ব্রিটেনে ইস্ট লন্ডনের একটি পরিবার এখন দু-দুটি আঘাতে বিপর্যস্ত৷ প্রথমে মা, তারপর মেয়েও ধরেছে মৃত্যুর পথ৷ মা-কে কেড়ে নিয়েছে ক্যানসার, আর মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস!
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চৌধুরী মইনুদ্দিনের নাম জড়ানোর কারণেই প্রথমে নজরে এসেছিল খবরটি৷ দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটেনপ্রবাসী চৌধুরী মইনুদ্দীনের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা একটি সংগঠন নাকি কচি মেয়েদের ভুলিয়ে ভালিয়ে আইএস-এ পাঠাচ্ছে৷ প্রথমে একজন, তারপর আরো তিন বাঙালি কিশোরী আইএস-এ যোগ দিতে ব্রিটেন ছাড়ার খবর আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সাড়া জাগায়৷ একটি পরিবারের জন্য আদরের মেয়ে হারানো ছিল বড় বেশি হৃদয় বিদারক৷
মেয়েটির নাম শারমিনা বেগম৷ কিছুদিন আগেই মা মারা গেছেন ক্যানসারে৷ মা চেয়েছিলেন মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হোক৷ মেয়েও চেয়েছিল মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে জীবন সার্থক করবে৷ ডাক্তার হলে মুমূর্ষুকে নতুন জীবন দিত৷ তা না করে ও ধরেছে মৃত্যুর পথ৷ শারমিনার ধারণা, মরলে সে মায়ের দেখা পাবে!
হত্যা, আতঙ্ক আর ঘৃণায় আইএস
শুধু ইরাক আর সিরিয়া নয়, আজকাল বিশ্বের অনেক দেশেই ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর তৎপরতার কথা শোনা যায়৷ খেলাফত কায়েমের কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা জঙ্গি সংগঠনটিকে নিয়েই আমাদের আজকের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Jordan News Agency
তাদের কাছে নারী যেন বাজারের পণ্য
অনেক সময় আটক নারী ও শিশুদের আইএস জঙ্গিরা যৌন দাস হিসেবে ব্যবহার করে৷ সম্প্রতি আইএস-এর কবল থেকে পালিয়ে আসা ৪০ জনেরও বেশি ইয়াজিদি নারীর সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ নারী ও শিশুদের সঙ্গে আইএস-এর এমন আচরণে নিন্দা জানিয়েছেন সবাই৷
ছবি: DW/Andreas Stahl
সাংবাদিক, এনজিওকর্মী হত্যা করে হুমকি
তাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা বন্ধ না করায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতে নিরপরাধ মানুষ হত্যার বেশ কিছু নজীর গড়েছে আইএস৷ বিমান হামলার প্রতিশোধের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন সাংবাদিক, একজন এনজিও কর্মী এবং ব্রিটেনের দু’জন এনজিও কর্মীর শিরশ্ছেদ করেছে তারা৷ ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক জেমস ফলিকে৷ গত আগস্টে তাঁর শিরশ্ছেদ করে ভিডিওচিত্র প্রচার করে আইএস৷
ছবি: dapd
মুসলমান হলেও রক্ষা নেই....
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সিরীয় শরণার্থীদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন পিটার কাসিগ৷ মুসলমান হিসেবে তাঁর নাম হয়েছিল আব্দুল রহমান কাসিগ৷ গত নভেম্বরে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় তাঁকেও হত্যা করে আইএস৷ হত্যার পর ভিডিও চিত্রও প্রকাশ করা হয়৷ নৃশংস এ ঘটনাকে ‘শয়তানের কাজ' হিসেবে বর্ণনা করেন বারাক ওবামা৷
ছবি: picture-alliance/AP/Kassig Family
জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি, তারপর...
জাপানের দুই নাগরিককে জিম্মি করে প্রথমে ২০০ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবি করে আইএস৷ মুক্তিপণ না পাওয়ায় হারুনা ইউকাওয়াকে হত্যা করলেও সাংবাদিক কেনজি গোতোকে আটকে রাখে৷ গোতো এবং জর্ডানের বৈমানিক আইমান মাজ-আল-কাসাবেহকে জিম্মি করে তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে জর্ডানে আটক আইএস-এর এক নারী যোদ্ধার মুক্তি দাবি করা হয়৷ তাঁকে মুক্তি না দেয়ায় কেনজি গোতো এবং আইমান মাজ-আল-কাসাবেহকে হত্যা করে আইএস৷
ছবি: Reuters/www.reportr.co via Reuters TV
ইরাকে শুরু....
গত বছরের জুন মাসে ঝটিকা আক্রমণের ইরাকের মোসুল দখল করে নেয় আইএস৷ সুন্দিদের এই জঙ্গি সংঠনটি তারপর ইরাকের বেশ বড় একটা অংশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে৷ সিরিয়াতেও দখল করে নেয় কিছু এলাকা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বাংলাদেশেও তৎপর আইএস...
