চৈত্র এলেই মনটা কেমন যেন হয়৷ মনে পড়ে সেইসব ধূলিধুসর, রৌদ্রমাখা দিনগুলোর কথা৷ মনে পড়ে যায় আমার প্রিয় গ্রামের কথা, গ্রামের হাট-বাজার, যাত্রাপালা, নাগরদোলা আর হ্যাঁ, মেলার কথা৷ নানারকম, বিচিত্র সব মেলার কথা৷
বিজ্ঞাপন
ওই যে দূরের সবুজ গ্রামটা৷ সেখানে বিশাল ছাতার মতো একটা অশ্বত্থ আছে৷ কী ছায়া সুনিবিড় শান্ত শ্যামলিমায় ঢাকা সব কিছু৷ গ্রীষ্মের উষ্ণ দুপুরে সবটুকু প্রশান্তি যেন সেখানে ছড়িয়ে রাখে৷ গাছটির চারপাশ মাঠের মতো সমতল৷ বৈশাখে ওখানে সপ্তাহব্যাপী মেলাবসে৷ গ্রামের মানুষ জায়গাটির নাম রেখেছে কালিতলা৷ মেলা শুরু হওয়ার মাসখানেক আগেই গ্রামে প্রস্তুতি শুরু হয়৷ পাশের গ্রামগুলোতে কামার, কুমার, ছুতার, দোসাইদ, তাঁতি সবাই ব্যস্ত সময় পার করে৷ ওদিকে যাত্রাদল, গায়কদল, কবিয়াল – এঁদেরও দু'দণ্ড সময় নেই৷ নতুন নতুন যাত্রাপালার পরিকল্পনা নিয়েই সময় কাটে তাঁদের৷ চারদিকে কেমন উৎসবের আমেজ৷ সব বয়সি মানুষ অপেক্ষা করে মেলার জন্য৷ বৈশাখে গ্রাম বাংলায় এমন দৃশ্য বিরল নয়৷ আর বছরের শুরুতেই বাংলা বর্ষবরণকে কেন্দ্র করেই এই জনপদে সবচেয়ে বেশি মেলার আনুষ্ঠানিকতা চোখে পড়ে৷ সময়ের বিবর্তনে শুধু মেলার আনুষ্ঠানিকতায় কিছু পরিবর্তন এসেছে বৈকি৷ আবার সংখ্যায়ও যে কিছুটা কমেছে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়৷
আসলে এই জনপদে মেলা একটি উপলক্ষ্য মাত্র৷ মেলাকে ঘিরে যে আয়োজন তা বহুধা বিস্তৃত এবং বর্ণাঢ্যতায় ভরা৷ শেকড়ের এসব বিনোদন যুগ যুগ ধরে আমাদের সাংস্কৃতিক ধারাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে৷ মেলার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ যাত্রাপালা৷ রাত একটু গভীর হলেই শুরু হতো যাত্রানুষ্ঠান৷ একসময় জনপ্রিয় ছিল রহিম রূপবান, সিরাজউদ্দৌলা৷ কোথাও কোথাও বসত পালা গানের আসর৷ তবে যে কোনো লোকজ মেলায় নাগরদোলা এখনো অনিবার্য৷ মেলায় সব ধরনের পণ্যই সহজলভ্য৷ একটা সময় ছিল যখন মানুষ পণ্য আদান-প্রদানের প্রধান মাধ্যম হিসেবে মেলাকেই বেছে নিয়েছিল৷ সময়ের বিবর্তনে সেসব এখন বদলে গেছে৷ তবুও মেলা কেন্দ্রিক উৎসবের আমেজ এখনো কোথাও কোথাও লক্ষ্য করা যায়৷ দেশের উত্তর জনপদে কোনো কোনো মেলার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করা হয় নাইওরি নেবার জন্য৷ মেলা উপলক্ষ্যে বিশেষত মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়৷ নতুন জামা-কাপড় দেওয়া হয়৷ এটা কোনো কোনো এলাকার আঞ্চলিক রীতি৷
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও বিচিত্র কয়েকটি মেলা
বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ গ্রামীণ মেলা৷ বিভিন্ন পালা পার্বণকে কেন্দ্র করে বছরজুড়ে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি ছোট-বড় গ্রামীণ লোকজ মেলা বসে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে৷ কয়েকটি গ্রামীণ মেলা দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লোক ও কারুশিল্প মেলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে প্রতি বছর মাসব্যাপী বসে লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব৷ সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে প্রতি বছর এ মেলা শুরু হয় জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি৷ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এ লোকজ মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকার সব রকম লোকজ সংস্কৃতি ও কুটির শিল্প সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হন শিল্পীরা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বৈশাখী মেলা
