ছেলেবেলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে বারণ করা হতো ছোটদের৷ তখন কি আর অভিভাবকরা জানতেন, ঐ আকাশ দেখা, মেঘ দেখাটা আসলে একটা হবি, যার একটা রীতিমতো ইংরিজি নাম আছে: ক্লাউডস্পটিং৷
বিজ্ঞাপন
ইংল্যান্ডের আদি মেঘ চর্চা সমিতির সদস্যসংখ্যা আজ পঁয়ত্রিশ হাজার৷ প্রতিষ্ঠাতা গ্যাভিন প্রিটর-পিনি যখন তাঁর বন্ধু রন ওয়েস্টমাস-কে সঙ্গে করে হাঁটতে যান, তখন চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যতোই সুন্দর হোক না কেন, তাঁরা দেখেন শুধু আকাশের মেঘ৷ ন'বছর আগে গ্যাভিন তাঁর ‘‘ক্লাউড অ্যাপ্রিসিয়েশন সোসাইটি'' বা ‘মেঘ চর্চা সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন৷ সমিতির কাজ হল: ‘‘ক্লাউডস্পটিং''৷
রাইনে প্রকৃতি মিশেছে শিল্পের সাথে
জার্মানির দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে চলেছে রাইন নদী৷ নদীটি শিল্পী এবং প্রকৃতিবিদদের বরাবরই উৎসাহ জুগিয়ে আসছে৷ ১৮ ও ১৯ শতকে নদীর অনুপ্রেরণায় তাই কেউ ছবি এঁকেছেন, কেউ লিখেছেন কবিতা, কেউ আবিষ্কার করেছেন নদীতীরবর্তী অপরূপ দৃশ্য৷
ছবি: Museum Wiesbaden
প্রকৃত চিত্র
১৯ শতকে রাইন জনপ্রিয় স্থানের মর্যাদা অর্জন করে৷ চিত্রশিল্পী, কবি এবং প্রকৃতিবিদদের অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এটি৷ দুর্গ, উপত্যকা আর পাহাড়ে ঘেরা দু’পারের নৈসর্গিক দৃশ্য৷ আন্টন ডিটৎসলার ১৮২০ থেকে ১৮৩০ সালের মাঝামাঝি ‘ভিউ অফ নাসাও’ নামে এই ছবিটি আঁকেন৷
ছবি: Museum Wiesbaden
ডাচ শিল্পীর মডেল
রাইনকে নিয়ে আগ্রহ শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে৷ অর্থ উপার্জনের জন্য ডাচ শিল্পীরা রাইন সফর করেন সে সময়৷ আমস্টারডামভিত্তিক প্রকৃতিবিদরা রাইনের আশেপাশের প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে তাঁদের পাঠিয়েছিলেন৷ এঁদের মধ্যে একজন শিল্পী ছিলেন হ্যারমান সাফটলেভেন৷ তিনি রাইনের প্রকৃত চিত্রের ছবি এঁকেছিলেন৷
ছবি: Ed Restle/Museum Wiesbaden
ভ্রমণ গাইড
রাইনের মধ্যাঞ্চলটি সর্বপ্রথম পর্যটন আর্কষণের কেন্দ্র হয়ে ওঠে৷ অনেক অভিজাত ব্যক্তিরা ১৮ শতাব্দীতে এই নদীতে ভ্রমণ বা ‘ক্রুজ’ করেন৷ ব্যারন ইওহান আইজ্যাক এই স্থানটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন তাঁর ভ্রমণ প্রতিবেদনের মাধ্যমে৷ রিপোর্টে মাইনৎস থেকে কোলন ভ্রমণের বর্ণনা ছিল, যা পরবর্তীতে ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ হয়৷
ছবি: Museum Wiesbaden
সংস্কৃতির ঘটনাপঞ্জি
জলরঙের শিল্পী ক্রিস্টিয়ান গেয়র্গ শ্যুটৎস জুনিয়রের আঁকা ছবিগুলো ভ্রমণচিত্র হিসেবে বিখ্যাত৷ তিনি গ্যার্নিংস-এর ছবি এঁকেছিলেন৷ ১৮ শতকের প্রথমদিকে এই ছবিগুলো আঁকা৷ রাইনের তীরবর্তী প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং ভবনগুলোর প্রকৃত চিত্র ফুটিয়ে তোলায় জোর দেন তিনি৷ রাইনের ধারে একমাত্র দুর্গটি তাঁর কাজের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ছবি: Museum Wiesbaden
