1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মেধার কম বেশি বনাম পেশার পেশি

২৩ এপ্রিল ২০২১

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১১৫ বছর আগে ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘আজ বাংলাদেশে উত্তেজনার অভাব নাই, সুতরাং উত্তেজনার ভার কাহাকেও লইতে হইবে না৷’ 

বাংলাদেশ সচিবালয়
বাংলাদেশ সচিবালয়ছবি: bdnews24.com

এই উত্তেজিত চরিত্রের জন্যই বোধহয় বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে বাসের মধ্যে লেখা থাকে, ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’৷ এই উত্তেজনা সবখানে এখন বেড়েছে, বাড়ছে৷ ভাইরাল হওয়ার অবারিত সুযোগে উত্তেজিত ব্যবহারের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা এখন রবীন্দ্র যুগের চেয়ে অনেক ধারালো৷ সম্প্রতি ঢাকার রাস্তায় ধারণ করা এমনই একটি উত্তেজিত আচরণের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে যেখানে দেখা গেছে কয়েকজন পুলিশ ও একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে এক চিকিৎসকের উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা৷ পেশাজীবীদের উত্তেজিত ব্যবহারের এই ভিডিও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির পেশাজীবীদের নৈতিকতা এবং পরিশীলিত আচরণের বাধ্যবাধকতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে৷ সরকারি কর্মকর্তাদের অযাচিত ক্ষমতা প্রদর্শন যে নিয়ত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সেই চিত্রও এই ঘটনায় ফুটে উঠেছে৷

ঘটনার ধারাবাহিকতায় এটি স্পষ্ট যে, পেশাগত অহমিকা প্রকাশ করতে গিয়ে পেশাজীবীদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের রাজনৈতিক প্রকাশ ও আত্মপরিচয় সংকটের প্রবণতা দৃশ্যমান৷ আত্মপরিচয় এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি কিংবা সমষ্টির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য যেমন—নৃতাত্ত্বিক, জাতিগত, ধর্মীয় বা পেশাগত চর্চার মাধ্যেম নির্দিষ্ট পরিচয় নির্ধারিত হয়৷ এখানে ব্যক্তির সত্তাকে একটি সামগ্রিক পরিচয় দিয়ে তুলে ধরা হয়৷ সমস্যা হলো, এই সামগ্রিক পরিচয়ের সত্তা যখন অহংবোধে পরিণত হয় তখন সমসাময়িক অন্য পরিচয়গুলোকে তাচ্ছিল্য করা হয়৷ এক জাতি অন্য জাতির মানুষকে, এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মাবলম্বীকে কিংবা এক পেশাজীবী গোষ্ঠী অন্য পেশাজীবীদের হীন দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করে৷ যেমনটা আমরা ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে দেখেছি৷ অন্যের চেয়ে নিজেকে ঢের সেরা হিসেবে উপস্থাপনের এই প্রতিযোগিতা ক্রমেই একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা পেশার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করে যে, ‘আপনার’ স্বতন্ত্রতার চেয়ে ‘আমার’ বিশেষত্ব অনেক উঁচুদরের৷

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে চোখ দিলে বুঝা যাবে, এই ধরনের ঘটনাবলী বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা বা ইস‌্যু নয়৷ দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসক পুলিশকে অপমান করছে, পুলিশ রাজনীতিবিদদের হয়রানি করছে, রাজনীতিবদ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গালমন্দ করছে, সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা নিরীহ জনগণকে শাসাচ্ছেন৷ অর্থাৎ প্রত্যেকে তার নিজ নিজ জায়গা থেকে ক্ষমতার প্রদর্শন করছেন৷ অর্মত্য সেন তাঁর ‘পরিচিতি ও সহিংসতা’ বইতে বলেছেন, প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বিভিন্ন পেশার মানুষের এই রাজনৈতিক পরিচিতির বহিঃপ্রকাশ দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অসততা আর দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার ফল৷ এটি মানুষের মানবিক জীবনযাপনকে ধীরে ধীরে তার সুষ্ঠু জীবনব্যবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়৷ আত্মপরিচয়ের এই অহংবোধ এবং অন্যায্য চর্চার রাজনীতিক রূপটি যে অসম মানব ব্যবস্থা তৈরি করছে তাতে দেখা দিচ্ছে সংঘাত, বাড়ছে দূরত্ব৷ আত্মপরিচয়ের অহমিকায় ভোগা মানুষগুলোর জন্য দার্শনিক এরিক ফর্ম বলেছিলেন, ‘জন্মের আগেই অনেক মানুষ মারা যায়’৷