এটি মূলত সার্বজনীন লোকজ মেলা৷ বাংলা নতুন বছরের শুরুতে বাংলাদেশের সর্বত্রই আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার৷ নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে এ বৈশাখী মেলা৷ স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলার মূল আকর্ষণ৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাস মেলা
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনের দুবলার চরে প্রতিবছর কার্তিক-অগ্রহায়নের পূর্ণিমা তিথিতে বসে রাসমেলা৷ অনেক হিন্দু পুন্যার্থী আর পর্যটক এ উৎসবে শামিল হতে দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন৷ এ উপলক্ষ্যে পাঁচ দিনের একটি মেলাও মেলা বসে দুবলার চরে৷ মেলাটি চলে আসছে ১৯২৩ সাল থেকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লাঙ্গলবন্দের মেলা
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলমম্বীরা চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী বা অশোকাষ্টমী তিথিতে পুণ্যস্নানের জন্য সমবেত হন৷ এ উপলক্ষে তিন দিন ব্যাপী মেলা বসে ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
গুড়পুকুরের মেলা
বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এ মেলাটি ৩০০ বছরেরও বেশি৷ বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ভাদ্র মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনসা পূজাকে কেন্দ্র করে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়৷ চলে একমাস৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
পোড়াদহের মেলা
গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ি এলাকায় ইছামতি নদীর তীরে আড়াইশ বছর ধরে বসে ব্যতিক্রমী এক মেলা৷ প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার বসে দুই দিনের এ মেলা৷ এ মেলার মূল আকর্ষণ বড় বড় আকৃতির নানা রকম মাছ৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাশ লীলার মেলা
মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা কমলগঞ্জ আর আদমপুরে কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব রাস লীলা৷ এ উপলক্ষে তিন দিনের মেলা বসে কমলগঞ্জের মাধবপুর ও আদমপুরের সনাঠাকুর মণ্ডপ এলাকায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রথের মেলা
সাধারণত বাংলা বছরের আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথের মেলা বসে৷ সবচেয়ে বড় রথের মেলা বসে সাভারের ধামরাইয়ে৷ এছাড়া কুষ্টিয়ার রথখোলার মেলা, রাজশাহীর পুঠিয়ার রথের মেলা, সিলেটের লামাপাড়া রথযাত্রার মেলা উল্লেখযোগ্য৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লালন মেলা
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে মরমী শিল্পী লালন সাঁইয়ের সামাধিকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দুইবার লালনমেলা অনুষ্ঠিত হয়৷ তার একটি হচ্ছে লালন সাঁইজির তিরোধান তিথি উপলক্ষে এবং অন্যটি দোলপূর্ণিমায় লালন প্রবর্তিত সাধুসঙ্গ উপলক্ষে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মধু মেলা
যশোরজেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়িতে প্রতি বছর বসে সপ্তাহব্যাপী মধু মেলা৷ বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে হয় এ মেলার আয়োজন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বটতলায় বৌমেলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে চারশ’বছরের পুরানো একটি বট গাছকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে পালিত হচ্ছে বউ মেলা৷ বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরা পরিবারের সুখ শান্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে এখানকার বট গাছকে পূজা করেন৷ এ উপলক্ষে পাঁচদিনের মেলাও বসে বট গাছের চারপাশে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
11 ছবি1 | 11
মূলত বৈশাখে বর্ষবরণকে কেন্দ্র করেই মেলা ও নানামাত্রিক উৎসবের আয়োজন করা হয়৷ এ মাসে মেলার আবেদনটা একটু ভিন্ন৷ কিন্তু শুধু বৈশাখেই নয়, আমাদের দেশে মেলার পরিধি বর্ষব্যপ্ত৷ তথ্য মতে, একসময় সারাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৩০০ মেলা অনুষ্ঠিত হতো৷ তবে এই সংখ্যাটি শতভাগ নিশ্চিত কিছু নয়৷ কারণ, মেলা একটি চলমান প্রক্রিয়া৷ সময়ের বিবর্তনে বদলে যেতে পারে এর স্থান, পরিধি, সময়কাল ও উপলক্ষ্য৷ আবার কিছু কিছু মেলা হঠাৎ করে বন্ধও হয়ে যেতে পারে৷ শুরু হতে পারে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কোনো কোনো মেলা৷ বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেলার জন্য বটতলা বা পুর্বনির্ধারিত কোনো স্থানের প্রয়োজন না-ও হতে পারে৷ সবকিছু মিলিয়ে মেলা এতটাই বিবর্তিত একটি সাংস্কৃতিক মাধ্যম যে, এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া অনেকটাই দুঃসাধ্য৷ কারণ, একটি মেলার ধারাবহিকতা নির্ভর করে সেখানকার আঞ্চলিক পরিস্থিতির ওপর৷ আয়োজকদের সদিচ্ছা, আর্থিক সঙ্গতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বিষয়গুলো তখন মুখ্য হয়ে ওঠে৷ এসব কারণে মেলা ধারাবাহিকতা হারায়৷ বদলে যেতে পারে মেলার সময়কাল এবং পরিধিও৷
এপারের উৎসবে শরিক ওপার
উৎসবের সাজে সেজে উঠছে কলকাতা৷ বসেছে হরেক রকমের মেলা৷ এবার তাতে সামিল হলেন ওপার বাংলার মানুষেরাও৷ তাঁদের নানা সামগ্রীতে রঙিন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ মেলা৷ সদ্য এই মেলা হয়ে গেল কলেজ স্ট্রিটে৷
ছবি: DW/P. Samanta
একান্ত আগ্রহের
বাংলাদেশের শিল্প ও পণ্যসামগ্রী নিয়ে কৌতূহল সারা বিশ্বের! শহর কলকাতাও তার উর্ধে নয়৷ কলেজ স্ট্রিটে আয়োজিত এই মেলা ঘিরে মানুষের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো৷
ছবি: DW/P. Samanta
ঐতিহ্যে খাদি
একুশ শতকে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে খাদির পোশাক৷ কুমিল্লার মহম্মদউল্লার স্টলে ছিল খাঁটি খাদি বস্ত্র সামগ্রীর পসরা৷ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাদির পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, গামছা এপারের নজর কেড়েছে বৈকি!
ছবি: DW/P. Samanta
দৈনন্দিনতার অঙ্গ
দৈনন্দিনতায় বাঙালির বড় প্রয়োজনীয় বিছানার চাদর৷ ওপার বাংলার ঢাকা, কুষ্টিয়া, কুমারখালি থেকে আসা বিছানার চাদর ঘিরে এপার বাংলাতেও যথেষ্ট আগ্রহ দেখা গিয়েছিল৷
ছবি: DW/P. Samanta
জুতা আবিষ্কার!
ক্ষতিকারক প্লাস্টিককে রুখতে পাট-ই আমাদের মূল ভরসা৷ মেলায় পাটের তৈরি হরেক দ্রব্যের সম্ভারে চমক ছিল জুতো৷ ঢাকার সোহেল রানার ‘জুটেস্কো’ নানারকম ব্যাগের পাশাপাশি তৈরি করে এই জুতো৷
ছবি: DW/P. Samanta
গৃহিণীর নজর
মহিলাদের অনেকেরই নজর ছিল গৃহসজ্জার উপকরণের দিকে৷ ময়মনসিংহের লাইজু আক্তারের কুশন কভার বা গৃহসজ্জার নানা উপকরণে গৃহিণীরা বেশ মজে ছিলেন৷
ছবি: DW/P. Samanta
মসলিনের দেশ
বস্ত্রশিল্পে বাংলাদেশের খ্যাতি বিশ্বজোড়া৷ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়৷ এমন নজরকাড়া সামগ্রীর কদর তো হবেই!