আইএস সরাসরি যুদ্ধ করছে ইরাক আর সিরিয়ায়৷ যোদ্ধা সংগ্রহ করা হচ্ছে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্ত থেকে৷ জার্মানি, বৃটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের মতো ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে জঙ্গি মনোভাবাপন্নরা গিয়েছে ইরাক, সিরিয়ায়৷ এশিয়ার দেশগুলোতেও তৎপর আইএস৷ বাংলাদেশেও আইএস সমর্থক সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কয়েকজনকে৷
ছবি: Reuters
জুতার নীচে আইএস!
আইএস-এর প্রতি ঘৃণাও বাড়ছে সারা বিশ্বে৷ ইরাকের স্থপতি আকীল খ্রীফ তো আইএস জঙ্গিদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে বেছে নিয়েছেন অভিনব এক উপায়৷ পুরোনো জুতা সংগ্রহ করে তার নীচে জুতার পরিত্যক্ত ফিতা, বোতাম ইত্যাদি দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন আইএস জঙ্গিদের চেহারার আদল৷ আকীল খ্রীফ মনে করেন, আইএস জঙ্গিদের স্থান জুতার নীচেই হওয়া উচিত৷
ছবি: Armend Nimani/AFP/Getty Images
বৈমানিককে পুড়িয়ে মারা এবং জর্ডানের ‘প্রতিশোধ’
আটক নারী যোদ্ধাকে মুক্তি না দেয়ায় জর্ডানের বৈমানিক আইমান মুয়াত আল-কাসেসবেহ-কে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারে আইএস৷ ক্ষুব্ধ হয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নিতেও দেরি করেনি জর্ডান৷ আইমান মুয়াত আল-কাসেসবেহ-কে (ওপরের ছবি) হত্যা করে আইএস ভিডিও প্রকাশের পরই তাদের নারী যোদ্ধা সাজিদা আল-রিশোয়াই ও আরেক কর্মীকে ফাঁসিতে ঝোলায় জর্ডান সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Jordan News Agency
8 ছবি1 | 8
‘ডেইলি মেল'সহ বেশ কিছু সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, বৃটেনে অবস্থানরত আইএস সমর্থক একটি গোষ্ঠীই শারমিনার মনে এমন ধারণা প্রোথিত করেছে৷ শারমিনার বয়স যখন ১৫ তখন তার মা মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ক্যানসারে ভুগে মারা যান৷ মায়ের মৃত্যুর পর থেকে পড়ুয়া মেয়ে শারমিনার মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন বাবা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন৷ পড়ালেখায় বিশেষ মন নেই৷ আগের মতো শাকিরার গান বাজিয়ে আর নাচে না৷ স্কুল থেকে বেরিয়েই চলে যায় মসজিদে৷ অনেক রাত করে ফেরে৷ ভারতীয় এক রেস্টুরেন্টের ওয়েটার নিজাম উদ্দিন ভেবেছিলেন, অল্প বয়সে মা হারানোর বেদনা ভুলতেই মেয়ে তাঁর মসজিদে যাচ্ছে৷ তাতে তো অসুবিধা নেই৷ ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই সে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে লেখাপড়াতেও মন দেবে৷ ডেইলি মেলকে সে কথাই বলেছেন শারমিনার বাবা৷
কিন্তু আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরেনি শারমিনা৷ প্রথমে দাদির কাছ থেকে বলে-কয়ে ৫০০ পাউন্ড আদায় করে৷ তার কিছুদিন পর দাদির জিম্মায় রাখা পাসপোর্টটাও স্কুলের হয়ে শিক্ষাসফরে যাওয়ার কথা বলে বাগিয়ে নেয়৷ গত ডিসেম্বর থেকে শারমিনা একেবারে উধাও৷ সন্তানকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে বাবা নিজেই বিষয়টি পুলিশকে জানান৷ ধীরে ধীরে খুলতে থাকে রহস্যের জট৷
শারমিনা কোথায় তা-ও এখন সবারই জানা৷ উধাও হওয়ার দু'মাস পর মেয়ে নিজেই ফোন করেছিল বাবাকে৷ ফোনে একটা কথাই বলেছে সে, ‘‘আব্বা, আমি সিরিয়ায় এসে এক আইএস যোদ্ধাকে বিয়ে করেছি৷ এখানে মরলে আমি আম্মার কাছে যাবো৷''
স্ত্রীবিয়োগ শোকে কাতর নিজাম উদ্দিন মেয়েকেও হারালেন জেনে তারপর থেকে দিশেহারা৷
ক্যানসারে মৃত্যু বরণ করার আগে একজন মা আশা করেছিলেন তাঁর মেয়ে দীর্ঘজীবী হবে, ডাক্তার হয়ে মানবকল্যাণে উৎসর্গ করবে নিজের জীবন৷ রেস্টুরেন্টের ওয়েটার নিজাম উদ্দিন দেখেছিলেন মেয়ের অর্জনে গর্বিত হওয়ার স্বপ্ন৷ কিন্তু বাবা-মায়ের স্বপ্ন কেড়ে নিল আইএস৷