পর্বতারোহণ অভিযানে যাঁরা যান, তাঁরা জেনেশুনেই যান, প্রতি পদে পদে কী ভয়ানক বিপদ তাঁদের অপেক্ষায় থাকতে পারে৷ কিন্তু সেই বিপদ সত্যিই কতটা ভয়ঙ্কর, তা জানালেন একদল পর্বতারোহী, যাঁরা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন৷
বিজ্ঞাপন
কলকাতার জার্মান কনসুলেট ভবনের বাগানে এক গ্রীষ্মের সকালে ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল৷ সাউথ ক্যালকাটা ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সবাই৷ সেদিন ওঁরা খুব খুশি ছিলেন যে জার্মান কনসুলেটের মধ্যস্থতায় একটি ইন্দো-জার্মান রাসায়নিক সংস্থা ওদের পরবর্তী গঙ্গোত্রী-থ্রি অভিযানে আর্থিক সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে৷ পর্বতারোহী সংস্থাগুলোর জন্য এটা নিঃসন্দেহে সুখবর, কারণ প্রতি বছর পর্বতারোহণের সরঞ্জাম ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসের খরচ এত বেড়ে চলেছে যে সামাল দেওয়া যায় না৷ বিশেষ করে পর্বতারোহণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি স্পোর্টস৷ পাহাড়ে চড়ার বিশেষ ধরনের পোশাক এবং জুতো থেকে শুরু করে ইস্পাতের গাঁইতি, দড়া-দড়ি, তাঁবু, এমনকি বিশেষ ধরনের খাদ্য-পানীয়, যা অতি উচ্চতায় আবশ্যিক, সব কিছুরই অতি চড়া দাম৷
এভারেস্ট জয়ের ষাট বছর
১৯৫৩ সালে এডমান্ড হিলারি এবং শেরপা তেনজিং নোরগে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন৷ মানব জাতির ইতিহাসে তাঁরাই প্রথম পা রাখেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে৷ আর ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহীম৷
ছবি: DIAMIR Erlebnisreisen GmbH
প্রথম জয়, প্রথম মৃত্যু
২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের সর্বোচ্চ শেখরে পা রাখেন মুসা ইব্রাহীম (বামে)৷ সেই জয়ের খবরে আনন্দের বন্যা নামে বাংলাদেশে৷ আর ২০১৩ সালে এভারেস্ট জয় করে ফেরার পথে মারা যান সজল খালেদ৷ এই ছবিঘরে মানবজাতির এভারেস্ট জয়ের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে৷ একেবারে সেই ১৯৫৩ সাল থেকে৷
ছবি: Musa Ibrahim
কোড ম্যাসেজ
‘‘স্নো কন্ডিশনস ব্যাড স্টপ অ্যাডভান্সড বেস এবানডন্ড মে টোয়েন্টিনাইন স্টপ অ্যাওয়েটিং ইমপ্রুভমেন্ট স্টপ অল ওয়েল’’ এই ম্যাসেজের অর্থ হচ্ছে: ‘‘হিলারি এবং তেনজিং ২৯ মে এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়া জয় করেছে৷’’ ১৯৫৩ সালের পহেলা জুন এই তথ্য লন্ডনে পৌঁছায়৷ এভারেস্টের সর্বোচ্চ শিখরে মানুষের পদচিহ্নের খবর শুনে উৎসবে মেতে ওঠে সবাই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
কে আগে চূড়ায় উঠেছিল?