ছবি: DW/P. Samanta
শিল্প বটে!
রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ি এলাকার উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা তৈরি করেন সুদৃশ্য ছাতা, ব্যাগ, পাখা৷ বাঁশের তৈরি এমন ইকো-ফ্রেন্ডলি ছাতা রীতিমতো যে কোনো বহুজাতিক সংস্থাকে চমকে দিতে পারে৷
ছবি: DW/P. Samanta
স্বনির্ভরতার পথে
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগীদের মধ্যে ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন মহিলারা৷ ক্রমশ তাঁরা স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন৷ তেমনই একজন চাঁদপুরের সনজিদা খানম৷ তিনি তাঁর নিজস্ব উদ্যোগের পসরা নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়৷
ছবি: DW/P. Samanta
কেবলই উঁকি
মেলার উদ্দেশ্য নিজের সামগ্রী জনতার সামনে তুলে ধরা, নিছক বিক্রি নয়৷ তাই অজস্র ক্রেতা উঁকি দেন স্টলে স্টলে৷ একাংশ কেনাকাটা করেন৷ বাংলাদেশের পণ্যেও ব্যতিক্রম হয়নি উঁকিঝুঁকির৷
ছবি: DW/P. Samanta
শাড়ি নজরকাড়া
ঢাকাই জামদানির বিশ্বজোড়া নাম! কুমিল্লার পারভিন আক্তারের জামদানি পুজোর বাজারে হটকেকের মতো সেল হওয়ারই জিনিস! ভারতীয় মুদ্রায় তিন হাজার টাকা থেকে এর দাম শুরু৷ নিজস্ব তাঁতি দিয়ে তৈরি ঢাকাই জামদানির পাশে ছিল ফেব্রিক ও অ্যাপ্লিকের নজরকাড়া শাড়ি৷
ছবি: DW/P. Samanta
10 ছবি1 | 10
আধুনিক যুগে মেলার রকমফের বেড়েই চলেছে৷ শিল্পমেলা, প্রদর্শনী মেলা, বাণিজ্য মেলা, বসতি মেলা, কম্পিউটার মেলা, মৎস্য মেলা, ভ্রমণ মেলা, আয়কর মেলা, ফার্ণিচার মেলা, প্রকৃতি মেলা, পরিবেশ মেলা, বৃক্ষ মেলা, কৃষি মেলা, বইমেলা, পৌষ মেলা ইত্যাদি নানা রকমের মেলার আয়োজন হতে দেখা যায়৷ এ সবের কোনো কোনোটিতে প্রবেশ উন্মুক্ত, কোনো কোনোটি নিয়ন্ত্রিত৷ কোনোটি শুধু নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পৃক্ত করতে কিংবা যুবসমাজের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেও আয়োজন করা হচ্ছে৷ এক্ষেত্রে যুবমেলার কথাও উল্লেখ করা যায়৷ এছাড়া কুটিরশিল্প, তাঁতশিল্প, চামড়াশিল্প ইত্যাদির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে বা আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান তৈরির জন্য এসব পণ্যভিত্তিক মেলাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ পণ্যভিত্তিক এসব মেলা আমাদের নগর সংস্কৃতিতে যোগ করছে ভিন্ন মাত্রা৷ এসব মেলার ব্যাপ্তিকালও নানা মাত্রিক৷ একদিন থেকে শুরু করে একমাসও হতে পারে৷ এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের শিরোনামে পণ্যভিত্তিক মেলাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ তাতে স্থানীয় মানুষ ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হবার সুযোগ পাচ্ছে৷
