শীতের বিষণ্ণতা ঢাকতেই কি এত উদযাপন গোটা মৌসুমজুড়ে? মায়ের কণ্ঠ কেবলই স্তব্ধ হয়ে আসে।
বিজ্ঞাপন
মায়ের সঙ্গে দূরত্ব এখন এক হাজার ৫০০ কিলোমিটার। প্রতিদিন সকালে সেই দূরত্ব পার করি মিনিট পাঁচেকের ফোন কলে। গত বেশ কিছুদিন, একাই কথা বলে যাচ্ছি বেশি। কার্যত নীরবই থাকে মা। বুঝতে পারি, মায়ের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, অথবা কথা আসছে না নিশ্চয়! মাসখানেকের মধ্যে একে একে বেশ কিছু বন্ধু হারিয়েছে এই পঁচাত্তর ঊর্ধ্ব নারী।
মা এখন যে বয়সে পৌঁছেছে, তাতে এমন খবরের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। নিতেই হবে। কিন্তু প্রস্তুত থাকা আর খবরের মুখোমুখি হওয়ার মধ্যেও যে দূরত্ব অনেক! ছেলের অনর্গল মা-ভোলানো কথার মাঝখানে তা-ই হয়তো সে মাঝে মাঝে বলে ফেলে-- ''মেনে নিতে হয় জানি এই মরশুমি মৃত্যু। মরশুমি ফুলের মতোই ঝরে যাওয়া আসলে!'' মনে পড়ছে, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে দিদা যখন অনর্গল কথা বলে যেত, তখন বার বার ফিরে আসতো একটি বাক্য-- ''শীত বড় কালান্তক। এ এক ঝরে যাওয়ার কাল।
মায়ের বন্ধু, পাড়ার কাকু, বন্ধু হয়ে ওঠা শিক্ষক- গত একমাসে কত যে কাছের মানুষ হারালাম, গুণতে ইচ্ছে করে না। আমারই যদি মনের আবহ এমন হয়, মায়ের তো ঝড় বইছে বুকের ভিতর! ঝড়, নাকি কুয়াশার নিস্তব্ধতা? মৃত্যুর কি সত্যিই কোনো ছবি হয়? না কি সে এক অপার অন্তহীন ধোঁয়াশা? ধোঁয়াটে, সাদাটে দিল্লির সকালের মতো। সূর্য উঠেছে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু কোনো তেজ নেই। মৃত চোখের মতো সূর্য চেয়ে থাকে কেবল। চেনা রাস্তা সামান্য দূরেই অচেনা পর্দার আড়ালে। শীত যত গাঢ় হয়, ক্রমশ অচেনা হতে থাকে চেনা মানুষের মুখ। প্রবল ধোঁয়াশায় কাছের মানুষও ঝাপসা হতে থাকে।
ঢাকায় শীতের পোষাক ও উদযাপন
পৌষ মাসের আগমনী বার্তায় রাজধানী ঢাকায় শীতের প্রকোপ শুরু হয়েছে। কেনাকাটা বেড়েছে শীতের পোষাকের। ঢাকায় কিভাবে শীতের আগমনকে বরণ করছেন সাধারণ মানুষ, দেখুন ছবিঘরে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কোট ও ব্লেজারের বিক্রি ভালো
ঢাকার গুলিস্তান ও পল্টনের ফুটপাতের দোকানগুলোতে সকাল থেকেই পথচারীদের ভিড়। বিক্রেতারা জানান, ছয়শ টাকা থেকে শুরু করে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে পোষাকগুলো।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কম্বল দাম ও চাহিদা
ঢাকার কম্বলের অন্যতম পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দেশি-বিদেশি কম্বলের সমান চাহিদা রয়েছে। বিদেশি কম্বল মূলত দুবাই, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সৌদি আরব, ভারত, স্পেন থেকে আসছে। আকারভেদে সেগুলো বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে ১২ হাজার টাকায়।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
যত শীত তত বিক্রি
ঢাকার গুলিস্তানের পাইকারি ও খুচরা কম্বল বিক্রেতা রকিবুল ইসলাম মনে করেন, ঢাকায় ৩-৪ বছর পর পর শীত তীব্র হয়। গত কয়েক বছরে তেমন শীত না পড়ায় এবার শীত বেশি পড়ার আশা করছেন তিনি। তিনি বলেন, যত বেশি শীত, আমাদের ব্যবসা তত ভালো।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কমফোর্টারে আরাম
