২০২১ সালের বিদায় আর ২০২২ সালের আগমনী-ক্ষণের ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এই দুটি লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে বার বার৷
বিজ্ঞাপন
২০২১ সালটা খুব ভালো কেটেছে, বলার উপায় নেই৷ বছরটা শুরু হয়েছিল সারা বিশ্বকে থমকে দেয়া সার্স কোভিড-১৯ ভাইরাসজনিত অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউকে সঙ্গে নিয়ে৷ আগের বছরের ধাক্কা সামলে নিয়ে আমরা তখন কেবল ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছি৷ সারা বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতোই আমাদেরও আশাবাদী করে তুলেছে অভূতপূর্ব দ্রুততার সঙ্গে উদ্ভাবিত করোনার টিকা৷ বছর ঘোরার আগেই সব প্রক্রিয়া শেষ করে একটি-দুটি নয়, অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা টিকা তখন বাজারে আর অন্য অনেক দেশের আগে বাংলাদেশে বেশ গোছানো একটি প্রক্রিয়ায় তা প্রয়োগের ব্যবস্থাও বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে৷ কোভিড অতিমারিকে পেছনে ফেলে এবার এগিয়ে যাওয়ার সময় এলো, তখন এমনটাই মনে হচ্ছিল৷ কিন্তু বছরের শুরুতেই এই ভাইরাসের এক নতুন রূপ এসেছিল নতুন ধাক্কা হয়ে; সবকিছু স্বাভাবিক পথে ফেরানোর চিন্তা শিকেয় তুলে রেখে বাংলাদেশকে দ্বিতীয়বারের মতো হাঁটতে হয়েছিল লকডাউনের পথে৷
তারপর অবশ্য ঠিকই ঘুরে দাঁড়ানোর সময়টা এসেছে, বিশেষ করে অক্টোবরে এসে প্রায় দেড় বছর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া, সীমিত পরিসরে হলেও এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা গ্রহণ আমাদের আশার আলো দেখিয়েছে৷ কিন্তু ২০২২ যখন কড়া নাড়ছে দরজায়, তখন আবার কোভিডের নতুন এক রূপ চোখ রাঙাচ্ছে আমাদের৷ উন্নত বিশ্বের কোনো কোনো দেশকে বেশ নাড়া দিয়ে ওমিক্রন ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশেও, যদিও এখন পর্যন্ত খুব ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে ওঠেনি সেটা৷
অতিক্ষুদ্র, প্রায় অদৃশ্য এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইটা এখনো চলছে৷ সন্দেহ নেই, এই লড়াইয়ে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ অনেক৷ কিন্তু, লাভও কি হয়নি? গত দুই বছরে ঘরবন্দী জীবন আমাদের তো এক রকম ডুবতে ডুবতে সাঁতার শেখার জন্য ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেয়ার মতো করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রযুক্তির মুখোমুখি৷ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা আমরা মুখে বলছি বটে অনেক দিন ধরে; কিন্তু শামুকের গতিতে এগিয়ে চলা সেই রূপকল্পে আমাদের বিরাট একটা লাফ দিয়ে এক ধাপে অনেক দূর এগিয়ে যেতে হয়েছে কোভিড-১৯ অতিমারির প্রভাবেই৷ ঘরবন্দী থেকে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে অফিস-আদালত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছু সীমিত পরিসরে হলেও কীভাবে চালানো সম্ভব, সেই শিক্ষা একেবারে হাতে-কলমে পেয়েছি আমরা৷ বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে এটা আমাদের বিরাট এক সুযোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়ার ব্যাপারটি ২০২০ সালেই শুরু করেছিলাম আমরা; ২০২১ সালে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থাও হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্রচলিত হতে শুরু করেছে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে৷
২০২১ সাল: যে কারণে মনে রাখবেন
নানা কারণেই ২০২১ সাল জায়গা করে নিবে মহাকালে৷ বাংলাদেশসহ বিশ্ব আলাদা করে মনে রাখবে বছরটিকে৷ এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে ছবিঘরে৷
ছবি: Md Rafayat Haque Khan/Zuma/picture alliance
অক্সিজেন সংকট
২০২১ সালের শুরুর প্রান্তিকেই করোনার নতুন ধরন ডেলটার প্রকোপে ভয়াবহ সংকটে পড়ে ভারত৷ অক্সিজেনের জন্য মানুষের হাহাকার, হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম পরিস্থিতি গোটা বিশ্বকে নাড়া দেয়৷ মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত দুই লাখের বেশি মানুষ দেশটিতে প্রাণ হারান৷ পরবর্তীতে অক্সিজেন সংকট ও চিকিৎসা বিপর্যয় দেখা দেয় লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও৷
ছবি: Naveen Sharma/ZUMAPRESS/picture alliance
সবার জন্য কোভিড টিকা