মেলা যদিও আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটা অংশ, তবু মেলাকেন্দ্রিক কিছু সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠান গড়ে উঠেছে৷ এগুলো আমাদের বিনোদনধারাকে উর্বর করেছে৷ পয়লা বৈশাখের কথাই ধরা যাক৷ এ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মেলায় কি শুধু জিনিসপত্র বেচা-বিক্রি চলে? অবশ্যই নয়৷ যাত্রা প্রদর্শনী, পুতুলনাচ, পালাগান, কবিয়ালদের আসর থেকে শুরু করে হেন অনুষ্ঠান নেই, যা দেখা যায় না৷ কারণ, এসব হচ্ছে মেলার বাড়তি আকর্ষণ৷ সবাই তো আর মেলায় কেনাকাটা করতে যায় না, কেউ কেউ আনন্দ উপভোগ করতেও সেখানে যায়৷ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এই যে মেলার উপস্থিতি, তার ইতিহাস বেশ পুরনো৷ এখন হাতের কাছেই সব ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে৷ ইচ্ছেমতো ছবি দেখা, গান শোনা, গেম খেলা, এমনকি ইন্টারনেটের বদৌলতে গোটা পৃথিবী ঘুরে আসা৷ আজ থেকে একশ' বা দু'শ' বছর আগেও মানুষ কি এ সবের কথা ভাবতে পেরেছে? তবু থেমে থাকেনি মানুষ৷ বরং যেটুকু উপভোগ করেছে, তা মন-প্রাণ দিয়ে করেছে৷ আর মেলাকেন্দ্রিক বিনোদনই ছিল তখন সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়৷ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তরা প্রায় সারা বছর ধরে মেলার অপেক্ষায় থাকতো৷ মেলার সময় কেনাকাটা বা বেচা-বিক্রি হবে, আমোদ-ফূর্তি হবে৷ এমন নির্মল আনন্দের দিন বছরে একবারই তো আসে৷ মানুষ এখন যাত্রার পরিবর্তে মঞ্চনাটক, কিংবা টিভি-সিনেমাতেই বেশি আসক্ত৷
হস্তশিল্প মেলা
শহর কলকাতায় শীত মানেই মেলার মরশুম৷ যার শুরু হয় হস্তশিল্প মেলা দিয়ে৷ সারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে নানা ধরন এবং আঙ্গিকের হস্তশিল্পের পশরা নিয়ে আসেন শিল্পীরা৷ এক চত্বরে ধরা পড়ে বাংলার সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা এবং উৎকর্ষের চেহারা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বাঁকুড়ার ঘোড়া
বাংলার হস্ত শিল্প মানেই বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া, হাতি, মনসার পট৷ আজকাল আধুনিক শিল্পভাবনাও দেখা যায় এই সৃষ্টিতে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
কারুশিল্প
প্রথম দর্শনে আফ্রিকা মহাদেশের কাঠখোদাই শিল্পের বিভ্রম তৈরি হতে পারে, কিন্তু এই দারুশিল্পও আদতে বাংলারই আরেক শিল্পরীতির নমুনা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ঘরোয়া টেরাকোটা
শুধু ঘর সাজানোর সামগ্রী নয়, টেরাকোটা শিল্পীরা এখন তৈরি করছেন গেরস্থালির নানা সরঞ্জাম৷ চায়ের কাপ-প্লেট, মোমবাতিদান, গয়নার কৌটো৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
নবীন উৎসাহ
যাঁরা ভাবেন হস্তশিল্পে আধুনিক প্রজন্মের উৎসাহ নেই, তাঁরা ভুল ভাবেন৷ হস্তশিল্প মেলার ক্রেতাদের এক বড় অংশ কিন্তু নবীন প্রজন্ম৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
মাদুর, আসন
হস্তশিল্প মেলার পশরার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে হাতে বোনা মাদুর, নকশা করা কাপড়ের আসন, যা নিত্য ব্যবহারের কাজে লাগে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
সূক্ষ্ম সূচিশিল্প
হাতে বোনা কার্পেটের আসন ছাড়াও এখন ক্রেতাদের আকর্ষণ করে দেওয়াল চিত্র, যা অনুপম সূচিশিল্পের সেরা নমুনা৷ এসবের বিক্রি বেশ ওপরের দিকে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
নকল ফুল
নকল হলেও প্রকৃতির সমস্ত রঙ, রূপ আর উচ্ছ্বাস ধরা পড়ে এই ফুলের সম্ভারে৷ উপকরণ হলো বাংলার চিরন্তন শোলা এবং শুকনো খেজুরপাতা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
পাটের বাহার