নিউজিল্যান্ডের এডমান্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিং নোরগে (ছবিতে বামে) এভারেস্ট জয়ের পর এক নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়৷ এই দু’জনের মধ্যে কে আগে চূড়ায় পা রেখেছিলেন তা নিয়ে শুরু হয় তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক৷ নেপাল এবং ভারত এই জয় তাদের দাবি করে৷ তবে এভারেস্ট জয়ের কয়েক বছর পর হিলারি জানান, চূড়ায় ওঠার সময় তিনি তেনজিং এর থেকে কয়েক পা সামনে ছিলেন৷
ছবি: DW/S. Nestler
অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট জয়
হিলারি ও তেনজিং-এর সেই ঐতিহাসিক অভিযানের পরের তিন দশকে বহু পর্বতারোহী বিভিন্ন পথ ধরে এভারেস্টে উঠেছেন৷ ১৯৭৮ সালে সাউথ টাইরোলিয়ান রাইনহোল্ড মেসনার (ডানে) এবং অস্ট্রেলিয়ান পিটার হেবেলার (বামে) অক্সিজেনের বাড়তি জোগান ছাড়াই এভারেস্ট জয় করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দলে দলে এভারেস্ট জয়
১৯৯০ দশকের দিকে দল বেধে পর্বতারোহীরা এভারেস্ট জয় শুরু করেন৷ সেই সময় থেকে প্রতিবছর শত শত পর্বতারোহী এভারেস্টের চূড়ায় উঠছেন৷ রেকর্ড বলছে, এখন অবধি কমপক্ষে ৬,০০০ বার সফলভাবে এভারেস্টের চূড়া জয় করেছে মানুষ৷ আবহাওয়া ভালো থাকলে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে এভাবেই এভারেস্টের চূড়ার দিকে যাত্রা করেন পর্বতারোহীরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চূড়ায় পর্বতারোহীদের ভিড়
সফলভাবে এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে চূড়ান্ত পর্যায়ে অ্যাডভান্সড বেস ক্যাম্প থেকে কমপক্ষে চারদিন সময় লাগে আর এই সময়টা আবহাওয়া অবশ্যই ভালো থাকতে হবে৷ সাধারণত একইসময়ে অনেক অভিযাত্রী চূড়ার দিকে যাত্রা করেন, কেননা সবাই আবহাওয়ার পূর্বাভাষের উপর নির্ভরশীল৷ ফলে একদিনে অনেক পর্বতারোহীকে চূড়ায় এভাবে ভিড় করতে দেখাটা স্বাভাবিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেরপারা পথ দেখান
শেরপাদের সহায়তা ছাড়া কারো পক্ষে এভারেস্টের চূড়া জয় করা কার্যত অসম্ভব৷ তাঁরা এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার পথের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সদা তৎপর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
৮০ বছরে এভারেস্ট জয়
এভারেস্ট প্রতি বছরই চলে রেকর্ড গড়ার এবং ভাঙার খেলা৷ এই বসন্তে আশি বছর বয়সি জাপানি বৃদ্ধ ইউচিরো মিউরা এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রেখেছেন৷ এর আগে ২০১০ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করেন জর্ডান রেমেরো৷ দুটোই রেকর্ড৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উদ্ধার তৎপরতা
২০০৩ সালে এভারেস্ট বেসক্যাম্পে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দুই ব্যক্তি৷ দশ বছর পর মানে এখন এভারেস্ট বেসক্যাম্প পর্যন্ত হেলিকপ্টারে যাতায়াত স্বাভাবিক ব্যাপার৷ এখন অবধি সর্বোচ্চ ৭,৮০০ মিটার উচ্চতায় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
এভারেস্টে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এভারেস্টেরও ক্ষতি হচ্ছে৷ গত পঞ্চাশ বছরে সেখানকার বরফের পরিমাণ কমেছে ১৩ শতাংশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গর্বের এভারেস্ট
এভারেস্টের অধিকাংশ অংশই নেপালের আওতায় রয়েছে৷ ফলে এভারেস্টকেন্দ্রিক পর্যটন খাত থেকে বিপুল অর্থ আয় করে দেশটির সরকার৷ প্রতি বছরের ২৯ মে ‘আন্তর্জাতিক মাউন্ট এভারেস্ট দিবস’ উদযাপন করে নেপাল৷ ১৯৫৩ সালের এই দিনে এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিল মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পর্যটক কমাতে অনাগ্রহী নেপাল
এভারেস্টের চূড়ায় আরোহনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন বিধিনিষেধ আরোপ করার পক্ষে নয় নেপাল৷ বরং প্রয়োজনীয় টাকা থাকলে যেকেউ চেষ্টা করতে পারে এভারেস্ট জয়ের৷
ছবি: DW/S. Nestler
বাংলাদেশের এভারেস্ট জয়
