পর্যটন ও পরিবেশ – এই দুইয়ের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানো সহজ নয়৷ একদিকে পর্যটন থেকে আয়ের হাতছানি, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণের কালো ছায়া৷ মেক্সিকোর একটি অভিনব দ্বীপে পর্যটকদের এ বিষয়ে সচেতন করে তোলার চেষ্টা চলছে৷
বিজ্ঞাপন
মেক্সিকোর পরিবেশবান্ধব পর্যটন
06:02
মেক্সিকোর পূর্ব উপকূলে ক্যারিবীয় সাগরে কোসুমেল দ্বীপ৷ গোটা বিশ্বে ক্রুজ জাহাজের পর্যটকদের জন্য সেরা আকর্ষণগুলি মধ্যে একটি৷ প্রতি বছর প্রায় ৫০ লক্ষ পর্যটক সেখানে আসেন৷ বন্দরে একইসঙ্গে সাতটি জাহাজ নোঙর করতে পারে৷ দেখলে মনে হবে, যেন দ্বীপের উপর হামলা শুরু হয়েছে৷
হোসে নিয়েতো বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন৷ প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি এই দ্বীপে বসবাস করছেন৷ এই সময়কালে দৈত্যাকার জাহাজগুলির জন্য বন্দরের ক্রমাগত সম্প্রসারণের সাক্ষী হয়েছেন তিনি৷ হোসে বলেন, ‘‘পর্যটন গোটা দ্বীপের জন্য অত্যন্ত জরুরি৷ এখানে কর্মরত সব মানুষের আয়ের উৎস৷ আমরা পর্যটকদের উপর নির্ভরশীল৷''
তবে পর্যটকরা সাধারণত দ্বীপের অভ্যন্তরে রেন ফরেস্ট এলাকায় যান না৷ তার প্রায় অর্ধেক অংশই সংরক্ষিত এলাকা৷ জীববিজ্ঞানী হিসেবে ক্রিস্টোফার গনসালেস সেই উদ্যোগ বজায় রাখতে চান৷ তাঁর মতে, দ্বীপটি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘কয়েক বছর আগে কোসুমেল এ রকম দেখতে ছিল৷ আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ পর্যটকরা দ্বীপের নতুন পরিচয়ের অংশ হয়ে উঠেছেন৷ আমাদের এই নতুন কোসুমেল-কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা সেই উদ্যোগেরই অংশ৷''
পানির নীচে এসব কাজও করা যায়!
ডাইভিং বা সাঁতার অথবা স্নোরকেলিং কি আর আপনার মনে কোনো রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে না? তাহলে পানির নীচে যেতে পারেন৷ রেস্তোরাঁ এবং জাদুঘরগুলো আপনার অপেক্ষায় আছে৷ দেখে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: Jason deCaires Taylor - creator & photographer
বিভিন্ন ড্রামারের ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ
ড্যানিশ ব্যান্ড ‘বিটুইন মিউজিক’ এমন সব বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যেগুলো আপনি পানির নীচে বাজাতে পারেন৷ এগুলোর মধ্যে আছে হাইড্রাউলোফোন, পানির নীচে বাজে এমন অর্গান, ক্রিস্টালোফোন, গ্লাস হারমোনিকা এবং বিশেষ ড্রাম৷ তাঁদের অ্যালবাম ‘অ্যাকোয়াসনিক’ রেকর্ড করা হয়েছে উষ্ণ পানির বিভিন্ন পুলে, যেখানে তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি৷ তাঁ@রা অবশ্য গান গাওয়ার জন্য বিশেষ কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে থাকেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/J, Nackstrand
কোনো সাধারণ বাগান নয়
আপনার অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ কি প্রায়ই সেখানকার উদ্ভিদ খেয়ে ফেলে? তাহলে আপনি ‘অ্যাকোয়াস্কেপিং’ চেষ্টা করে দেখতে পারেন৷ এর মাধ্যমে আপনি পানির নীচে দারুণ সব দৃশ্য সৃষ্টি করতে পারেন৷ কেবল উদ্ভিদ ব্যবহার করেই নয়, পাথর, গাছের শেকড়, কাঠও ব্যবহার করতে পারেন আপনি৷
ছবি: DW
পানির তলদেশে খাওয়া
বেলজিয়ামের রেস্তোরাঁ ‘দ্য পার্ল’ ব্রাসেলসে অবস্থিত, যেটি বিশ্বের অন্যতম গভীর পুলে নির্মাণ করা হয়েছে৷ এর ভেতরে যেতে হলে অতিথিদের সাঁতারের পোশাক পরতে হবে এবং একটা ক্যাপসুলের ভেতর দিয়ে ৫ মিটার সাঁতরে যেতে হবে৷ আর মেন্যুতে কী থাকছে? অবশ্যই সামুদ্রিক খাবার! প্রতিটি খাবার ওয়াটারপ্রুফ কাঁচ দিয়ে প্যাক করা৷ প্রতি জনের খাবারের মূল্য মাত্র ১০০ ইউরো!