পণ্যের বস্তা, থলে ইত্যাদিতে পাটের ব্যবহার আজ আর প্রায় নেই৷ পাটশিল্প যেটুকু টিকে আছে, তা এই বাহারি ব্যাগ, বটুয়া, টেবিলম্যাট আর টুপিতে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
উত্তুরে হাওয়া
কাঠ আর বেতের কাজ মানেই উত্তরবঙ্গ৷ দৃষ্টিনন্দন কাঠখোদাই ভাস্কর্য থেকে বেতের বাতিদান, বাঁশের কোঁড় দিয়ে তৈরি চায়ের কাপ, পানীয়ের গেলাস, এক বিপুল সম্ভার৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বেতের বাহার
চিরকালীন চুবড়ি, ধামা, কুলো৷ কিন্তু ক্রেতার মন পেতে তাতেও লেগেছে রঙের ছোঁয়া৷ এর কারিগররা আসেন মূলত দক্ষিণবঙ্গ থেকে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
মিশ্র শিল্প
বাংলায় পটের আঁকা আছে, আর পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বা আরও পশ্চিমে আছে রঙবাহারি নকশা করা কেটলি৷ দুইয়ের মিলমিশ ঘটেছে দিব্যি৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
মহিলা শিল্পী
এই একটি ব্যাপারে এখনও মেয়েরাই এগিয়ে৷ অলঙ্করণ থেকে শুরু করে হস্তশিল্পের সব কাজেই এখনও মহিলা শিল্পীদেরই কদর বেশি৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
12 ছবি1 | 12
কিছু কিছু মেলা স্থানকেন্দ্রিক৷ প্রসঙ্গত পীর-আউলিয়াদের দরগাহকেন্দ্রিক মেলার কথা বলা যায়৷ প্রথম দিকের মেলাগুলো সাধারণত যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধাজনক অবস্থানেই অনুষ্ঠিত হতো৷ চৌরাস্তার মোড়ে, নদীর তীরে, রেলস্টেশনের কাছে৷ অর্থাৎ যেখানে খুব সহজেই মালামাল পরিবহন করা যেতো, যাতায়াত করা যেতো সেখানেই মেলা বসত৷ ব্যতিক্রমও অবশ্য রয়েছে কিছু৷ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মেলা মানুষের বিশ্বাস ও লৌকিকতাকে কেন্দ্র করেই এবং যথাযথ প্রতিষ্ঠানভিত্তিক৷ বটতলার মেলা, কালীতলার মেলা৷ এ সবও কিছু অনানুষ্ঠানিক ধারণা থেকেই সৃষ্ট৷ বটতলায় যদি খোলা প্রাঙ্গণ থাকে, চারদিকে যাতায়াতের জন্য রাস্তা থাকে, চমৎকার ছায়া পাওয়া যায়, বটবৃক্ষকে যদি দেবতুল্য মনে করা হয়, তাহলে এর নীচে মেলার আয়োজন করতে দোষ কোথায়? প্রচলিত অনেক ধ্যানধারণা থেকেও মেলার স্থান নির্ধারণ করতে দেখা গেছে৷
সাধারণত তীর্থস্থান নয়, কিন্তু ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত এমন জায়গায়ও মেলা বসতে দেখা যায়৷ বারুণী স্নান ধর্মীয় বিষয়, সেখানেও পুণ্যার্থীদের ভিড় জমে৷ অনাকাঙ্খিতভাবেই মেলার পরিবেশ তৈরি হয়৷ রথযাত্রা, দুর্গাপূজা এসব উৎসবে লোকসমাগম হয় প্রচুর৷ ফলে এখানেও মেলা বসে৷ দেশের ঐতিহ্যবাহী বড় পরিসরের বেশ কিছু মেলা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল আমার৷ তার মধ্যে মহেশখালীর আদিনাথের মেলা, সুনামগঞ্জের যাদুকাটার লাউড়ারগড় মেলা ও চাপাইনবাবগঞ্জের শাহ নিয়ামত উল্লাহর দরগাহ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মেলা অন্যতম৷ এই মেলাগুলোতে লক্ষাধিক লোকের সমাগম দেখেছি৷ মেলায় মানুষের সম্পৃক্ততা কতটা আন্তরিক ও গভীর হতে পারে, তার বড় উদাহরণ এই মেলাগুলো৷ অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো এসব মেলায়৷ কিন্তু আমাদের জনপদে ঐতিহ্যবাহী এসব মেলা ভালোভাবে টিকে থাকলেও, কিছু কিছু মেলা একেবারেই হারিয়ে গেছে৷ এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ৷ প্রধাণত পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, আদর্শিক চেতনা ও ধর্মীয় বিভাজন এর জন্য দায়ী৷ বর্তমানে হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার ও উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মেলাগুলো নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হতে দেখা যায়৷ তাছাড়া যথাযথ উদ্যোগ এবং স্থানসংকটও বর্তমানে অন্যতম একটি কারণ৷