২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহীম৷ এরপর আরো চারজন বাংলাদেশি এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন৷ এদের মধ্যে দু’জন মেয়ে৷ আর ২০১৩ সালে চূড়া জয় করে নামার পথে ‘ডেথ জোনে’ মারা যান সজল খালেদ৷
ছবি: DIAMIR Erlebnisreisen GmbH
13 ছবি1 | 13
ওদের নেহাতই দুর্ভাগ্য বলতে হবে যে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সহায়তা পেয়ে, সেইসব মূল্যবান সাজ-সরঞ্জাম কিনতে পেরেও সব ওদের পাহাড়চূড়ায় ফেলে আসতে হয়েছে৷ স্বেচ্ছায় অবশ্যই নয়, বাধ্য হয়ে৷ কারণ প্রতিকূল প্রকৃতি এমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল যে হয় ওদের সব কিছুর মায়া ত্যাগ করে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ উচ্চতায় নেমে আসতে হতো, অথবা ওরা কেউ বেঁচে ফিরতেন না৷ তাও ওরা চেষ্টা করেছিলেন যদি কিছু দামী সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে আসা যায়৷ কিন্তু বাদ সাধেন ওদের সঙ্গী শেরপারা৷ পাহাড়ি প্রকৃতির মতিগতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ শেরপারা ওদেরকে সাফ বুঝিয়ে দেন, বাঁচতে হলে কোনও কিছুর জন্যে পিছিয়ে পড়া যাবে না৷
বস্তুত ওই শেরপাদের জন্যই সাউথ ক্যালকাটা ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের চার অভিযাত্রী এবারের গঙ্গোত্রী-থ্রি অভিযান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন৷ শৃঙ্গ জয়ের নেশায় এবং প্রবল সাহস ও আত্মবিশ্বাসে ভর করে ওরা চূড়ান্ত লক্ষ্যের খুব কাছে পৌঁছে যান৷ কিন্তু হঠাৎ আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়, প্রবল তুষারপাত শুরু হয় এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করতে না পেরে ওঁরা একটু পিছিয়ে এসে একজায়গায় তাঁবু গাড়েন৷ রাতটা সেখানেই কাটানোর সিদ্ধান্ত হয়, যেটা ওঁদের পরিকল্পনায় ছিল না৷ এতে সবথেকে বড় যে অসুবিধা হয়, ওই সাড়ে ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় অক্সিজেন এত অল্প থাকে, যে বেশি সময় সেখানে কাটানো মানে শরীরে কম অক্সিজেন যাওয়া, ফলে দ্রুত অবসন্ন হয়ে পড়া৷
তাও ওঁরা শেষ চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু হাঁটু অবধি ডুবে গিয়েছে বরফে, সেই অবস্থায় এক ঘন্টার রাস্তা পেরোতে যেখানে চার ঘণ্টা লাগছে, সেখানে পিছিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না৷ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েও বাতিল করতে হল, কারণ এত বরফ পড়ছিল যে ওঁরা স্রেফ ডুবে যেতেন সেই তুষার সমুদ্রে৷ সারা রাত ধরে বরফ পড়ে তাঁবুর উপরে যে দু-আড়াই ফুট বরফ জমে গিয়েছে, সেটাও ওঁরা বুঝতে পারতেন না, যদি না রাতভোরে ওঁদের শেরপারা চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দিতেন৷ শেরপাদের উপরোধেই ওঁরা শেষ পর্যন্ত অভিযান বাতিল করে বেস ক্যাম্পে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন৷ আর ফেরার সময়ই দেখতে পান, রাস্তাঘাট সব বরফে ঢেকে গিয়েছে৷ কিছু চেনা যাচ্ছে না, বোঝা যাচ্ছে না৷
কোনওমতে বেঁচে ফিরেছেন, তাও ওঁদের আফসোস, পর্বতারোহণের দেড় লক্ষ টাকা দামের সরঞ্জাম ফেলে আসতে হল৷ নিয়ে আসতেই চেয়েছিলেন ওঁরা, কিন্তু একটা পর্যায়ে, ওই ভয়াল প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে ওঁদের সামনে একটাই সুযোগ ছিল – নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর৷ ওঁরা সেটা করতেই বাধ্য হয়েছেন৷ গত বুধবার কলকাতার জার্মান কনসুলেটে এক নৈশ অনুষ্ঠানে স্লাইড শো এবং নিজেদের শিহরণ জাগানো অভিযানের গল্প সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলেন ওঁরা৷ যদিও সফল হয়ে ফিরতে পারেননি, গঙ্গোত্রী-থ্রি শৃঙ্গ এযাত্রায় ওঁদের অধরা থেকে গিয়েছে, তবু ওঁদেরই জন্য এই আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করার মধ্যে জার্মান কনসুলেটের স্পোর্টিং মনোভাবের পরিচয় ওঁরা নিশ্চিত পেলেন৷ এই আশ্বাসও হয়তো পেলেন যে, ওঁদের অভিযান যেমন থেমে থাকবে না, সাহায্যের হাতও নিশ্চয়ই আবার এগিয়ে আসবে ওঁদের দিকে৷