ছবি: DW
পানির তলদেশে শিল্পকর্ম
২০১৬ সালে ব্রিটিশ ভাস্কর জেসন ডি কেয়ার্স টেইলর তাঁর নতুন প্রকল্প চালু করেন ক্যানারিসের ল্যানসারোট উপকূলে৷ তাঁর ‘মুসিও আটলান্টিকো’ শিল্পকর্মটি পানির ১৪ মিটার গর্ভীরে তৈরি করেছেন তিনি, যেখানে ২০০টিরও বেশি ভাস্কর্য রয়েছে৷ পরিবেশবান্ধব পদার্থ ব্যবহার করেই ভাস্কর্যগুলো নির্মাণ করা হয়েছে৷ এর ফলে সমুদ্র তলদেশে প্রাণী বা উদ্ভিদের কোনো ক্ষতি হবে না৷
ছবি: Jason deCaires Taylor - creator & photographer
বুদবুদের মাধ্যমে বার্তা
বিয়ের বর-কনের অবশ্যই অতিথিদের একটা মজার তালিকা হতেই পারে: রঙিন মাছ, শৈবাল, স্টিং রে, এমনকি হাঙর পর্যন্ত৷ আপনি যদি ইউরোপে থাকেন, তাহলে কিন্তু এটা সম্ভব৷ এই মহাদেশজুড়ে এমন অনেক অ্যাকোয়ারিয়াম রয়েছে, যেখানে গিয়ে আপনি বিয়ের কাজটি সেরে ফেলতে পারেন৷ আর বিয়ের অঙ্গীকার, অর্থাৎ ‘আই ডু’ বলার সময় একটি বুদবুদের মাধ্যমে সেই বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন অন্য সবার কাছে৷
ছবি: MICHAEL KAPPELER/AFP/Getty Images
5 ছবি1 | 5
তিনি আরও বেশি পর্যটকদের এখানে নিয়ে আসতে চান, তাঁদের জন্য ট্রেকিং-এর ব্যবস্থা করতে চান৷ তবে পরিবেশের ক্ষতি এড়াতে কড়া নিয়ম মেনে চলতে হবে৷ এতকাল পর্যটকরা এই দ্বীপের অনবদ্য প্রবাল প্রাচীরের আকর্ষণে এসেছেন৷ কিন্তু সেই প্রাচীর কতকাল অক্ষত থাকবে?