জার্মানির সবচেয়ে বড় সাত লোকউৎসব
মিউনিখের অক্টোবরফেস্টে অংশ নিতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন৷ প্রতিবছর ষাট লাখের বেশি মানুষ জড়ো হন এই লোকউৎসবে৷ তবে এরকম উৎসব জার্মানিতে আরো আছে৷ চলুন সেগুলো দেখে নেই৷
ছবি: Stadtmarketing Herne
মিউনিখের অক্টোবরফেস্ট
নিঃসন্দেহে জার্মানির সবচেয়ে বড় লোকউৎসব অক্টোবরফেস্ট৷ প্রতিবছর ষাটলাখের বেশি মানুষ বাভারিয়ার এই উৎসবে হাজির হন, যাদের একটি বড় অংশ বিদেশি পর্যটক৷ কেউ কেউ সরাসরি উৎসবের বিয়ারের তাঁবুতে চলে যান৷ এমনকি সকালেও সেসব তাঁবুর সামনে লম্বা লাইন দেখা যায়৷ এরকম উৎসব কিন্তু জার্মানিতে আরো আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Markus C. Hurek
রাইনের পাড়ে কারমেস
বিয়ারের তাঁবু আর মেলায় বাদ্যবাজানোর দল শুধু বাভারিয়াতেই দেখা যায় না৷ জার্মানির নর্থরাইন-ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যেও বড় বড় উৎসবের আয়োজন করা হয়৷ এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে কারমেস, যেটি জুলাই মাসে দশদিনের জন্য অনুষ্ঠিত হয়৷ ফেরিস হুইল, লগ ফ্লুম এবং রোলার কোস্টারের মতো রাইডের দেখা মেলে এই উৎসবে, আর এতে বছরে গড়ে হাজির হন চল্লিশ লাখ মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্রানগার কারমেস
নর্থ রাইন-ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের দ্বিতীয় বড় উৎসবটি পাঁচ কিলোমিটার অবধি বিস্তৃত৷ এতে পঞ্চাশটির মতো আকর্ষণ রয়েছে৷ এই উৎসবের এক অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে ঘোড়ার বাজার এবং উদ্বোধনের আগের বিশেষ শো৷
ছবি: Stadtmarketing Herne
ব্রেমেন ফ্রি ফেয়ার
ব্রেমেন ফ্রি ফেয়ারের লম্বা ইতিহাস রয়েছে৷ সেই ১০৩৫ সালে তৎকালীন সম্রাট দ্বিতীয় কনরাড ব্রেমেন শহরকে এই মেলা আয়োজনের অনুমতি দিয়েছিলেন৷ মেলায় কৃষক, কারিগর এবং ব্যবসায়ীরা স্বাধীনভাবে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারেন৷ হাজার বছর ধরে বাৎসরিক এই মেলা চলছে৷ অক্টোবরে সতের দিনের জন্য এটি আয়োজন করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হামবুর্গার ডোম
ব্রেমেনের ফ্রি ফেয়ারের মতো হামবুর্গার ডোমের শুরুও সেই একাদশ শতকে৷ সেসময় কৃষক, কারিগর এবং ব্যবসায়ীরা হামবুর্গের ক্যাথড্রালের চারদিকে পণ্যের পসরা সাজানো শুরু করেন৷ সেই ভবন এখন আর নেই, তবে মেলাটি আছে৷ প্রতিবছর প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষ এই মেলায় আসেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Bockwoldt
ক্যান্সটাটার লোকউৎসব
বাভারিয়ার প্রতিবেশী রাজ্য বাডেন ভুর্টেমব্যার্গের বিশেষ আকর্ষণ ক্যান্সটাটার লোকউৎসব৷ সেপ্টেম্বেরের শেষের দিক থেকে অক্টোবরের শুরু অবধি এই মেলার আয়োজন করা হয়৷ অক্টোবরফেস্টের মতো এই মেলাতেও অনেক মানুষ ভিড় করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Bockwoldt