অপরিশীলিত বচসা ও উত্তেজিত ব্যবহারের পেছনে দায়ী বড় কারণটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িত৷ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একদিকে যেমন নৈতিকতার শিক্ষার উপস্থিতি খুবই নগণ্য অন্যদিকে এ ব্যবস্থাটি সকল শিশু ও শিক্ষার্থীকে এক চোখে দেখে না৷ মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বন্টনের নামে যে বিভাজন আমরা তৈরি করি তার প্রভাব পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে দেখো যাচ্ছে৷ পুরো দেশের কর্মশক্তিকে অঙ্কুরেই ভাগ করে ফেলছি ‘কম মেধাবী' ও ‘বেশি মেধাবী’ দুই ভাগে৷ এই বিভাজনের কারণে প্রশাসনে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য বাড়ছে৷ প্রত্যেক সংস্থা বা পেশার লোক নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে৷ জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক অনেক আগেই এভাবে ‘এক জাতির মধ্যে দুটি জাতি সৃষ্টি করা’ হচ্ছে বলে সাবধান করে গিয়েছেন৷ আমাদের প্রাথমিক থেকে ‍উচ্চশিক্ষা সব স্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা এমন যে, পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর পেয়েও প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারছে না৷ পুষ্টিকর খাদ্য যেমন সুখাদ্য তেমনি শিক্ষাকে হতে হয় মানসম্মত সুশিক্ষা৷ এই সুশিক্ষার অভাবে আমরা এখন আখতার হামিদ খানের মতো প্রশাসক কিংবা অধ্যাপক ইব্রাহিমের মতো চিকিৎসক আর পাচ্ছি না যাদের কাছে নিজের পেশাগত পরিচয়ের চেয়ে মানুষের সম্মানটা বড় ছিল৷ নিম্নমানের শিক্ষা দিয়ে নানা কায়দায় অর্থ কামানো যায়, গাড়ি-বাড়ি হাঁকানো যায়, কিন্তু যোগ্য ও উন্নত মানুষ হওয়া যায় না৷ বাংলার ভূখণ্ডের যে সামাজিক আচার ও রীতিনীতি তার নৈতিক বৈশিষ্ট্য হলো অহিংসা, ভ্রাতৃত্ববোধ, অন্যের প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ৷ কিন্তু আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত উভয় ধরনের শিক্ষায় এসব নৈতিক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি নেই বললেই চলে৷ সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর এক নিবন্ধে বলেছিলেন, নির্বিচারে জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ যদি উনিশ শতকে থাকত, তাহলে মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র, জগদীশ বসু তো দূরের কথা আক্কেল আলী বেপারীর মতো লেখকও আমরা পেতাম না; বাঙালি জাতি পড়ে থাকত মধ্যযুগে৷

এ ধরনের আচরণের জন্য দায়ী আরেকটি কারণ হলো পেশাজীবীদের রাজনৈতিক আনুগত্য৷ বাংলাদেশের পেশাজীবীরা দলীয় রাজনীতির সিন্ডিকেটের অংশ হয়ে গেছেন৷ শুধু চিকিৎসক বা সাংবাদিক নয়, শিক্ষক-আইনজীবী-ইঞ্জিনিয়ার-আমলাতন্ত্রসহ শিল্পী-লেখক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও দলীয় রাজনীতির অংশ এখন৷ সুষম গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অভাবে সরকারের সবচেয়ে কাছের বাহিনী বা সংস্থা হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত রাষ্ট্রের সংস্থাগুলো৷ যারা পারছে না, তারা পেশাজীবী হিসেবে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় শক্ত করার চেষ্টা করছে, রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করছে৷ প্রশাসনে অন্যায় করেও পার পেয়ে যাওয়ার মূল উপায় যখন আনুগত্য তখন তার চর্চা তো বাড়বেই৷ মানুষের শরীরের নানা অঙ্গের মতো যে কোন আদর্শ সমাজে সব পেশাজীবীর অবদান সমান গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয়৷ কারণ সমাজের সফলতার জন্য সকলের সমঅংশগ্রহণ দরকার৷ বাংলাদেশের প্রতিটা শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি আছে৷ দুর্নীতি, অনিয়ম আর রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে গড়ে উঠা ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থায় আন্তঃপেশা সঙ্কট আরও বাড়বে৷ 

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ছবি: bdnews24.com

মধ্যবিত্ত শ্রেণী আমাদের সমাজের আয়না৷ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বভাব-চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে কোনো জাতিকে বিচার করতে হয়৷ একটা সমাজের চরিত্রের রূপ নির্ধারণ করে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী৷ তাই মানবিক গুণসম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছাড়া ভালো সমাজ আশা করা যায় না৷ মানবিক গুণসম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী একদিনে তৈরি হয় না৷ এর জন্য জাতির শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, পাবলিক সার্ভিসসহ সবকিছুতে একটা ন্যূনতম মান বজায় রাখতে হয়৷ মানুষ প্রথমে অভ্যাস তৈরি করে তারপর সে অভ্যাসের দাস হয়৷ আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে পেশাগত মানদণ্ড অনুসরণ করে নিজ নিজ কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে জনসেবা করা নয়; বরং আত্মীয়তা, আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করা৷

গ্রাম বাংলায় একটা কথা আছে, জঙ্গলের জন্য গাছ দেখা যায় না৷ অর্থাৎ বড় কোনো গাছের চারদিকে আগাছা ও ঝোপঝাড় থাকলে গাছটিকে দেখা যায় না বা তার বিরাটত্ব চোখে পড়ে না৷ যার অর্থ হলো, আবর্জনা ভালো জিনিসকে ধোঁয়াটে করে দেয়৷ নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থা আর সবকিছুতে রাজনৈতিক আনুগত্য আমাদেরকে আগাছা রূপী জঙ্গল উপহার দিচ্ছে৷ মহামারির সময় চিকিৎসক-পুলিশ-সাংবাদিক-মাঠের সরকারি কর্মকর্তা সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে যে অবদান রাখছে তা মানব জাতিকে আজীবন মনে রাখতে হবে৷ কিন্তু পেশাগত অহংবোধে সৃষ্ট উত্তেজনা আর দূরত্ব এবং সংঘাত মহামারির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধকে কঠিন করে তুলবে৷ বাংলায় একটি প্রবচন আছে, ‘গড়ানো বাঁশ পাকে না'৷ বর্ষাকালে বাঁশের গোড়া থেকে কোড়ল বা কচি বাঁশ বের হয়৷ এগুলোর কোন কোনটি অনেক উঁচু হয়ে কাত হয়ে পড়ে যায়৷ এরপর আর বড়ও হয় না, পাকেও না৷ কোনো দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতায় ভেঙে পড়লে তার অবস্থা গড়ানো বাঁশের মতো হতে বাধ্য, সেখানে তখন জোর যার মুল্লুকই মূল সার হবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