২০২০ সালের শেষ দিকে করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু হয়৷ শুরুতে অগ্রাধিকারপ্রাপ্তদের জন্য সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০২১ এর প্রথম প্রান্তিকেই সবার জন্য টিকা দেয়া শুরু করে দেশগুলো৷ আর বছরের শেষ প্রান্তিকে এসে শুরু হয় তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার প্রদান৷ বাংলাদেশ ২৭ জানুয়ারি প্রথম করোনার টিকাদান শুরু করে৷ ডিসেম্বরের শেষে শুরু হয় বুস্টারও৷
ছবি: Md Rafayat Haque Khan/Zuma/picture alliance
অর্থনীতি পুনরুদ্ধার
২০২০ সালের বেশিরভাগটাই কেটেছে লকডাউনে৷ ২০২১ সালে এসে ঘুরতে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা৷ বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২০ সালের চার দশমিক সাত শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি কাটিয়ে বিদায়ী বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতি পাঁচ দশমিক সাত শতাংশ উর্ধমুখী হবে৷ আইএমএফ এর হিসাবে চলতি অর্থবছরে ৬.৬% প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বাংলাদেশ৷
ছবি: picture alliance / ASSOCIATED PRESS
স্টেডিয়ামে দর্শক
প্রায় দেড় বছর পর স্টেডিয়ামে দর্শকদের সামনে খেলাধুলার আসর শুরু হয় ২০২১ সালে৷ জুনে ওয়েম্বলিতে ইউরো ২০২০ এর ফাইনাল উপভোগ করেন ষাট হাজার দর্শক৷ সংযুক্ত আরব আমিরাতে আয়োজিত হয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ৷ এক বছর অপেক্ষার পর টোকিওতে বসে অলিম্পিকের আসর৷
ছবি: Laurence Griffiths/REUTERS
ক্যাপিটলে রায়ট
৬ জানুয়ারি৷ যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনের জয়ের অনুমোদনের প্রস্তুতি চলছিল কংগ্রেসে৷ তার আগেই ক্যাপিটল হিলে ট্রামপন্থিদের অভূতপূর্ব হামলার ঘটনাটি ঘটে৷ একজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ পাঁচজন সেই রায়টে প্রাণ হারান৷ অভিশংসনের মুখোমুখি হন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷
ছবি: Brent Stirton/Getty Images
সরকার বদল
ট্রাম্প অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন জো বাইডেন৷ ১৬ বছরের শাসনভার ছেড়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ সেপ্টেম্বরের চ্যান্সেলর নির্বাচনের পর দেশটিত গঠিত হয় নতুন জোট সরকার৷ ম্যার্কেলের স্থলাভিষিক্ত হন সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস৷ বছরের শেষদিকে ৩৫ বছরের বামপন্থি গাব্রিয়েল বরিস চিলির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন৷
ছবি: Fabrizio Bensch/REUTERS
বিশ্ব রাজনীতি
ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা৷ মে মাসে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের হামাসের মধ্যে চলে ১১ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ৷ আগস্টে আফগানিস্তান থেকে সবশেষ সেনা গুটিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো৷ ২০০১ সালের পর আবারো ক্ষমতা দখলে নেয় তালেবানরা৷ অক্টোবরে সুদানের প্রধানমন্ত্রীকে বন্দি করে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী৷
ছবি: Wakil Kohsar/AFP/Getty Images
পরিবেশ বিপর্যয় ও কপ ২৬
২০২১ সালে অস্বাভাবিক দাবানলে পুড়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা, তুরস্ক৷ অভূতপূর্ব বন্যা দেখা দিয়েছে চীন, জার্মানিতে৷ এমন বাস্তবতায় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হয় জাতিসংঘের ২৬তম জলবায়ু সম্মেলন৷ সেখানে কার্বন নির্গমন দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে সম্মত হয় সব দেশ৷ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP POOL
বাংলাদেশের ৫০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের অর্ধশত বছর পূর্তি ছিল ২০২১-এ৷ মার্চে ঢাকায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে অংশ নেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা৷ মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তখন ব্যাপক বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে৷ পরে হেফাজতে ইসলামকে দায়ী করে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের গ্রপ্তার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷
ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP Photo/picture alliance
এলডিসি থেকে উত্তরণ