ঢাকার গুলিস্তানের পাইকারি ও খুচরা কম্বলের দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কিছু দোকানে কমফোর্টার বিক্রি হচ্ছে। পুরান ঢাকা থেকে কমফোর্টার কিনতে আসা সেলিনা পারভীন বলেন, কম্বলের চাইতে এর আরাম বেশি। তবে বিক্রেতারা দাম অনেক বেশি চাইছেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দামে ও পছন্দে মিলছে না
ক্রেতারা জানান, এবারের শীতের পোষাকের দাম তুলনামূলক অনেক বেশি। যেটা পছন্দ হচ্ছে, সেটা দামে মিলছে না। আবার যেটার দাম নাগালের মধ্যে, সেই পোশাকের মান পছন্দ হচ্ছে না।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কেনাকাটায় পিছিয়ে নেই পুরুষরা
ঢাকায় ফুটপাত, মার্কেট, শপিং মলে নারী ক্রেতাদের পাশাপাশি চোখে পড়ছে পুরুষ ক্রেতাদেরও। মূলত তাঁরা নিজেদের জন্যই শীতের পোশাক কিনতে আসছেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফুটপাতে একদাম
ঢাকার গুলিস্তান, পল্টন, ফার্মগেটের ফুটপাথে শীতের কাপড় বিক্রি করছে এমন দোকানগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে অধিকাংশ দোকানেই “এক দাম” এ শীতের পোশাক বিক্রি হচ্ছে। দামদর করার ঝামেলা এড়াতে সীমিত লাভে বিক্রেতারা পোষাকগুলো বিক্রি করছেন বলে দাবি তাদের।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শীতে বাড়ে জুতার চাহিদা
ঢাকার গুলিস্তানের জুতা বিক্রেতা মোঃ শাহজাহান মিয়া বলেন, “গরমের সিজনে স্যান্ডেল আর শীতে বাড়ে জুতার চাহিদা। এখন তাই জুতার দামও কিছুটা বেশি।“
ছবি: Mortuza Rashed/DW
চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে চলছে ব্যবসা
ঢাকার শীতের পোশাকের অন্যতম বড় খুচরা বাজার গুলিস্তানে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলাচলের একটি রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে কেনাবেচা করছেন বিক্রেতারা। রাস্তাটিতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভীড়ের কারণে আশেপাশের সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজটের।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অভিজাত দোকানে ভিড় কম
ঢাকার ধানমন্ডির অভিজাত দোকান ও শপিং মলগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে এখনো শীতের পোশাক বিক্রি জমে উঠেনি। তবে শীত বাড়ার সাথে সাথে বিক্রি বাড়ার ব্যাপারেও আশাবাদী বিক্রেতারা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফ্যাশন হাউজগুলোর স্টাইলিশ কালেকশন
ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, রাপা প্লাজাসহ বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজগুলো ঘুরে দেখা যায়, সেখানে শীতের জন্য স্টাইলিশ ও এক্সক্লুসিভ সব কালেকশন আনছেন তাঁরা। ক্রেতাদের সাড়াও পাচ্ছেন ভালো।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
এলাকাভিত্তিক মৌসুমি ব্যবসা
ঢাকার মিরপুরের আগারগাঁও, কাজীপাড়া, তালতলা এলাকাগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে এলাকাভিত্তিক ব্যবসায়ীরা শীতের পোশাক বিক্রি করছেন। তাঁরা জানান, সারা বছর অন্যান্য পণ্যের ব্যবসা করলেও শীতের মৌসুমে তাঁরা শীতের পোশাকই বিক্রি করেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভোরে শীত বেশি