লিবোরি
পাডারবনে আয়োজিত বিশেষ এই মেলায় বছরে ষোল লাখের বেশি মানুষ অংশ নেন৷ এটি মূলত চার্চ উৎসব, কারমেস, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ফ্লি মার্কেটের এক মিশ্রন৷ গত কয়েক শতক ধরে নিয়মিত এই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Dunker
7 ছবি1 | 7
ইদানীং মেলার নামে সারাদেশে অনেক অসংগতিপূর্ণ ও অসামাজিক কার্যকলাপ হতে দেখা যায়৷ তাতে মেলার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে৷ পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে৷ নিশ্চয়ই কেউ তার পরিবার নিয়ে অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আসরে যাবেন না৷ এটা আসলে এক ধরনের অবক্ষয়৷ মেলা তো একটি নির্মল আনন্দের জায়গা৷ সেই আনন্দের উপকরণগুলো অবশ্যই সমাজমনস্ক হতে হবে৷ বড় জোর সেখানে শিকড়ঘনিষ্ঠ বিনোদনের পাশাপাশি আধুনিকতাও যুক্ত হতে পারে৷ তবে অবশ্যই কুরুচিপূর্ণ কিছু নয়৷ কিন্তু এখন তো গ্রামের মেলা মানেই এসব৷ আর জুয়া এবং অশ্লীল নৃত্যকেন্দ্রীক এসব মেলার দাপটে আমাদের একসময়ের সহজ-সরল জীবনবোধের প্রতিচ্ছবি সম্বলিত মেলাগুলো এখন হারিয়ে যেতে বসেছে৷ তারুণ্যের যে শক্তি অপসংস্কৃতির মেলা নিয়ে ব্যস্ত, সেই শক্তিটাই ইচ্ছে করলে মেলার প্রচলিত পুরনো ধারা ফিরিয়ে আনতে পারে৷ কাজটি মোটেও কঠিন কিছু নয়৷ একসময় কোথায়, কোন ধরনের, কতদিনের মেলা হতো স্থানীয় মানুষ তা জানেন৷ তরুণ সমাজ সেসব মেলা সম্পর্কে বিশদ জেনে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় মেলার আয়োজন করতে পারে৷ এসব মেলার মধ্য দিয়ে আমাদের লোকসংস্কৃতির বর্ণাঢ্য ও বহুমুখী চিত্রগুলো আবার নতুন করে ফিরে আসবে৷ এটা হলো একটি সুস্থধারার চর্চা৷ তারুণ্যের ভেতর দিয়েই এই চর্চার প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করা প্রয়োজন৷ নিজের ঐতিহ্য সম্পর্কে না জানলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়৷
দেশের পুরনো মেলাগুলো যেন যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে তার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা থাকা প্রয়োজন৷ বিভিন্ন অঞ্চলের লুপ্তপ্রায় মেলাগুলোর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে স্থানীয়ভাবে সেই মেলাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা উচিত৷ থাকা উচিত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও৷ মেলাগুলো যেন যথাযথ সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে সেজন্য প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন৷ সব জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি মেলা কমিটি থাকা উচিত৷ মেলা আয়োজনের ক্ষেত্রে সেই কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে৷ সরকারি এবং বেসরকারি যৌথ উদ্যোগই পারবে আমাদের মেলাকেন্দ্রিক একটি ঐতিহ্যবাহী সুস্থ বিনোদনধারা ফিরিয়ে আনতে৷ এই ধরনের বিনোদন মাধ্যম আমাদের তরুণ সমাজকেও বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করবে৷
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক, ‘তরুপল্লব' পত্রিকার সাধারণ সম্পাদক