উপায় থাকলে নরেন্দ্র মোদীকে বলতাম, ‘‘ভারতে কয়েক কোটি আধুনিক টয়লেট তৈরির উদ্যোগ নিন৷ '' আর সালমান খানকে বলতাম, ‘‘ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় নামার আগে আসল ময়লা-আবর্জনার দিকে নজর দিন৷'' বলার সাধ্য নেই, তাই তাঁদের প্রশংসা করছি!
বিজ্ঞাপন
মাননীয় নরেন্দ্র মোদী, যে দেশে মোবাইল ফোনের চেয়ে টয়লেট অনেক কম, সে দেশকে ‘স্বচ্ছ' করতে আপনি ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নেমেছেন৷ যে দেশের অনেক মানুষ টয়লেট, অর্থাৎ শৌচাগার ও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব আর দারিদ্র্যের কারণে বনে-বাদাড়েও শৌচকর্ম সারছে, সে দেশের ঘরে ঘরে শৌচাগারের ব্যবস্থা করার আগে রাস্তা সাফ করছেন৷ ভালোই তো!
নরেন্দ্র মোদী, আপনার দল বিজেপি ‘ধর্মনিরপেক্ষতার দেশ' ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বেশি পক্ষপাত দেখানোর অভীপ্সা ব্যক্ত করেই ক্ষমতায় এসেছে৷ সেই সুবাদে আপনি হয়েছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশটির প্রধানমন্ত্রী৷ গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে শৌচাগারের চেয়ে ঝাড়ুকে অগ্রাধিকার দেয়া আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার৷
শুধু ভারতবাসী নয়, বিশ্ববাসীরই সৌভাগ্য যে ভারতে রাজতন্ত্র নেই, হবুচন্দ্র নামে কোনো রাজাও নেই৷ থাকলে তিনিও যে ধূলিময় দেশকে পরিষ্কার করতে সবাইকে ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নামতে বলেছিলেন সেই ‘আইডিয়া' চুরির অভিযোগে হয়ত আপনার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকতেন৷ মামলা হয়নি৷ বরং সালমান খান আপনার পাশে দাঁড়িয়েছেন৷ স্বাধীনতার ৬৭ বছর পরও ভারত থেকে দারিদ্র্য হঠাতে না পারার হতাশা ভুলতে (!) আরো অনেকেই হয়ত আপনার এই ‘স্বচ্ছ ভারত' উদ্যোগে যোগ দেবেন৷ ধূলি-ঝড় উঠবেনা আশা করি৷ সে আশঙ্কা থাকলে এতদিনে পরিবেশবাদীরা নিশ্চয়ই প্রতিবাদের ঝড় তুলতেন৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
তেমন ঝড় তো ওঠেইনি, উলটে বলিউড তারকা সালমান খান ঝাড়ু হাতে সদলবলে নেমে পড়েছেন মুম্বইয়ের রাস্তায়৷ এ কারণে একটা সত্য এতদিনে দিনের আলোর মতো ‘স্বচ্ছ' হয়ে গেল৷ সালমান খান নায়ক হলে আপনি মহানায়ক!
সালমান, মানে ‘সল্লু' আর আপনার মধ্যে বড় একটা মিল আছে৷ দুজনের অতীতেই এমন কিছু আছে যেসব নায়কোচিত তো নয়ই, বরং খলনায়কোচিত৷ মাত্র একটা করে বলি৷ সালমান এখনো বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির এক প্রাণী-হত্যা মামলার আসামী৷ বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে৷ আপনি সরাসরি হত্যা করেননি৷ তবে যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করায় উদ্যোগী না হয়ে মানুষ হত্যায় ভূমিকা রাখার অভিযোগ উঠেছিল৷ এখনো সে মামলার আসামী আপনি৷
সালমানের অভিনয় এবং আপনার রাজনীতি – দুটোর একটাও আমার পছন্দের তালিকায় নেই৷ অভিনয় তেমন বুঝিনা৷ রাজনীতি করিনা৷ তবু কেন যেন মনে হচ্ছে, ভারতকে পরিষ্কার করার কথা বলে আপনি হিন্দুত্ববাদের ‘ঝাণ্ডা' আরো উঁচুতে ওড়ানোর পাঁয়তারা করছেন৷ অন্যদিকে সালমান, ঝাড়ু হাতে রাস্তারও নায়ক হয়ে প্রচারের আলো নিজের দিকে টানছেন৷
প্রচারলিপ্সু অভিনেতা-অভিনেত্রী মডেল, নৃত্যশিল্পী ভারতে অনেক এসেছে৷ প্রতিমা বেদী নগ্ন হয়ে মুম্বইয়ের জুহু বিচে দৌড়িয়েছিলেন চল্লিশ বছর আগে৷ সালমান তো কাপড়-চোপড় পরে নেমেছেন!
মোদীর এই সাফাই অভিযানে ভারত থেকে কি সত্যিই ‘ধূলো' দূর হবে? নাকি ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নেমে সালমান খান শুধু নরেন্দ্র মোদীর ‘হিন্দুত্ববাদী ঝাণ্ডা'-টাই ওপরে তুলে যাবেন?