চলতি বছর বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ৷ এর মধ্য দিয়ে তিনটি শর্তের সবকটি পূরণ করে ২০২৬ সালে এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বের হবে বাংলাদেশ৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ কান চলচ্চিত্র উৎসবের আঁ সার্তে রিগা ক্যাটাগরিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিদায়ী বছরে৷ বাংলাদেশ থেকে কোনো চলচ্চিত্র কানের মূল মঞ্চে জায়গা করে নেয়ার এটি প্রথম ঘটনা৷ ২০২১ সালের র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী৷ যুক্তরাষ্ট্রের নাসার স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে ‘বেস্ট মিশন কনসেপ্ট’ ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশের একটি দল৷
ছবি: Zbaer Ahmed/DW
সাম্প্রদায়িক হামলা
কুমিল্লায় দুর্গাপূজার একটি মণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরীফ পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে৷ ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় আটটি মন্দিরে হামলার পর ২৩ জেলায় শতাধিক মন্দির ভাঙচুর হয় ও চারজন মারা যান৷ ১৭ অক্টোবর রংপুরের পীরগঞ্জে তিনটি গ্রামে হামলাকারীদের দেয়া আগুনে পুড়ে যায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি৷ মণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার অভিযোগে ইকবাল হোসেন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷
ছবি: bdnews24.com
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
১২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানবাধিকারের লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের ব়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (ব়্যাব) ও এর সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়৷ ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় পুলিশের বর্তমান প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে৷ এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ঢাকা৷ মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
ছবি: Getty Images/AFP
পানিতে পুড়ে মৃত্যু
২৪ ডিসেম্বর ঝালকাঠিতে সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী একটি লঞ্চে বিস্ফোরণের পর ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে৷ হাজারো যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন৷ মধ্যরাতের অগ্নিকাণ্ডে নদীতেই পুড়ে মারা যান অন্তত ৪০ জন৷ তাদের অনেকেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ছুটি কাটাতে রওনা হয়েছিলেন৷ বাংলাদেশে বছরের শেষটা ছিল এমনই মৃত্যুর বিষাদে৷
ছবি: AFP
যাদের হারালাম
২০২১ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন বাংলাদেশের কবরী, ওয়াসিম, এটিএম শামসুজ্জামান, ফকির আলমগীর, ড ইনামুল হক, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, মওদুদ আহমেদ, রাবেয়া খাতুন ও হাসান আজিজুল হক৷ বুদ্ধদেব গুহ, শঙ্খ ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, দিলীপ কুমার, মিলখা সিংয়ের মতো গুণীজনদের হারিয়েছে ভারত৷ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাংবাদিক ল্যারি কিং, প্রিন্স ফিলিপ ও সম্প্রতি ডেসমন্ড টুটুর মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছে বিশ্ব৷
ছবি: AP/picture alliance
নতুন ধাক্কা ওমিক্রন
২০২১ সালকে খুব একটা স্বস্তিতে বিদায় জানাতে পারছে না বিশ্ব৷ বছরের শুরুর অর্ধেক বিশ্বকে বিপর্যস্ত করেছে ডেলটা, শেষটা হচ্ছে ওমিক্রনে৷ করোনার নতুন এই ধরন ঠেকাতে বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, আরোপ করা হচ্ছে লকডাউন৷ তার মধ্যে বেড়ে চলছে জনরোষও৷
ছবি: Pavlo Gonchar/Zumapress/picture alliance
16 ছবি1 | 16
সন্দেহ নেই, এই ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেকটাই পিছিয়ে আছি৷ অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা চালু করেছে বটে; কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণ থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে রয়েছি৷ এর পেছনের মূল কারণ কিন্তু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা নয়; বিশ্বায়নের যুগে এসে প্রযুক্তির ব্যবহারের সুযোগ আসলে অনেকটাই উন্মুক্ত৷ সমস্যার জায়গাটি ভাবনায়, দর্শনে৷শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রয়োগ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে হলে আসলে বদলাতে হবে ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষা দর্শন৷ একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই- বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১ সালে শিক্ষার্থীদের কোর্স ফাইনাল পরীক্ষা গ্রহণ করেছে অনলাইনে৷ কিন্তু সেই পরীক্ষাটি আসলে ছিল দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত পরীক্ষারই একটি সংস্করণমাত্র, যেখানে মুখস্ত প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীর মেধার মূল্যায়ন করা হয়৷ কিন্তু তারচেয়েও ভালো হতো, যদি মূল্যায়নের পদ্ধতিটি বদলানো হতো, পরীক্ষার বদলে শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোগ্রাফ রচনা কিংবা অর্জিত জ্ঞানের প্রায়োগিক ব্যবহারভিত্তিক টেক-হোম অ্যাসাইনমেন্ট রচনার দায়িত্ব দিয়ে কাজটি করা হতো৷ বিশ্বের অনেক দেশে অনেক আগে থেকেই এই পদ্ধতি প্রচলিত, ফলে এই অতিমারিকালে অনলাইন শিক্ষাপদ্ধতির ব্যবহারে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি৷ অতিমারি আমাদের সামনে সম্ভাবনার নতুন এক দূয়ার খুলে দিয়েছে, আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এক ধাক্কায় পানিতে পড়ে সাঁতার শেখার মতো করেই জুম ও গুগল ক্লাসরুমের মতো লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছে, এগুলো ব্যবহার করতে শিখেছে৷আমাদের দেশেও এ ধরনের সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে৷ আশা করি করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ২০২২ সালকেও ২০২১ সালের মতো থমকে দেবে না, খুলে যাওয়া স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আর বন্ধ হয়ে যাবে না; কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্যি, স্বশরীরে ক্লাসে ফেরা শিক্ষার্থীরা এই দুই বছরে প্রযুক্তির যে জ্ঞান হাতে কলমে অর্জন করেছে, তাদের সেটা ভুলে যেতে দেয়া উচিৎ হবে না৷
তাছাড়া এই দেড় বছরের থমকে থাকা সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটাও তো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে! নতুন বছরের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে অতিমারিতে হারিয়ে ফেলা সময়ের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া, সেশনজটকে যতোটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনা৷ সেজন্য অনলাইন ও অফলাইন দুই পদ্ধতিতেই শিক্ষা দান অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই৷ গত দেড় বছরে অনলাইনে শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে শহর আর গ্রামে বসবাসরত শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সে অসমতা ছিল, নতুন বছরে আশা করি সেই ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ দূর করার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে৷ সে জন্য সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন, কিন্তু আমরা, যারা শিক্ষাঙ্গনে কাজ করছি, তাদের কাছেও প্রত্যাশা কম নয়৷২০২১ সালে যে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে, আমার বিশ্বাস, ২০২২-এ সেটাকে কাজে লাগানোর সত্যিকারের একটা পথ আমরা বের করতে সক্ষম হবো৷
শিক্ষা-ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দায় আসলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি৷ নানা কারণে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সামনে একটা বিরাট সুযোগ, বিপুল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের মহাস্রোতে শামিল হওয়া৷ সেই পথে আমাদের যাত্রা কিন্তু থেমে নেই৷২০২২ সালে এ রকম বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবে রূপ পাওয়ার কথা৷ স্বপ্নের পদ্মা সেতু, ঢাকার মেট্রো রেল ব্যবস্থা আর নদীর তলদেশ দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম টানেলপথ কর্ণফুলী টানেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার কথা এই বছরে৷ কিন্তু এই প্রকল্পগুলোয় কারিগরী সহায়তার জন্য আমাদের সম্পুর্ণরূপে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে৷ শুধু তা-ই নয়, শুনতে পাই ঢাকার অনেক বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পদগুলোও নাকি বিদেশি কর্মীদের দখলে৷ আমাদের অদক্ষ শ্রমিকেরা বিদেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন, তার বেশ বড় একটা অংশ চলে যায় এই বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা হিসেবে৷ এর কারণ, আমাদের দেশে দক্ষ কর্মীর অভাব৷ রাতারাতি এই অবস্থার পরিবর্তন তো আর সম্ভব নয়, ২০২২ সালেই পরিস্থিতি পুরো পাল্টে যাবে, এমন আশা করা উচিৎ হবে না৷ তবে শুরুটা তো হতে পারে! আশা করি এই বছরে আমরা অন্তত সঠিক পথটাকে চিহ্নিত করতে পারবো, যেন আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ডিগ্রিধারী বেকার তৈরি না করে সত্যিকারের দক্ষ কর্মী তৈরি করতে পারে৷