কোসুমেল দ্বীপের কাছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর রয়েছে৷ পাঁচশ'রও বেশি প্রজাতির মাছ সেখানে বসবাস করে৷ তাদের মধ্যে কয়েকটি লুপ্তপ্রায়৷ অত্যন্ত নাজুক এই স্বর্গরাজ্য অমূল্য এক সম্পদ৷
দ্বীপের প্রাচীরের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলে বছরে প্রায় ৭ কোটি ইউরো আয় কমে যাবে৷ জার্মানির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জিআইজেড এক গবেষণার মাধ্যমে এমন পূর্বাভাষ দিচ্ছে৷ ক্রিস্টোফার গনসালেস বলেন, ‘‘পানির মান খারাপ হলে ও মাছের সংখ্যা কমে গেলে বছরে ১২ শতাংশ কম পর্যটক এই দ্বীপে আসবেন৷ তাই কঠিন পরিশ্রম করে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে৷ মানুষ মানে শুধু পর্যটক নয়, ডাইভিং গাইড-দের কথাও বলছি৷ তাঁরাই আমাদের দূত৷ গাইডরা যা করেন, পর্যটকরাও তা নকল করেন৷''
রাইমুন্ডো রামিরেস প্রতিদিন কাজের সময় সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেন৷ পেশায় তিনি ডাইভিং প্রশিক্ষক৷ তিনি বলেন, ‘‘কোসুমেল দ্বীপে ‘এল সিয়েলো' সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান৷ সেখানে টারকয়েস নীল রংয়ের পানি মাত্র দেড় মিটার গভীর৷ চারিদিকে তারা মাছ ছড়িয়ে রয়েছে৷ পর্যটকরা এসে সেগুলি হাতে তুলে নিয়ে সেলফি ছবি তুলে আবার পানিতে ফেলে দেন৷ হয়তো পরের দিনই সেই তারা মাছের মৃত্যু হয়৷ পর্যটকদের এ বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই৷ এখানে কোনো কিছুই ছোঁয়া উচিত নয়৷''
জলবায়ু পরিবর্তনের শক্তিশালী কয়েকটি ছবি
জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বিভিন্নভাবে উপলব্ধি করা যায়৷ একটি সংস্থা প্রবাল প্রাচীরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সেটা আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করছে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
দুই মাস আগে, পরে
জলবায়ু যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বোঝার অন্যতম উপায় প্রবালের দিকে খেয়াল করা৷ উপরে যে ছবিটি দেখছেন তার বাম পাশেরটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তোলা, আর ডানেরটি দুই মাস পর, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের৷ এবার নীচে কোরালগুলোর দিকে তাকান৷ বামেরগুলো এক রংয়ের আর ডানেরগুলো সাদা হয়ে গেছে৷ হ্যাঁ, এটা জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়েছে৷ ছবিটি অ্যামেরিকান সামোয়া এলাকার৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
সাদা হয়ে যাওয়া
এই ছবিটি হাওয়াই এলাকার৷ এখানেও সাদা হয়ে যাওয়া কোরাল দেখা যাচ্ছে৷ কোরাল তার গায়ে থাকা জলজ উদ্ভিদ, অ্যালজির কারণে বেঁচে থাকে৷ কিন্তু তাপমাত্রা বেড়ে গেলে কোরাল থেকে ঐ উদ্ভিদ ঝরে পড়ে৷ ফলে কোরালেরও আয়ু শেষ হতে থাকে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
একেবারে স্পষ্ট
এতক্ষণ দূর থেকে সাদা অংশ দেখেছেন৷ এখন দেখুন একেবারে কাছ থেকে তোলা ও বর্ধিত করা একটি ছবি৷ এটি কোরালের একটি অংশ৷ দেখুন, গায়ে থাকা জলজ উদ্ভিদ আর না থাকায় কীরকম সাদা হয়ে গেছে কোরালটি৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
চারদিক কেমন যেন খাঁ-খাঁ করছে
মন খারাপ করা একটি ছবি৷ অ্যালজি না থাকায় মরে গেছে কোরাল৷ পড়ে আছে শুধু কঙ্কাল৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