প্রতিদিন ভোরে কাজে বেরিয়ে পড়তে হয় মিরপুরের বাসিন্দা আফজাল হোসেনকে। তিনি বলেন, মাঝ রাত থেকে ভোরের সময়টা পর্যন্ত কুয়াশা ও শীতের তীব্রতা থাকে বেশি। মূলত এ সমইয়টাতে একাধিক শীতের পোশাক গায়ে না জড়ালে টেকা মুশকিল।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শীতের আকর্ষণ গুড়
বাংলাদেশে শীতের অন্যতম আকর্ষণ গুড়। আখের গুড় প্রায় সারা বছর পাওয়া গেলেও খেজুর গুড়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে শীতের মৌসুমে। ছবিতে ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে এক গাছির বাসায় খেজুরের রস থেকে গুড় প্রস্তুত করতে দেখা যাচ্ছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নানা স্বাদের পিঠা
শীতের মৌসুমে বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ দোকানে নানা স্বাদের ঝাল ও মিষ্টি পিঠা বিক্রি করতে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে ডিম পিঠা, পাকন পিঠা, তেল পিঠা, চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, পুলি পিঠা ইত্যাদি। দাম সাধ্যের মধ্যে হওয়ায় দোকানগুলোতে এসব পিঠার চাহিদাও থাকে বেশ।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
15 ছবি1 | 15
রক্তস্রোত ঠান্ডা হয়ে থাকা এসমস্ত দিনে আগুন জ্বেলে বসে থাকতে হয়। দিল্লির রাস্তায়, ফুটপাথের সংকীর্ণ আস্তানার আঁধারে সারা রাত ধরে আগুন জ্বেলে বসে থাকেন যারা, তারা আসলে ঘুমাতে পারেন না। আগুন নিভে গেলে শীতের কামড় মৃত্যুমুখে টেনে নিয়ে যায়। কলকাতা, দিল্লি-- সর্বত্রই পুর নগর নিগম জানে-- শীত বাড়লে বাড়ে বেওয়ারিশ লাশ। রাস্তার ধারে পড়ে থাকে অন্ধ ভিখারি, ভবঘুরে সাধু। এক মাস মর্গে আরেকটু ঠান্ডা করার পর বেওয়ারিশ বডি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ময়লার পাহাড়ে। এটাই নিয়ম।
দাদরার তালে কীর্তন অঙ্গে রবিঠাকুর এই শীত নিয়ে যে গানটি লিখছেন, তার কথাগুলি বড় অদ্ভুত। লিখছেন-- নমো নমো। নমো, নমো। নমো নমো।/ নির্দয় অতি করুণা তোমার-- বন্ধু তুমি হে নির্মম।/ যা কিছু জীর্ণ, করিবে দীর্ণ, দণ্ড তোমার দুর্দম।
ধ্বংস বা মৃত্যুর শেষে যে বিস্তীর্ণ শান্তির চরাচর, তাকেই কি নির্মম বন্ধু বলছেন রবীন্দ্রনাথ? সেই কি আসলে এক মৃত্যুপারের শীতের ছবি তার কাছে? দিনুঠাকুরের স্মরলিপিতে সে জন্যই কি এ গান মুক্তছন্দ পায় না? দাদরার চটকদার ছন্দ আর কীর্তনের সুরের আবহে আসলে তৈরি হচ্ছে মৃত্যুকে উদযাপনের এক প্রতিচ্ছবি? শীত তো সত্যিই এক উৎসবের প্রতিচ্ছবি! মৃত্যুভয় জয় করা ক্রিসমাস ক্যারল? বর্ষপূর্তির চোখ ধাঁধানো আলো? শীত আসলে এক উদযাপনের মরশুম।
বিষণ্ণতা আর রোশনাইয়ের মধ্যবর্তী এক নির্লিপ্তিতে ছেয়ে আছে এক হাজার পাঁচশ কিলোমিটার দূরে মায়ের কণ্ঠ। বলা না বলার মাঝের ওই অশ্রুত, অব্যক্ত শব্দগুচ্ছই আসলে মা আর আমার মাঝের এক লেপ-জড়ানো শীত। ঠোঁট আর ছ্যাঁকা লাগা কফি কাপের মধ্যবর্তী নিঃশ্বাসের দূরত্ব। । অনেকটা মৃত্যু আর অনেকটা উদযাপনের। হয়তো বা মৃত্যু উদযাপনের।