দেখার পরের দৃশ্য
ক্রিস্টিয়ান গেয়র্গ শ্যুটৎস সিনিয়রকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ডাচ শিল্পী সাফটলেভেনের স্টাইলের অনুকরণ করার৷ তাই ফ্রাংকফুর্টের এই চিত্রশিল্পী রাইনের রোম্যান্টিক চিত্র ফুটিয়ে তুললেন তাঁর ছবিতে৷ ল্যান্ডস্কেপগুলোতে উষ্ণ, ঘনিষ্ট এবং পার্থিবতা ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Museum Wiesbaden
এল্টভিল গ্রাম
রাইনগাও ওয়াইন এলাকায়, নদীর পাশেই এল্টভিল গ্রামের অবস্থান৷ ১৭৭৪ সালে ক্রিস্টিয়ান গেয়র্গ শ্যুটৎস সিনিয়র এই ছবিটি যখন এঁকেছিলেন, তখন স্থানটি বেশ জনপ্রিয় ছিল৷ যেসব অভিজাত ব্যক্তি ঐ এলাকাটি সফর করতেন তাঁরা জায়গাটির ছবি আঁকার দায়িত্ব দিতেন৷ তাই চাহিদা যত বাড়লো, পরিবারের বাকি সদস্যেরও কাজে লাগিয়ে দিলেন শ্যুটৎস৷
ছবি: Museum Wiesbaden
শিল্পীদের পরিবার
ফ্রাঞ্জ শ্যুটৎসও এমন একজন শিল্পী, যিনি রাইনের ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন৷ ‘স্ট্রুম উন্ড দ্রাং’ মুভমেন্টের প্রতিনিধিও ছিলেন তিনি, যিনি নিজের শিল্প সত্ত্বাকে কল্পনাবিলাসী পথে নিয়ে গেছেন৷ এই ছবিতে ঝড়ের পূর্বে রাইনের ছিত্র ফুটে উঠেছে৷ তাঁর কাজের অন্যতম অনুরাগী ছিলেন ইওহান ভল্ফগাং ফন গ্যোটে৷
ছবি: Museum Wiesbaden
বিলুপ্তি গ্রহণযোগ্য নয়
রাইন নদীকে শুধুমাত্র মানুষের প্রয়োজনে চওড়া করার ফলে এর জলে পরিবেশগত প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়৷ যেমন, ১৮৪০ সালে বিরল প্রজাতির একটি অতিব মাছ নদী থেকে তোলা হয়েছিল৷ এটা ছিল ১০ ফিট লম্বা এবং ৩০০ কেজি ওজনের৷ অথচ বর্তমানে, এমন বহু বিরল প্রজাতির প্রাণীরই বিলুপ্তি ঘটেছে রাইনে৷
ছবি: Museum Wiesbaden
ফনা উৎসব
স্বপ্নবাদী এবং চিন্তাবিদদের মনের খোরাক বরাবর জুগিয়েছে রাইন৷ বিঙ্গেন এবং কোবলেনৎস-এর মাঝামাঝি মধ্য রাইনের সুন্দর আবহাওয়াই এর জন্য দায়ী৷ এ কারণে মধ্য ইউরোপের সর্ববৃহৎ ‘বায়োডাইভার্সিটি’ এখানে অবস্থিত৷ অনেক বন এবং পাথুরে পাহাড় এখানকার প্রাণীদের রক্ষার জন্য খুবই উপযোগী৷
ছবি: Museum Wiesbaden
ভিসবাডেনের সংগ্রহ
ইওহান ভল্ফগাং গ্যোটের উপদেশ অনুযায়ী, ইওহান আইজ্যাক ফন গ্যার্নিং-এর পরিবার তাঁদের কাছে থাকা ঐ শিল্পীর চিত্রকলাসহ সংরক্ষিত নানা বস্তু দান করে৷ পরবর্তীতে ভিসবাডেন শহরে একটি জাদুঘর তৈরি হয়, যেখানে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাইনের ধারে পাওয়া নানা প্রাকৃতিক বস্তু এবং শিল্পকলা স্থান পেয়েছে৷
ছবি: Museum Wiesbaden
10 ছবি1 | 10
