এককালে আর্য-অনার্যের বর্ণভেদ থেকে যে অবিচার, অনাচার, বস্তুত মানসিক ও মানবিক বিকারের সূচনা, আমার ক্ষেত্রে সেটা একটা বিষম ধাক্কা খায় আজ থেকে ৩৩ বছর আগে এক শ্বেতাঙ্গিনীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে...৷
বিজ্ঞাপন
বাংলা অভিধান ঘেঁটে দেখলাম, ‘কৃষ্ণ' দিয়ে শুরু, এমন শব্দের সংখ্যা ২৯ আর ‘শ্বেত' দিয়ে শুরু, এমন শব্দের সংখ্যা ৩৩, কাজেই পক্ষপাতিত্বটা বাংলা ভাষা অন্তত করেনি৷ সেটা করেছি আমরা বাঙালিরা৷ এখনও পুরনো বই-তে আঙুরবালা ইত্যাদি পুরনো অভিনেত্রী, গায়িকা ইত্যাদির ফটোতে দেখবেন, জাত হিসেবে আমরা কালো বই ধলা নই৷
এমনকি দেখতেও নই৷ যেমন আমার গিন্নি, যিনি ন্যক্কারজনক রকম ফর্সা৷ বিয়ের পর প্রথম প্রথম যখন কলকাতায় যেতাম, তখন সাদা-কালো ছবিতে আমাদের দু'জনের সঠিক অ্যাপার্চার খুঁজে পাওয়া যেতো না৷ আমাকে ঠিক দেখালে, গিন্নি ওভারএক্সপোজড, যেন সাদা শাঁকচুন্নি৷ আবার গিন্নির এক্সপোজার ঠিক থাকলে, আমি আন্ডারএক্সপোজড, যেন অবন ঠাকুরের কারিয়া পিরেত৷
শ্বেতাঙ্গ তারকাদের কৃষ্ণাঙ্গ জীবনসঙ্গী
পত্রিকা খুললেই আমরা ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন দেখি৷ সেখানে মেয়েদের অন্যতম গুণ হিসেবে আজও অনেক ক্ষেত্রেই ফর্সা হওয়ার কথা বলা হয়৷ তবে অনেক তারকা কিন্তু তেমনটা করেননি৷
ছবি: picture-alliance/abaca/H. Lionel
জর্জ লুকাস
‘স্টার ওয়ার্স’ নির্মাতা জর্জ লুকাস ২০১৩ সালে মার্কিন ব্যবসায়ী মেলডি হবসনকে বিয়ে করেন৷ হবসন বর্তমানে শ্রেক, মাদাগাস্কার – এসব অ্যানিমেটেড মুভি তৈরির জন্য বিখ্যাত ‘ড্রিমওয়ার্কস অ্যানিমেশন’ এর চেয়ারম্যান৷
ছবি: Getty Images/AFP
ডেভিড বোয়ি
ব্রিটিশ রক সংগীতের কিংবদন্তি ডেভিড বোয়ি ১৯৯২ সালে সোমালি-মার্কিন মডেল ইমান-কে বিয়ে করেন৷ ২০০০ সালে তাঁদের একমাত্র সন্তান জন্ম নেয়৷ ২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারি বোয়ি মারা গেছেন৷
ছবি: AP
হাইডি ক্লুম
জার্মানির শীর্ষ মডেল হাইডি ক্লুম ২০০৫ সালে ব্রিটিশ সংগীত শিল্পী সিল-কে বিয়ে করেন৷ ২০১৪ সালে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Buck
রবার্ট ডি নিরো
দু’বার অস্কারজয়ী অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো ১৯৯৭ সালে বিয়ে করেন মার্কিন অভিনেত্রী, গায়িকা ও সমাজসেবিকা গ্রেস হাইটাওয়ার-কে৷
ছবি: picture alliance/landov/R. Pitts
মারিয়া ক্যারি