কয়েক দশক সময় প্রয়োজন
এবার আরেকটি ছবি৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি থেকে কোরাল রিফের বেঁচে উঠতে (আদৌ যদি বেঁচে ওঠে) কয়েক দশক সময় লাগতে পারে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
প্রমাণ সংগ্রহ
বিশ্বের কোরাল রিফগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণে ২০১২ সালে ক্যাটলিন গ্রুপের সহায়তায় ‘এক্সএল ক্যাটলিন সিভিউ সার্ভে’ নামে একটি সমীক্ষা শুরু হয়৷ এর মাধ্যমে উচ্চপ্রযুক্তির ক্যামেরা ও রোবট ব্যবহার করে কোরালের বর্তমান অবস্থা তুলে আনা হচ্ছে৷ অনেক ছবি গুগল স্ট্রিট ভিউ-তে আপলোড করা হয়েছে৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে তাপমাত্রা বাড়ছে তার প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি অংশ শুষে নেয় সাগর৷ ফলে জলবায়ু যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বোঝার একটি ভালো উপায় হচ্ছে কোরাল৷ সমুদ্রের প্রায় ২৫ শতাংশ প্রজাতির বেঁচে থাকার পেছনে রয়েছে কোরাল রিফ৷ তাই কোরাল না থাকে মানে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়া৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
প্রাণিকুলের খাবার
দেখছেন অ্যামেরিকান সামোয়ার ‘এয়ারপোর্ট রিফ’৷ স্বাস্থ্যবান এ সব কোরালের মধ্যে যে গাছপালা থাকে সেখান থেকেই খাবার সংগ্রহ করে পানির নীচে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী৷
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
খাবার পাবে কোথায়?
লম্বা নাকের সুন্দর এই মাছটি কোরাল থেকে খাবার সংগ্রহ করে থাকে৷ কিন্তু কোরালই যদি না থাকে তাহলে তার কী হবে?
ছবি: XL Catlin Seaview Survey
9 ছবি1 | 9
বেশিরভাগ পর্যটকদের এই সচেতনতার অভাবের কারণে রামিরেস ক্ষুব্ধ হন৷ সে কারণে তিনি ছোট দল নিয়ে পানিতে নামেন এবং তাঁদের স্পষ্ট নির্দেশ দেন৷ রাইমুন্ডো বলেন, ‘‘নিজের উৎসাহ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে প্রবাল প্রাচীরের কাছে ডুব দিলে প্রাচীরের সঙ্গে ধাক্কা লাগবে৷ হাত অথবা অক্সিজেন সিলিন্ডার আঘাত করতে পারে৷ প্রাচীর বা স্পঞ্জ সিলিন্ডারের ধাক্কা খেলে বিশাল ক্ষতি হয়৷ তখন সেগুলি ভেঙে গিয়ে তাদের মৃত্যু হয়৷
ক্রুজ জাহাজের পর্যটকরা বড়জোর অর্ধেক দিন দ্বীপে কাটান৷ সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার জন্য এই সময় যথেষ্ট নয়৷ মায়া সভ্যতার আমলে এখানে একটি ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল৷ মেয়র পেরলা টুন পেশ নিজে মায়া সম্প্রদায়ের মানুষ৷ পর্যটকরা সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে আরও আগ্রহ নিয়ে দ্বীপে আসুন, সেটাই তাঁর ইচ্ছা৷ তিনি বলেন, ‘‘কোসুমেল দ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান সত্যি সুবিধাজনক৷ সে কারণে ক্রুজ জাহাজের পর্যটকদের ছাড়া আমাদের চলবে না৷ তবে তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম বেঁধে দিতে সংকোচ করলেও চলবে না৷ আমাদের পরিবেশ দূষণ করলে এখানে আসা চলবে না৷ আমাদের দোকান ও রেস্তোরাঁয় না এলে এখানে আসা চলবে না৷ আমাদের সমাজে কোনো অবদান না রাখলে এখানে তোমাদের স্বাগত জানানো হবে না৷''
সন্ধ্যায় বন্দর ফাঁকা হয়ে যায়৷ কোসুমেল দ্বীপে শান্তি ফিরে আসে৷ তবে কয়েক ঘণ্টার জন্য স্বস্তি পাওয়া যায়৷ কারণ পরের ক্রুজ জাহাজ রওয়ানা হয়ে গেছে৷