ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সুরাবায়া-র মেয়র ত্রি রিসমাহারিনী৷ দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য জনপ্রিয়তা পেলেও একটি ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তিনি৷ আর তা হলো শহরের যৌনপল্লী উচ্ছেদ৷
বিজ্ঞাপন
৭০'এর দশকে সুরাবায়ায় গড়ে ওঠে ‘ডলি' নামের যৌনপল্লীটি৷ এটির অবস্থান সুরাবায়া শহরের ঠিক মধ্যেখানে৷ স্থানীয় এনজিও ইয়াইয়াসান আবদি আসিহ জানিয়েছে সেখানে অন্তত ৬০টি বাড়ি রয়েছে এবং অন্তত শতাধিক যৌনকর্মী কাজ করে৷ এরই প্রতিবেশী এলাকা জারাকেও এক হাজারের বেশি যৌনকর্মী ছোট ছোট যৌন পল্লীতে কাজ করে৷
এই এলাকা দুটো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় ‘রেড লাইট' এলাকা হিসেবে পরিচিত৷ অথচ মুসলিম অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়ার ঐ এলাকাটিতে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত ইসলামিক বোর্ডিং স্কুল রয়েছে৷ আগের সব মেয়র নির্বাচনের আগে যৌনপল্লীগুলো উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় আসার পর তা কার্যকর করেনি৷
৫২ বছর বয়সি রিসমাহারিনী ২০১০ সালে মেয়র নির্বাচিত হন৷ পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির ফলে এরই মধ্যে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি৷ রিসমাহারিনী বিশ্বাস করেন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি সক্ষম৷ কেননা এরই মধ্যে ঐ এলাকার তিনটি ছোট যৌনপল্লী বন্ধ করেছেন তিনি এবং ডলি-র সব ধরনের যৌনব্যবসা বন্ধের জন্য এ বছরের ১৯শে জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন৷ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে তিনি জানান, ‘‘ডলি বন্ধ করা খুব চ্যালেঞ্জের কাজ এবং আমি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চাই৷''
২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৬৫০ যৌনকর্মীকে সুরাবায়া সরকার রান্না শেখা, পার্লার ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যাতে তারা ঐ পেশা ছেড়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারে৷ ঐ ব্যবসা পুরোপুরি ছেড়ে যাতে অন্য কোন ব্যবসা শুরু করতে পারে তাই অনেককে ৩০ লাখ রুপিয়া করে দেয়া হয়েছে৷
তবে ডলি-র এক যৌনকর্মী মিমি জানালেন, ঐ অর্থে কোনো ব্যবসা চালু করা সম্ভব নয়৷ তিনি একটি খাবারের দোকান দিতে চান এবং এজন্য তার প্রয়োজন ১০ কোটি রুপিয়া৷ প্রতি রাতে তাঁর কাছে ৭ থেকে ১০ জন কাস্টমার আসে এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে ১১ ডলারের মত আয় হয় তার৷ এর থেকে যৌনপল্লীর মালিককে দিতে হয় অর্ধেক অর্থ৷ কিন্তু তারপরও তিনি এ ব্যবসা ছাড়তে রাজি নন৷ কেননা তার একটি ৬ বছর বয়সি মেয়ে আছে, যে নানা-নানীর কাছে বড় হচ্ছে এবং তার ভরণপোষণের জন্য যে অর্থ পাচ্ছে, এই ব্যবসা ছেড়ে দিলে তা পাবে কিনা সেই ভরসা নেই৷ মিমি-র মত আরো অনেক যৌনকর্মীর একই বক্তব্য৷
বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের কথা
পৃথিবীর আদিম এক পেশা পতিতাবৃত্তি৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চালু রয়েছে এই পেশা৷ বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? এই ছবিঘরে তাঁদের অবস্থা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যেভাবে যৌনপল্লীতে আগমন
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে হাজির হন মেয়েরা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিদরিদ্র্য পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা৷ এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের যৌনপল্লীতে আনা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir uz ZAMAN
যৌনকর্মীদের জন্য ‘গরুর ট্যাবলেট’
ফরিদপুরের সরকার অনুমোদিত যৌনপল্লীর ছবি এটি৷ অভিযোগ রয়েছে, পল্লীর মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করেন, যা সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়৷ গরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘ইনজেকশন’
বাংলাদেশের এক যৌনপল্লীর মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়৷ কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়৷ অপ্রাপ্তবয়সিদের স্বাস্থ্য ভালো করতে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় বলে জানান ৫০ বছর বয়সি রোকেয়া৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
অধিকাংশ যৌনকর্মী ‘স্টেরয়েড আসক্ত’
আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থা একশনএইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে৷ তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর৷ বাংলাদেশে দু’লাখের মতো যৌনকর্মী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ
স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একশনএইড৷ সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, ‘‘ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়৷’’
ছবি: GMB Akash
এইচআইভি সংক্রমণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস রোগ হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় প্রকাশ হয়৷ তবে ঠিক কতজন যৌনকর্মী এইচআইভি আক্রান্ত তার হালনাগাদ কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি৷ অনেকক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে খদ্দেরের অনীহা যৌনকর্মীদের মাঝে যৌনরোগ ছড়াতে সহায়ক হচ্ছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ যৌনকর্মী
বাংলাদেশের যৌনপল্লীগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে৷ আর এই পেশায় যাঁরা একবার প্রবেশ করছেন, তাঁদের জীবনেও নানা ঝুঁকি থাকে৷ পতিতাপল্লীতে হামলার খবর কিন্তু মাঝেমাঝেই শোনা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
শত বছরের পুরনো পল্লী উচ্ছেদ
মাদারিপুরের পতিতাপল্লীটি ছিল শত বছরের পুরনো৷ গত বছর এই পল্লী উচ্ছেদ করেছেন স্থানীয়রা৷ এমনকি পল্লীটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের আদেশও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ সেখানে পাঁচশ’র মতো যৌনকর্মী বাস করতেন৷ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের একটি পতিতাপল্লীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এ রকম উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছেন আরো অনেক যৌনকর্মী৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
মধ্যপ্রাচ্যে ‘যৌনদাসী’ বাংলাদেশের মেয়েরা!
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা৷ এ সব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
9 ছবি1 | 9
এনজিও কর্মী লিলিক সুলিসটিওয়াতি জানালেন, এ সব যৌনপল্লীর কর্মীদের স্থানীয় ক্লিনিকে মাসে একবার রুটিন স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হয়৷ কিন্তু কয়েকটি যৌন পল্লী বন্ধ করে দেয়ায় এদের অনেকেই এখন হোটেলে বা গাড়িতে যৌন ব্যবসা করে, যার ফলে এইচআইভি-সহ অনেক রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, কেননা এরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করায় না৷
রিসমাহারিনী বলেছেন, ‘‘একজন নেতা হিসেবে এই যৌনকর্মীদের কাজকে আমি ঘৃণার চোখে দেখি না৷ আমার কাছে সবচেয়ে বড় বিষয় হল যৌনকর্মীদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ৷ কারণ তারা সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার৷'' তিনি বলেন, তার সরকার এখন নজর দিচ্ছে যাতে হোটেল ও গাড়িতে বিনামূল্যে জন্মনিরোধীকরণ ওষুধ ও কনডমের ব্যবস্থা রাখা হয়৷ সেইসাথে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি ৷