হিরো, ভিশন অফ লাভ, ইমোশনস, উই বিলং টুগেদার গানগুলোর জন্য মারিয়া ক্যারির খ্যাতি বিশ্বজোড়া৷ ২০০৮ সালে তিনি বিয়ে করেছিলেন মার্কিন কমেডিয়ান, ব়্যাপার ও অভিনেতা নিক ক্যাননকে৷ ২০১৪ সালে তাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে৷
ছবি: Charley Gallay/Getty Images For Nickelodeon
ডিয়র্ক নোভিৎস্কি
জার্মানির প্রখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড় নোভিৎস্কি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত এনবিএ লিগে ‘ডালাস মেভেরিকস-এর হয়ে খেলছেন৷ সুইডেনের যমজ ফুটবলার মার্টিন ও মার্কুস ওলসন-এর বোন জেসিকা ওলসনকে ২০১২ সালে বিয়ে করেন নোভিৎস্কি৷ তাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে৷
ছবি: Getty Images
অলিভিয়ার মার্টিনেস
ফরাসি এই অভিনেতা একসময় অনেক তারকার সঙ্গে ‘ডেটিং’ করেছেন৷ সে কারণে ট্যাবলয়েডগুলোতে তাঁর পরিচয় ছিল ‘উইমেনাইজার’ হিসেবে৷ ২০১৩ সালে তিনি বিয়ে করেন অস্কারজয়ী অভিনেত্রী হ্যালি বেরিকে৷
ছবি: picture-alliance/abaca/H. Lionel
7 ছবি1 | 7
এতো গেল গাত্রবর্ণ৷ তারপরে আসে মুখশ্রী, মুখাবয়, ললাট, শ্মশ্রু, গ্রীবা৷ রবীন্দ্র রচনাবলীর প্রথম খণ্ড কলকাতা থেকে পাঠিয়েছিলেন মা৷ রঘুপতির ভূমিকায় রবি ঠাকুরের ছবি দেখে গিন্নী বললেন: ‘বাঙালি-ফাঙালি চিনি না৷ তবে ইনি যদি বাঙালি হন, তবে তুমি বাঙালি নও৷ আর তুমি যদি বাঙালি হও, তাহলে ইনি বাঙালি নন৷' বুঝুন একবার!
গিন্নি আর আমার সৎমেয়ে, তারা হল গে ককেশীয় খোড়োচুল ব্লন্দিনী৷ ছোটমেয়ে যেন না এদেশ, না ওদেশ হয়ে তৃতীয় কোনো একটা দেশ৷ আমি নিছক দেশি৷ আমি আর গিন্নি গড়িয়াহাট মার্কেট থেকে রিকশায় চড়ে ফিরতাম: লোকজন দেখতো যেন কোনো আর্মানি মা দুগগা মহিষাসুরকে নিয়ে পুজোর বাজার করে ফিরছেন৷
রং বস্তুত মানুষের চোখে৷ তাই গিন্নি আর সৎমেয়ে কতো সব মেয়ে দেখে হামলে উঠতেন: ও মা কী সুন্দর! ও মা কী সুন্দর! আমি বলতুম: সুন্দর কোথায়? ও তো বেশ কালো৷ – বেচারিরা বুঝতেই পারত না৷ পরে একদিন গিন্নি আমার কানে কানে বললেন: ব্যাপারটা কী জানো? আমাদের চোখে তোমরা সবাই কালো৷ ঐ যে, ওদেশে তোমাকে যখন জিগ্যেস করি, যে ভদ্রমহিলার কথা বলছ, যার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে, তাঁর চুলের রংটা কী? চোখের রং? তুমি তো বলতেই পারো না৷ বলবে কী করে? তোমাদের দেশে সবার চুল কালো, সবার চোখ বাদামি, ফারাক যা কিছু ঐ গায়ের রঙে৷ তাই তোমরা গায়ের রং দেখো৷
