামাটির সুজাতা নামে এক ১২ বছরের চাকমা কিশোরীকে ধর্ষণ করে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিল আদিবাসী শিক্ষার্থীরা৷ (ছবি: সুমাইয়া সাঈদ)
ছবি: PCP
কল্পনা চাকমা
১৯৯৬ সালের ১২ জুন কল্পনা চাকমাকে তুলে নিয়ে যায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা৷ তার খোঁজ আজও মেলেনি৷ এই ছবিটি এঁকেছেন প্রজ্ঞান চাকমা৷
ছবি: Pragyan Chakma
চাকমাদের উপর বাঙালিদের হামলা
২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে রাঙামাটির বোগাচারিতে তিনটি আদিবাসী গ্রামে হামলা চালায় বাঙালিরা৷ (ছবি: হিমেল চাকমা)
ছবি: Himel Chakma
৫৭ টি বাড়ি পোড়ানো হয়
চাকমাদের ৫৭টি বাড়ি পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়৷ নিঃস্ব হয়ে যায় অনেক পরিবার৷
ছবি: Himel Chakma
খাসিয়া উচ্ছেদ
২০১৬ সালের জুন মাসে সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের নাহার পুঞ্জিবাসী খাসিয়াদের উচ্ছেদের নোটিশ জারি করে জেলা প্রশাসন৷ (ছবি: খোকন সিং)
ছবি: DW/K. Singha
৭০০ মানুষ বাস্তুহারার আশঙ্কা
উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রাম নাহার-১ পান পুঞ্জির ৭০০ মানুষকে অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়েছে৷ বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার নোটিশ পাওয়া মানুষদের মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধই বেশি৷
ছবি: Khukon Singha
সাঁওতালদের উপর হামলা
২০১৬ সালে ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের সংঘর্ষ থামাতে গুলি চালায় পুলিশ৷ এতে তিন সাঁওতাল নিহত হন, আহত হন অনেকে৷
ছবি: bdnews24.com
জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বিরোধ
সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল৷ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা ওই জমিতে কয়েকশ’ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস করে আসছিল কয়েক বছর ধরে৷ চিনিকল কর্তৃপক্ষ ওই জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে৷
ছবি: DW/K. Singha
19 ছবি1 | 19
রমেলের মৃত্যু নিয়ে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পাওয়া বক্তব্যে সুস্পষ্ট বিভাজন রয়েছে৷ পুলিশ দাবি করেছে, রমেলের নামে কোনো মামলা ছিল না, তারা তাঁকে গ্রেপ্তারও করেনি৷ আর সেনাবাহিনী বলছে, আটকের পরই পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল রমেলকে, যা সঠিক নয় বলেই জানিয়েছে পুলিশ৷ এ রকম পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বেশ কিছু ছবি, সংবাদের লিংক, যেখানে ‘রোমেল চাকমা' নামক এক ব্যক্তিকে অতীতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন কেউ কেউ৷
তাদের একজন ইমরান হোসেন হৃদয় ফেসবুকে সরাসরি লিখেছেন, ‘‘তার (রোমেল) মতো ভয়ানক এক সন্ত্রাসীর মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে পাহাড়ী সন্ত্রাসীগুলো যেভাবে জল ঘোলা করছে, তাতে এদের দেশদ্রোহী আসল চরিত্র উন্মোচিত৷'' নিজের বক্তব্যের পক্ষে অস্ত্রহাতে কয়েক যুবকের একাধিক ছবিও প্রকাশ করেছেন তিনি৷ যার একটি ছবিতে চেহারা মোটামুটি পরিষ্কারভাবে দেখা যায়৷ যদিও ১৯ এপ্রিল মারা যাওয়া রমেল দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছিলেন এবং ডানচোখ তাঁর বোঁজা থাকার ছবি আমরা মূলধারার গণমাধ্যমে দেখেছি, হৃদয়ের শেয়ার করা ছবিতে থাকা ব্যক্তিটি দু'চোখ দিয়েই দিব্যি তাকিয়েছিলেন৷ অন্যান্য ছবিতে চেহারা বোঝার কোনো উপায় নেই৷ আর ছবিগুলো এতই নিম্ন রেজ্যুলেশনের যে সেগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে যাচাই করাও সম্ভব নয়৷
হৃদয়ের মতো আরো অনেকে রমেলকে সন্ত্রাসী প্রমাণে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন৷ একটি পোস্ট অনেকে নিজের নামে শেয়ার করছেন, যেটি হুবহু একই রকম৷ এতে বোঝা যায়, সুনির্দিষ্ট কোনো চক্র সংবাদটি শেয়ার করতে উৎসাহ যোগাচ্ছে৷ সেই পোস্টের সঙ্গে চার বছর আগে পার্বত্য নিউজ নামের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি সংবাদ যোগ করা হয়েছে, যেখানে সেই সময় রোমেল চাকমা নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের খবর রয়েছে৷ সেই খবরে রমেলের বয়স বলা হয়েছে বিশ বছর৷ সেই সংবাদ যদি সত্য ধরা হয় এবং ১৯ এপ্রিল মারা যাওয়া ব্যক্তিটি যদি একই ব্যক্তি হন, তাহলে নিশ্চিতভাবে গত চার বছরে রমেলের বয়স কমে হয়েছে উনিশ বছর!
রমেল ঠিক কাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তদন্তকারীদের৷ পুলিশ যদিও একাধিকবার বলেছে, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না বা তাকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেনি, তা সত্ত্বেও যদি রমেল কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে থাকতেন, তাহলে তাকে কাঠগড়ায় দাড়া করানোর মতো আইন বাংলাদেশে নিশ্চিয়ই আছে৷ তা না করে তাকে এভাবে পিটিয়ে মারার নিন্দা যারা জানিয়েছেন তাদেরকে সাধুবাদ জানাই৷