নতুন বছর শুরু হতে না হতেই ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির খবর এলো ভারতের ‘হাই-টেক' শহর বেঙ্গালুরু থেকে৷ সেখানে এবার গণহারে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছে নারীরা৷ কর্নাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এরপরও পশ্চিমা বিশ্বকেই দায়ী করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের পশ্চিমা মনোভাব ও পোশাক-আশাকই নাকি যত নষ্টের গোড়া৷ নববর্ষের উৎসবে হাত-কাটা, খোলামেলা পোশাক পরাটাই নাকি তাঁদের উচিত হয়নি! কিন্তু সত্যিই কি তাই? পোশাক আধুনিক হলে, লম্বায় ছোট হলেই কি সেই নারীর চরিত্র খরাপ হয়ে যায়? স্বাভাবিকভাবেই ভারতের আপামর জনসাধারণ তা মেনে নেয়নি৷ তাঁরা বরং সেই মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন৷ অন্যদিকে ঘটনার দিন আদৌ কী হয়েছিল, তা নিয়ে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া' পত্রিকাও প্রকাশ করেছে একটি সিসিটিভি ফুটেজ৷
এক পাঠকের পাঠানো ১লা জানুয়ারি ভোরের ঐ ফুটেজে দেখা যায়, রাতের রাস্তায় একজন তরুণী একা একা যাচ্ছিলেন৷ সে সময় হঠাৎ পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেলে করে দুই ব্যাক্তি তাঁর সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ায়৷ তারপর একজন তাঁকে জোর করে জড়িয়ে ধরে৷ সারা শরীর হাতড়াতে থাকে, হাত দেয় এখানে-ওখানে৷ তরুণীটি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন৷ কিছুক্ষণ পর তাঁকে রাস্তায় আছড়ে ফেলে চলে যায় ঐ দুই ব্যক্তি৷
ভারতের তথ্য-প্রযুক্তির রাজধানী হিসেবে খ্যাত বেঙ্গালুরুতে নববর্ষের উৎসবে নারীদের শ্লীলতাহানির এমন ভয়ংকর ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঝড় তুলেছে৷ কর্নাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি পরমেশ্বর এসব শ্লীলতাহানির অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘কোলাহলপূর্ণ এলাকায় এসব হয়েই থাকে৷''
ওদিকে বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার পারভিন সুদ বলেন, তাঁর দল গণহারে শ্লীলতাহানির উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পেয়েছে৷ এ ঘটনায় পুলিশ নীরবে কাজ করছে বলেও জানান তিনি৷ কিন্তু একটা সুস্থ সমাজের জন্য যেটা চিন্তার বিষয়, সেটা হলো মেয়েদের আর্তিতেও কান দেয়নি প্রত্যক্ষদর্শীরা৷ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি কেউ৷
প্রশ্ন হলো, কেউ যদি দুর্বৃত্তদের মুখোমুখি না দাঁড়ান, প্রতিরোধ না গড়েন, তাহলে নারীরা যাবেন কোথায়?
ছোট পোশাক পরাই কি ধর্ষণের কারণ?
ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ যখনই এ ধরনের কোন মামলা আদালতে উঠেছে তখন প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, ধর্ষণের শিকার ঐ নারী কি ধরনের পোশাক পরেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুগের সাথে পোশাক
যুগে যুগে পোশাকের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ আদিমকালে ছিল পশুর চামড়া, গাছের ছাল আর এখন রয়েছে নানা ধরনের পোশাক৷ বর্তমানে দেশ, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরন, অনুষ্ঠান, পছন্দ ও ফ্যাশানের ভিত্তিতে বহু ধরনের পোশাক পরে থাকেন নারীরা৷
ছবি: AP
শরীর প্রদর্শন মানেই কি ধর্ষককে আমন্ত্রণ?
ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় দেখা গেছে, ধর্ষিতা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরেছিলেন৷ অর্থাৎ যাকে বলা হয় ভারতীয় নারীর আদর্শ পোশাক, সে ধরনের পোশাকই তাঁরা পরেছিলেন৷ অর্থাৎ এ জরিপ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীর প্রদর্শন না করে বা তথাকথিত ‘আধুনিক’ পোশাক না পরেও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷
ছবি: Reuters
আইনের ভয় নেই
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷
ছবি: Fotolia/DW
ধর্ষণ যখন বিনোদনের মাধ্যম
ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এর কারণ হিসেবে পুলিশ নারীদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার ও ছোট পোশাক পরিধানকে উল্লেখ করেছে৷ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পুলিশ বলেছে, সেখানকার পুরুষরা তাদের বিনোদনের অভাব পূরণ করছে ধর্ষণের মাধ্যমে৷
ছবি: dapd
নারীদের দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার
রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
ছবি: UNI
পরিচিতদের দ্বারাই বেশি ধর্ষণ
২০১৩ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, সে বছর ১০০ জন ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে ৯৮ জন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাঁদের পরিচিত৷ আদালতে যেসব মামলা ওঠে, বা গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলো বেশিরভাগই বাইরের লোকের হাতে৷ ফলে পরিচিত ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/Ahmad Masood
যৌন নিগ্রহ সর্বত্র
ভারতে জন্মের আগে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও, খুব সাধারণ ঘটনা৷ ফলে পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা এত কম যে, সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাতে হেরফের হয়৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মৃত্যুবরণ করছেন নারীরা৷ পরিবারের ভেতরেও চলে যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ৷ এরপরও কি আপনারা ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করবেন?