গিন্নি কিছুটা থামলেন৷ তারপর লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন: আসলে কী জানো? আমাদের চোখে তোমরা সবাই কালো৷
বাঙালি নারীর দশ গুণ
গরবিনি, আবেগী এবং স্বাধীনচেতা – বাঙালি নারীর সঙ্গে এই তিনটি বিশেষণই মানানসই৷ নারীর গুণ সম্পর্কে জানিয়েছেন ডয়চে ভেলের পাঠকরা৷ তাঁদের মতামত এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বাঙালি নারীর দশগুণ নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
আবেগী, স্বাধীনচেতা
গরবিনি, আবেগী এবং স্বাধীনচেতা – বাঙালি নারীর সঙ্গে এই তিনটি বিশেষণই মানানসই৷ আবেগ যেমন তাঁদের দ্রুত স্পর্শ করে, তেমনি স্বাধীনতার প্রশ্নে কিন্তু তাঁরা সত্যিকার অর্থে অনড়৷ নিজের সত্ত্বা নিয়ে অহংকার তাঁদের আছে বটে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মধ্যে রয়েছে অসীম ধৈর্য্য৷
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
শাড়িতে সবচেয়ে সুন্দর
বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে শাড়ি৷ সেই শাড়ি বাঙালি নারীর সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলে চমৎকারভাবে৷ বিভিন্নভাবে শাড়ি পরতে জানেনও তাঁরা৷ আর ‘উপহার হিসেবে শাড়ি’? – কোন বাঙালি মেয়ে না চায় বলুন?
ছবি: DW/A. Islam
উৎসব প্রেমী
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন৷ নববর্ষ, ঈদ কিংবা দুর্গা পূজা – সব উৎসবই যেন বাঙালি নারীর জন্য তৈরি৷ প্রতিটি উৎসবের সঙ্গে মানানসই পোশাক পরতে এবং সেই উৎসবের উপযুক্ত রান্নায় পারদর্শী তাঁরা৷ ডয়চে ভেলের পাঠক সুজন খানের কথায়, ‘‘বঙ্গের নারী লাজুক প্রকৃতির, কিন্তু যে কোনো উপলক্ষ্যেই প্রাণ খোলা হাসি উপচে পড়ে তাঁদের৷’’
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
‘নো ডায়েট’
বাঙালি নারী ‘ডায়েট’ করছেন, এমনটা বেশ বিরল৷ তাই খাওয়ার ব্যাপারে তাঁরা বেশ উদার৷ কথায় বলে না, মাছে-ভাতে বাঙালি? অবশ্য মাছ-ভাতের পাশাপাশি ফুসকা কিংবা চটপটি পেলে তো আর কথাই নেই৷ আসলে টক, ঝাল, নোনতা, মিষ্টি, এমনকি তেতোও পছন্দ এই নারীদের৷
ছবি: Debarati Mukherji
রান্নার শখ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাই ধরুন৷ দেশ সামলানোর কঠিন দায়িত্ব পালনের মাঝেও রান্না ঘরে যেতে ভোলেন না তিনি৷ গত বছর ছেলের জন্য রান্না করার সময় তোলা তাঁর এই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন তুলেছিল৷ বাঙালি মেয়েরা রাঁধতে যে ভীষণ ভালোবাসেন!
