মেডিক্যালের ভোটে কেন লড়তে পারল না তৃণমূলপন্থি সংগঠন?
৩ জুন ২০২৫
আরজি কর আন্দোলনের সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলেছিলেন আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকরা। মুখ্যমন্ত্রী এবং মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকেও সেই দাবি তুলে ধরেছিলেন তারা। মার্চ মাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা থাকলেও তা পিছিয়ে যায়। অবশেষে মেডিক্যাল কলেজের ভোটে দেখা গেল, শাসক শিবির ভোটই লড়তে পারল না।
মেডিক্যালে নির্বাচন
মেডিক্যালে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ২০ আসনে ভোট নেয়া হয় সোমবার। ভোটে একতরফা জয় পেয়েছে মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বা এমসিডিএসএ। সব আসনে লড়ে তারা পেয়েছে ১৭টি আসন। ডিএসও জয়লাভ করে একটি আসনে। বাকি দুটো আসনে জয় পেয়েছেন দুই নির্দল প্রার্থী। এই নির্বাচনে ভোটদাতা ছিলেন এক হাজার। ভোট পড়ে ৭৮ শতাংশের মতো। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কোনো প্রার্থী লড়াইয়ে ছিলেন না। তারা এটাকে নির্বাচন বলেই মানতে চায়নি। তাদের দাবি, স্বাস্থ্য ভবন এই ভোটকে স্বীকৃতি দেয়নি। একতরফাভাবে নির্বাচন করা হয়েছে তাই তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
মেডিক্যালে ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ঘিরে বিরোধ পরিস্থিতি দীর্ঘ দিনের। ২০২২ সালে ছাত্রছাত্রীদের একাংশ এনিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। নির্বাচন চেয়ে কয়েকজন অনশনে বসেন। তা সত্ত্বেও অচলাবস্থা না কাটায় পড়ুয়ারা ঘোষণা করেন, ভোট তারা নিজেরাই করবেন। তখনো ভোটের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুণিজন সেই নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। এই ভোট তার সুবাদেই মান্যতা পায়।
আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের পর ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা চিকিৎসক পড়ুয়ারা গড়ে তোলেন জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট। এই সংগঠনের দুই প্রধান মুখ দেবাশিস হালদার ও অনিকেত মাহাতো মেডিক্যালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। দেবাশিস এমসিডিএসএ-র ও অনিকেত ডিএসও-র সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও উভয় বলেছেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে।
মেডিক্যাল কমিশনের সুপারিশ
এই নির্বাচন প্রসঙ্গে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের পক্ষে ডা. অর্জুন দাশগুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "কলেজ কাউন্সিল এই নির্বাচন বাধ্য হয়ে করিয়েছে। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের একটা সুপারিশ হচ্ছে, ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন হতে হবে। সেটা না করলে তাদের অ্যাফিলিয়েশন কাটা যেতে পারে। সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে ছাত্র নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রত্যেকটা মেডিক্যাল কলেজেই এই ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন হওয়া উচিত। আমরা সিনিয়াররা সেটাই চাই। আমরা মনে করি, আরজি করে যদি ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন হতো, তাহলে হয়তো চিকিৎসককে প্রাণ হারাতে হত না।"
তিনি বলেন, "আমাদের একটা বড় দাবি ছিল, এরপর থেকে আর কোনো অভয়ার ঘটনা ঘটতে দেয়া যাবে না। যদি ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন হতো, তাহলে থ্রেট কালচারের এত রমরমা হত না। "
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের প্রস্তাব যদি থাকে, তাহলে এতদিন ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন হতো না কেন? মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র চিকিৎসক অর্ণব তালুকদার ডিডাব্লিউকে বলেন, "লিংডো কমিশন সুপারিশ করেছিল, ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন করালে অনেক রকম সমস্যা হয়, কলেজের পঠনপাঠনে জটিলতা তৈরি হয়। এর পরিবর্তে তারা বাছাই ছাত্রদের নিয়ে স্টুডেন্ট কাউন্সিল করার পরামর্শ দেয়। সেই সুপারিশ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন জায়গায় ইউনিয়ন নির্বাচন তুলে দিচ্ছে। এমনকী আমাদের রাজ্য সরকার জোর করে বন্ধ করে রাখছে ইউনিয়ন নির্বাচন। আরজিকর আন্দোলনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে মুক্ত পরিবেশের জোরদার দাবি উঠেছিল। সেই দাবি এতটাই জোরদার ছিল যে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত জুনিয়র ডাক্তারদের সাথে মিটিংয়ে বলতে বাধ্য হন যে, ২০২৫-এর মার্চের মধ্যে ইউনিয়ন নির্বাচন করাবো।"