গ্যাভিন খানিকটা ঠাট্টা করেই বললেন: ‘‘এ কাজে বিশেষ সরঞ্জাম চাই: দু'টো চোখ আর একটা বিশেষ চারিত্রিক গুণ: পারিপার্শ্বিকের প্রতি নজর দেওয়ার ক্ষমতা৷ না, আমি ঠাট্টা করছি৷ আসলে বিশেষ কিছুরই দরকার পড়ে না৷ শুধু উপলব্ধি করতে হবে যে, সৌন্দর্য আর চমকপ্রদ বস্তু খুঁজে পাওয়ার জন্যে দুনিয়া চষে বেড়ানোর দরকার নেই৷''
রন ওয়েস্টারমাস সমারসেটশায়ারের মাঠেঘাটে মেঘ দেখে বেড়ান৷ অন্যান্য ক্লাউডস্পটারদের মতো তিনিও সাথে ক্যামেরা রাখেন৷ রন-এর পরামর্শ হল: ‘‘সবসময়ে নিজের সাথে ক্যামেরা রাখবেন আর আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটবেন৷ কেননা সাথে ক্যামেরা থাকলে আর আকাশের দিকে চোখ রাখলে ইন্টারেস্টিং কিছু একটা চোখে পড়তে বাধ্য৷ তারপর শুধু ক্লিক করলেই হল: চমৎকার একটা মেঘের ছবি পাওয়া যাবে৷''
একটু কল্পনাশক্তি থাকলে ক্লাউডস্পটারদের ইন্টারনেটে পোস্ট করা ছবিগুলোতে নানা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পাওয়া যায়৷ গ্যাভিন প্রিটর-পিনি এই সব ছবি সংকলন করে একটি বই বার করেছেন৷ গ্যাভিন বলেন: ‘‘মেঘের মধ্যে নানা আকার খোঁজার কোনো অর্থ হয় না৷ সেই কারণেই ওটা একটা মূল্যবান কাজ৷ কেননা আজকের যুগের আধুনিক সমাজ আমাদের বোঝায়, আমাদের সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকা প্রয়োজন৷''
ছুটি কাটাতে চলে যান জার্মানির পর্বতমালায়
জার্মানির একেবারে দক্ষিণে বাভারিয়ার আলপস পর্বতমালায় প্রকৃতি প্রেমীদের উপভোগ করার জন্য রয়েছে অনেক কিছু৷ তাই চলুন, যাওয়া যাক জার্মানির উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গে, হাঁটা যাক আলপস পর্তমালার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে৷
ছবি: Alpenwelt Karwendel
দারুণ অভিজ্ঞতা
জার্মানির সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়া বা পর্বতশৃঙ্গের নাম ‘সুগস্পিৎসে’ যার উচ্চতা ২৯৬২ মিটার৷ সেই সুউচ্চ শিখরে আরোহণের জন্য বেশ কয়েকটি রাস্তা রয়েছে৷ কোনোটা বেশ খাড়া, কোনোটা আবার ততটা দুর্গম নয়৷ যে যাঁর পছন্দমতো যে কোনো একটা পথ বেছে নিতে পারেন৷
ছবি: Bayerische Zugspitzbahn Bergbahn AG, Herbke
সহজ উপায়
তবে একেবারে সহজ উপায়ে, কোনোরকম কষ্ট না করে পর্যটকদের সুগস্পিৎসের ওপরে নিয়ে যাওয়ার জন্য গত ৮০ বছর যাবত রয়েছে দাঁত লাগানো লম্বা একটা গাড়ি বা ট্রেন৷ সেখান থেকে পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় যেতে হলে ব্যবহার করতে হয় বৈদ্যুতিক ‘কেবেল কার’৷
ছবি: Bayerische Zugspitzbahn Bergbahn AG, Jossi
ইচ্ছামতো সাইকেল চালানো