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যাত্রা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে, তার ঢেউ এসে লাগতে শুরু করলে আমাদের শ্রম-ঘন অর্থনীতির অবস্থা কী হবে, তার একটা অনুমানভিত্তিক পরিসংখ্যান তো অন্তত থাকা উচিৎ! সেই অনুমান এবং তার ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণের কাজটুকু অন্তত শেষ হবে, আমরা সেই অনুযায়ী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর অন্তত শুরু করবো, এটাই প্রত্যাশা৷
তার মানে কিন্তু এই নয় যে আমাদের নতুন প্রজন্মকে কেবলই প্রযুক্তির জ্ঞান বা দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করতে হবে৷শিক্ষার আরেকটি উদ্দেশ্য মানুষকে মানবিক করে গড়ে তোলা৷ ২০২১ সালের বাংলাদেশে এই জায়গাতেও যথেষ্ট ঘাটতি চোখে পড়েছে; পূজোর মণ্ডপে ভাঙচুর, জেলে-পাড়ায় আগুন দেয়ার মতো অমানবিক ঘটনা ঘটতে দেখেছি, দেখেছি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতায় লঞ্চডুবি বা লঞ্চে-কারখানায় আগুন লেগে মানুষের নির্মম মৃত্যুর ঘটনা৷ আশা করি ২০২২ সালে আমরা এমন মানবিক ও দায়িত্ববান হয়ে ওঠার সুযোগ পাবো, যে এই সব অমানবিক ঘটনার কোনো জায়গা থাকবে না আমাদের চোখের সামনে৷
বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশ
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বিভিন্ন বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশকে দেখলে দুটি বিষয় স্পষ্ট৷ এক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন৷ দুই. গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের অধঃপতন৷ চলুন দেখা নেয়া যাক, কোন সূচক কী বলছে৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার৷ ভারতের হবে ২ হাজার ১১৬ দশমিক ৪৪৪ ডলার৷ ফলে মাথাপিছু আছে পরপর দুই বছর ভারতকে ছাড়িয়ে গেল বাংলাদেশ৷
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
শান্তি সূচকে ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে ভালো, তবে...
‘ভিশন অব হিউম্যানিটির’ প্রকাশিত বৈশ্বিক শান্তি সূচক ২০২১ অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১৬৩টি দেশের মধ্যে ৯৮ তম৷ একই সূচকে ভারতের অবস্থান ১৩৫ তম, পাকিস্তানের ১৫০৷ দশ বছর আগের তুলনায় বাংলাদেশ এই সূচকে এগিয়ে গেলেও গত কয়েক বছরের তুলনায় তা পড়তির দিকে৷
ছবি: AFP/Getty Images
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকেও ভারত, পাকিস্তানের চেয়ে ভালো বাংলাদেশ
কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ও ভেল্ট হাঙ্গার হিলফের যৌথভাবে প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২১-এ বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬টি দেশের মধ্যে ৭৬তম৷ একই সূচকে ভারতের অবস্থান ১০১তম, আর পাকিস্তানের ৯২তম৷ গত কয়েকবছরে এক্ষেত্রে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ৷
ছবি: Thomas Trutschel/Imago Images
রেমিটেন্সে সেরা দশে বাংলাদেশ
২০২১ সালে বাংলাদেশের রেমিটেন্স আসার পরিমাণ ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক৷ গতবছরের তুলনায় যা ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি৷ রেমিটেন্স প্রাপ্তির হিসেবে বিশ্বের সেরা ১০টি দেশের মধ্যে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ৷ ভারত ও পাকিস্তান অবশ্য এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে৷
ছবি: dapd
মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি গত কয়েকবছর ধরে ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন দাবি করে আসছে৷ মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্প্রক্ত থাকার দায়ে সম্প্রতি বিশেষ পুলিশ বাহিনী ব়্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nath
বাকস্বাধীনতা পড়তির দিকে
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫২তম৷ ২০২০ সালে এই অবস্থান ছিল ১৫১তম, আর ২০১৯ সালে ১৫০তম৷ বিতর্কিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করছে বলে দাবি রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
গণতন্ত্রের করুণ দশা
সুইডেনের স্টকহোমভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স (আইডিইএ) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার’ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি৷ দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির সর্বশেষ দুটি জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক ছিল না বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী মনে করে৷