ছবি: Sajeeb Wazed
অল্পতেই সন্তুষ্ট
বাঙালি মেয়েদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা কি খুব কঠিন? না৷ সকলেই জানেন যে, কাজটা সহজই৷ একটি লাল গোলাপ পেলে কিংবা প্রিয় রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেই তাঁরা সন্তুষ্ট৷ ডয়চে ভেলের পাঠক রন্জু খালেদের মতে, বাঙালি নারীর মধ্যে ‘একইসাথে দৃঢ়তা ও নমনীয়তা এবং প্রজাপতির চপলতা’ রয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
কাজল কালো চোখ
জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ কিংবা রবি ঠাকুরের ‘কৃষ্ণকলি’ – বাঙালি নারীর কাজল কালো চোখের প্রশংসা পাবেন অনেক কবির কবিতাতেই৷ সত্যি বলতে কি, বাঙালি নারীর চোখ পুরুষকে টানে সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: N.Seelam/AFP/GettyImages
বাকপটু
বাংলাদেশের কিংবা ভারতের মেয়েরা চুপ করে বসে আছেন – এমন দৃশ্য কল্পনা করাও কঠিন৷ তাঁরা কথা বলতে ভালোবাসেন৷ রান্না থেকে রাজনীতি – সব বিষয়েই একটা মতামত আছে তাঁদের৷ ডয়চে ভেলের পাঠক জিএনএস নয়নের কথায়, ‘‘নারী পুরুষের যে কোনো কষ্ট অতি সহজে ভুলিয়ে দিতে পারে৷ এই গুণই আমাকে মুগ্ধ করে, আবার সাথে অবাকও করে৷’’
ছবি: DW/A. Islam
নারীবাদী
বাঙালি মেয়েরা নারীবাদী৷ বিতর্কিত বাঙালি লেখিকা তসলিমা নাসরিন তাঁদের অনেকেরই প্রিয়৷ নাসরিনের ‘আমার মেয়েবেলা’ পড়েনি এমন নারী পাওয়া মুশকিল৷
ছবি: AFP/Getty Images
ভ্রমণপ্রিয়
বাংলাদেশি কিংবা ভারতীয় বাঙালি নারীর গুণ কি আর অল্পতে জানানো যায়, বলুন? কিছু গুণ না হয় অজানাই থাক৷ তবে একটির কথা বলে শেষ করি, বাঙালি মেয়েরা কিন্তু ঘুরতে খুব ভালোবাসেন৷ তথ্য সহায়তা: ডয়চে ভেলে ফেসবুক পাতা, ইন্ডিয়াওপাইন্স, স্কুপহুপ
ছবি: DW/A. Islam
10 ছবি1 | 10
আমি তো যাকে বলে কিনা স্তম্ভিত৷ তোতলাতে তোতলাতে বললাম: সবাই? এমনকি আমাদের রাঙাপিসিমা, ললিত মামার বউ, খুদিপিসির বড়নাতির গার্লফ্রেন্ড, যে সাবানের বিজ্ঞাপনে নামে – সবাই কালো?
কালো মানে? গিন্নী রীতিমতো চটে গেলেন৷ আমরা যে প্রতিবছর ইটালি, স্পেন, হল্যান্ডে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে ভাজা ভাজা হয়ে একটু বাদামি হবার চেষ্টা করি, তার বেলা? ওরকম ছুটি কাটাতে কতো খরচা হয় জানো? সে রং আবার হপ্তা দুয়েক পরেই উপে যায়, আমরা আবার পাথরচাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাশে হয়ে যাই৷
গিন্নী আর সৎমেয়ের যাকে সবচেয়ে সুন্দরী বলে মনে হয়েছিল, সে ছিল আবার আমাদের বাড়ির সীতা নামের এক ঝি৷ বছর আঠেরোর যাকে বলে কিনা সোমত্ত মেয়ে – বড়ঘরের হলে নিশ্চয় বলতাম, দারুণ ফিগার! ঝাড়া হাত-পা, কাজ-করে-খেটে-খাওয়া ছিমছাম চেহারা, ছিমছাম সাজগোছ, কপালের মাঝখানে এক ধ্যাবড়া টিপ ছাড়া৷ ওদিকে বালিগঞ্জ স্টেশনের কয়লার ইঞ্জিনের খালাসীদের মতো কালো৷ সেদিন সন্ধ্যায় গিন্নীকে বলতে শুনলাম: তুমি এইরকম একটা মেয়ে বিয়ে করলে পারতে না?
যার উত্তর হল: না, কেননা আমরা বর্ণবাদী৷ সাধে কি আর খোদ রবি ঠাকুর ন্যাকামি করে লিখেছেন, কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি; কালো মেয়ের মুখ দিয়ে শরৎবাবুকে অনুরোধ করেছেন, কালো মেয়েদের নিয়ে একটা গপ্পো লিখতে...৷
আপনার কী কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