সাংবিধানিক অধিকার আর বাস্তবতা খুব কম দেশেই পুরোপুরি এক থাকে৷ যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েড নিহত হওয়ায় যারা সে দেশে সবার সাংবিধানিক সমানাধিকারের বিষয়টি তুলে ধরে বিস্ময় প্রকাশ করছেন, তারা মনে হয় সেই কথাটা মনে রাখছেন না৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS/Orange County Register/S. Reingewirtz
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রে অশ্বেতাঙ্গদের অধিকার সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করার বেলায় সংবিধান আর মাঠ পর্যায়ের বৈপরিত্য তো আরো বিব্রতকর, আরো লজ্জার৷ এবং সেটা যুগ যুগ ধরে৷
দুঃখ তো তাঁর এই ছিল যে, ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকে বক্সিংয়ে সোনা জিতেছেন, কিন্তু শুধু গায়ের রং কালো বলে একটা রেস্তোরাঁয় কাজ করার সুযোগ পাননি৷ রেস্তোরাঁ মালিক সোজা বলে দিয়েছিলেন, ‘‘এখানে শুধু সাদারা কাজ করে৷’’
তখনও তিনি অবশ্য ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মোহাম্মদ আলী হননি৷ ভিয়েতনাম যুদ্ধে না যাওয়ায় শাস্তি পাওয়া, হেভিওয়েট বক্সিংয়ের বিশ্ব খেতাব হারানো এবং তারপর একে একে তিনবার হারিয়েও আবার খেতাব জিতে সর্বকালের সেরা বক্সার হওয়া তো আরো পরের ঘটনা৷
ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র লাইট ওয়েটে অলিম্পিক সোনা জিতেছিলেন, তারপর হেভিওয়েটে সেরা হয়েছেন, মুসলমান হয়ে নতুন নামে তুলে ধরেছেন নিজেকে, বক্সিং ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে, এমনকি তাঁর সংগ্রামমুখর বর্নীল জীবনের অবসানও হয়েছে ২০১৬ সালে৷ ৭৪ বছরের জীবনে মোহাম্মদ আলী যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে দেখে যেতে পেরেছেন, কিন্তু তৃণমূলে সব নাগরিকের মুখে সমান অধিকার উপভোগের হাসি দেখে যেতে পারেননি৷
আশীষ চক্রবর্ত্তী, ডয়চে ভেলেছবি: DW/T. Mehedi
সবার মুখে এমন হাসি ফোটানোর জন্যই খুব লড়ছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র৷ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত যোদ্ধা নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে৷ ঠিক চার বছর পর এক সকালে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটু নির্মল বাতাস গায়ে মাখতে গেলেন, গালে এসে লাগলো গুলি৷ সেই গুলিতেই জীবন শেষ৷ অহিংস আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থি জেমস আর্ল রে-র গুলিতে জীবন দিয়ে জানিয়ে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের বিষবৃক্ষ কত হৃষ্টপুষ্ট৷
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ নতুন নয়৷ ওবামার আমলেও তার ভুরি ভুরি নজির দেখা গেছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে তা আরো বেড়েছে৷ না বাড়ার কারণও নেই৷ প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে রাজনীতি শুধুই ভোটে জেতার খেলা৷ তার কথায়, কাজে বিভেদই বাড়ছে৷ গায়ের রংয়ের বা সব ধরনের ভেদাভেদ তুচ্ছ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় প্রেরণা হওয়ার কোনো চেষ্টাই তার নেই৷ বরং উল্টোটা করেছেন, করছেন৷ ট্রাম্পের দেশে সংখ্যালঘুরা, সে কালো, অভিবাসী যা -ই হোক, বেশি ঝুঁকিতে আছেন, আরো বেশি ঝুঁকিতেই হয়ত থাকবেন৷
বর্ণবাদ নিয়ে হলিউডের কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র
‘গ্রিন বুক’ ২০১৯ সালে সেরা চলচ্চিত্রের অস্কার জিতে নিয়েছে৷ কিন্তু বর্ণবাদ নিয়ে এই প্রথম কোনো ছবি আলোড়ন তুললো এমন নয়৷ একই ইস্যুতে হলিউডে এর আগেও চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে এবং প্রশংসা ও পুরস্কার জিতেছে৷ ছবিঘরে দেখে নিন৷