সাইকেল চালকদের জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা, অর্থাৎ পুরো জায়গাটাতেই সুন্দরভাবে সাইকেল চালানোর জন্য সাইনবোর্ড দেওয়া আছে৷ সেইসব মেনে যেভাবে খুশি যেতে পারেন, পারেন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে৷ এভাবে চললে হারিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই৷
ছবি: Alpenwelt Karwendel
পরিবার বান্ধব
৩০০ মিটার এলাকা জুড়ে পরিবারসহ ঘুরে বেড়ানোর জন্য খুবই সুন্দর জায়গা এটি, যেখানে মনের আনন্দে বেশ কয়েকদিন ঘুরে বেড়ানো যায় সবাইকে নিয়ে৷ ছোট-বড় সকলেরই বেশ একটা ‘অ্যাডভেঞ্চার’ হয় এখানে এলে৷
ছবি: Bayerische Zugspitzbahn Bergbahn AG
আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য
এই উপত্যকার ভেতর দিয়ে নীচের হ্রদ পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা প্রায় ১০৬০ মিটার৷ চারিদিকের দৃশ্যও খুব মনোরম৷ এছাড়া, হ্রদের স্বচ্ছ ঠান্ডা পানি গ্রীষ্মের ঝলমলে রোদের দিনে পর্যটকদের সাঁতার কাটতে আমন্ত্রণ জানায়৷
ছবি: Alpenwelt Karwendel
পর্বত আরোহীদের গন্তব্য
যাঁরা পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে উঠতে পছন্দ করেন, তাঁদের কাছেও এই এলাকাটি খুবই প্রিয়৷ বলা বাহুল্য, যাঁদের যথেষ্ট ধৈর্য, সাহস এবং সেই সঙ্গে অভিজ্ঞতা রয়েছে শুধু তারাই এই পাহাড়ের পশ্চিম দিকে ঘোরানো চূড়ায় উঠতে পারেন৷
ছবি: Alpenwelt Karwendel, Hubert Hornsteiner
ওপর থেকে দেখা
অবশ্য আগেই যেমন বললাম, বৈদ্যুতিক ‘কেবেল কার’-এর মাধ্যমেই সবচেয়ে আরাম করে ২৩৪৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছানো যায়৷ দেখা যায় জার্মানির বাভারিয়া আর অস্ট্রিয়ার ট্রিওল-এর অপরূপ দৃশ্য৷
ছবি: Alpenwelt Karwendel
7 ছবি1 | 7
বার্লিন ফ্রি ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া বিশারদ হেনিং রুস্ট-এর কাছে মেঘ দেখাটা শুধু সময় কাটানোর পন্থা নয়৷ তিনি মেঘ দেখে আবহাওয়ার পরিস্থিতি বুঝতে পারেন৷ তিনি জানেন, বিভিন্ন ধরনের মেঘ কী ভাবে তৈরি হয়: ‘‘মেঘ আসলে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা দিয়ে তৈরি৷ সে জন্যই মেঘ আলাদা করে দেখা যায়, যদিও তার চারপাশের বায়ুমণ্ডল সম্পূর্ণ স্বচ্ছ৷ বর্ষার মেঘ কিমিউলাস নিম্বাস উঁচু হয়ে আকাশে উঠে যায়, কিন্তু পাশ থেকে কিংবা দূর থেকে দেখলে তাদের ত্রিমাত্রিক আকারটা বোঝা যায়, হঠাৎ মনে হয়, কোনো কুকুরের মুখ অথবা খরগোশ জাতীয় কিছু একটা দেখছি৷''
‘‘এই সব ছবি দেখলে বোঝা যায়, মেঘের গঠন ও প্রকৃতি কী ভাবে বদলে যাচ্ছে৷ তখন আমার বিশ্বাস হয় যে, কোনো ছবির দোকানে এই সব ছবিগুলো নিয়ে কেরামতি করা হয়নি৷''
গ্যাভিন প্রিটর-পিনি আর রন ওয়েস্টমাস-এর আরো একটা মেঘ চর্চার দিন শেষ হল৷ রন বলেন, ক্লাউডস্পটিং-এর জন্য সব দিনই সুন্দর – যদি না আকাশ পুরোপুরি নীল থাকে৷ আকাশবাতাস কালো করে করে মেঘ আসাটাই যেন সপ্তম স্বর্গ!