কিন্তু এই সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও ভোট হয়নি। অর্ণব বলেন, "নির্বাচন করাতে রাজ্য সরকার বা কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ দেখা যায়নি। আমরা যখন মেডিক্যাল কলেজে একটা নির্বাচন করাতে চাইছি, একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্টুডেন্ট কাউন্সিল তৈরি করতে চাইছি, (স্টুডেন্ট ইউনিয়ন নয়) সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে, সেই উদ্যোগ সরকার বানচাল করার নানা চেষ্টা করেছে। স্টুডেন্ট কাউন্সিলের এই নির্বাচনের মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ কাউন্সিল দিতে পারছে, সেই পরিবেশটুকুই অন্য কোথাও নেই। অন্য কোথাও ভোট পর্যন্ত হতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ছাত্র পরিষদ আমরা তৈরি করতে পেরেছি। একটা ছাত্র আন্দোলনের চাপে এখানে কলেজ কর্তৃপক্ষ ভোট করাতে দিতে বাধ্য হয়েছে। এই গণতন্ত্রের চর্চা হোক সমস্ত জায়গায়।"
গণতন্ত্রের প্রশ্ন
এই নির্বাচনে অংশ না নেয়া প্রসঙ্গে শাসকপন্থী সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "এই নির্বাচন সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে হচ্ছে, তাই তৃণমূল ছাত্র পরিষদ যোগ দেয়নি। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের গাইডলাইন মানেননি অধ্যক্ষ। আমরা তার পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। আমরা নতুন করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি। সেটা যেন কলেজ কাউন্সিলের নিয়ম মেনে হয়। সোমবারের নির্বাচন নিয়ে কলেজ কাউন্সিল মিটিংয়ে আলোচনা হয়নি। অধিকাংশ কাউন্সিল সদস্য এ বিষয়ে জানতেন না।"
শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের যুক্তিকে আমল দিচ্ছেন না ডা. তালুকদার। তিনি বলেন, "এটা ছেঁদো যুক্তি। আর জি কর আন্দোলনের পর ওদের দুর্নীতি, থ্রেট কালচার যেভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে চলে এসেছে, তাতে ওরা ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে । ওরা ভোটে দাঁড়াতে লজ্জা পাচ্ছে। তাই ভোটে দাঁড়াতে পারেনি। কলেজে কাল ৭৮ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী ভোট দিয়েছে। এখন নির্বাচনকে বানচাল করার কুযুক্তি তারা দিচ্ছে।"
মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. তরুণ মণ্ডল ডিডাব্লিউকে বলেন, "তৃণমূলের সংগঠন যে লড়তে পারলো না, সেটা তাদের শক্তি কমে গিয়েছে বা তারা জানতে পারেনি, সেজন্য নয়। এসব ভুয়ো কথা বা অছিলা। আসলে আরজি করের অভয়াকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন, তার মাধ্যমে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের স্বরূপ ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক সবার কাছে উন্মোচিত করেছে। সেখানে তাদের পায়ের নিচে আজ দাঁড়ানোর জমি নেই বলেই তারা মনোনয়ন দিতে পারেনি।"
লোকসভার সাবেক সদস্য তরুণ বলেন, "নইলে তারা তো বলতে পারতো, এই কাউন্সিলকে স্বীকার করি না। তাদের পয়সার অভাব নেই, অভয়ার কেসের সময় কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সুপ্রিম কোর্টে লড়েছে। তারা হাইকোর্টে গিয়ে একটা মামলা ঠুকতে পারত না কি যে, এই কাউন্সিল অগণতান্ত্রিক। আসলে মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের পপুলার সাপোর্ট শাসক দল নিজেদের দিকে আনতে পারছে না। এটাই তাদের দুর্বলতা। "
তিনি বলেন, "এবার যারা জিতেছে অর্থাৎ এমসিডিএসএ বা ডিএসও, তারা রাজ্যের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে না, তারা ক্ষমতায় নেই। রাজ্যের রাজনীতির মুখ্য চরিত্রে যারা নেই, তারা সন্ত্রাস করবে কী করে? অগণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করবে কীভাবে? এটা শাসক দলের হাস্যস্পদ অভিযোগ।"
অতীতে মেডিক্যালের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী, অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র। সোমবারের নির্বাচনে একটি শিবিরের অংশ নিতে না পারা কি গণতন্ত্রহীনতাকে প্রকাশ করলো না? অম্বিকেশ ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমি আগেও দেখেছি মেডিক্যাল কলেজে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল। গত বছর আগস্ট মাসে আরজি করের ঘটনা প্রমাণ করে, মেডিক্যাল শিক্ষায় এবং হাসপাতালে পরিষেবার প্রশ্নে প্রচুর দুর্নীতি জড়িয়ে আছে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রাজ্যের শাসক দল সম্পর্কে অত্যন্ত খারাপ ধারণা তৈরি হয়েছে। শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের হয়ে কথা বলার মতো আর কোনো মুখ থাকছে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শুধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নয়, সমস্ত সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় যদি ঠিক মতো নির্বাচন হয়, তাহলে সর্বত্রই রাজ্যে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।"
শাসক দল মেডিক্যাল কলেজের নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে পারেনি। এক বছর পরে বিধানসভা ভোটে এর কোনো প্রভাব থাকতে পারে কি, যেহেতু আরজি করের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সিনিয়র সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র নির্বাচন দিয়ে বিধানসভা নির্বাচন বোঝা যাবে না। কিন্তু এরকম একাধিক বার ঘটতে থাকলে তাহলে সেটাকে একটা ইঙ্গিত বলে ধরা যেতে পারে।"