২০১৯ সালের সেরা ছবি: গ্রিন বুক
পিটার ফ্যারেলি পরিচালিত ‘গ্রিন বুক’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ হয়েছে বাস্তব কাহিনির উপর ভিত্তি করে৷ ভিগো মোর্টেনসেন (বামে) একজন গাড়ি চালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, যিনি পিয়ানিস্ট মাহেরসালা আলীকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ রাজ্যগুলোতে ঘুরে বেড়ান৷ তাঁর কাছে থাকে একটি সবুজ রঙের বই, যেখানে সেসব রেস্তোরাঁ আর মোটেলের তালিকা আছে, যেগুলো কেবল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য৷
ছবি: picture alliance/AP/Universal/P. Perret
‘ব্ল্যাকক্ল্যান্সম্যান’ এর জন্য অস্কার
বেস্ট অ্যাডাপটেড স্ক্রিনপ্লে’র জন্য চলতি বছর অস্কার জিতেছে এই ছবিটি, যেটাতে বর্ণবাদকে উপজীব্য করা হয়েছে৷ পরিচালক স্পাইক লি সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন৷ ৭০ এর দশকে একটি গ্যাং-এর কর্মকাণ্ড তদন্ত করেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশ৷ এই ঘটনা নিয়েই সিনেমার কাহিনি গড়ে উঠেছে৷
ছবি: D. Lee/F. Features
‘ব্ল্যাক প্যান্থার’
চলতি বছরে অস্কার পাওয়া চলচ্চিত্রের মধ্যে এটি তৃতীয় ছবি, যা বর্ণবাদের সঙ্গে যুক্ত৷ ২০১৮ সালে মার্ভেলের চলচ্চিত্র ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ প্রথমবারের মতো কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরোদের জনসমক্ষে এনেছে৷
ছবি: picture-alliance/Marvel Studios
‘মিসিসিপি বার্নিং’ ভেঙে দেয় সব ট্যাবু
১৯৮৮ সালে অ্যালেন পার্কারের মুভি ‘মিসিসিপি বার্নিং’-এ তিন সমাজকর্মীর অন্তর্ধানের গল্প বলা হয়েছে৷
ছবি: ORION PICTURES CORPORATION
‘ইনভিকটাস’
২০০৯ সালে ইস্টউড দ্বিতীয়বারের মতো বর্ণবাদকে তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেন৷ ‘ইনভিকটাস’ খেলা নিয়ে একটি কাহিনি, যেখানে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় রাগবি দলের গল্প বলেছেন৷ জার্মান ভাষায় এই চলচ্চিত্রের নাম ‘শত্রুরা যেভাবে বন্ধু হলো’৷ এই চলচ্চিত্রে নেলসন ম্যান্ডেলার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মর্গ্যান ফ্রিম্যান৷
ছবি: AP
‘দ্য বাটলার’
বর্ণবাদ নিয়ে শিক্ষণীয় চলচ্চিত্র এটি৷ ২০১৩ সালের এই ছবিতে ফরেস্ট হোয়াইটেকার এবং অপরাহ উইনফ্রে অভিনয় করেছেন৷ এই চলচ্চিত্রে আফ্রো-অ্যামেরিকান বাটলার ইউজেন অ্যালেন-এর গল্প বলা হয়েছে, যিনি আট জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের অধীনে কাজ করেছিলেন৷
ছবি: picture alliance/AP Images
‘টুয়েলভ ইয়ার্স আ স্লেভ’
২০১৩ সালে মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি এবং সে বছর সেরা ছবির অস্কার জিতে নেয়৷ যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীতদাস প্রথা নিয়ে নির্মিত এটি৷ ব্রিটিশ পরিচালক স্টিভ ম্যাককুইন এই চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত অভিনেতাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন৷
ব্যারি জেনকিন্স পরিচালিত ‘মুনলাইট’ চলচ্চিত্রে আফ্রো-অ্যামেরিকান এক ব্যক্তির গল্পকে তিন অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে৷ এই ছবির সিনেমাটিক কাজ অসাধারণ৷ ফলে কোনো ধরণের মেলোড্রামা ছাড়া এই ছবির মূল উপজীব্য উপস্থাপিত হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/D. Bornfriend
‘আই অ্যাম নট ইওর নিগ্রো’
গত কয়েক দশক ধরেই বলিউডে বর্ণবাদকে ইস্যু করে চলচ্চিত্র, এমনকি তথ্যচিত্র নির্মাণ হয়েছে৷ হাইতির পরিচালক রাউল পেক ২০১৬ সালে অসাধারণ একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন যার নাম ‘‘আই অ্যাম নট ইওর নিগ্রো’৷