প্রচলিত প্রথা মেনে অল্পবয়সি মেয়েদের জোর করে খাওয়ানো! এবং তা ভবিষ্যতে দুরারোগ্য রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ না জেনেই পশ্চিম আফ্রিকার মৌরিতানিয়ার মেয়েরা এমনই বিপদের কবলে!
বিজ্ঞাপন
রীতিটাই এমন! পাত্রী বড়োসড়ো, হৃষ্টপুষ্ট না হলে তার বিয়ে হয় না! অন্ততপক্ষে পাত্রীকে বিবাহযোগ্যা করে তোলার জন্য পরিবারের অন্যান্যদের সে কী আয়োজন!
পশ্চিম আফ্রিকার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, তথাকথিত মোটাসোটা ওজনদার মহিলাই ভালো স্বামী পাওয়ার যোগ্য৷ তাই যেনতেনপ্রকারেণ মহিলাকে ওজনদার বানানো চাই-ই৷ দরকার হলে জোরপূর্বক খাইয়ে! আর এ জন্য এখানকার মহিলারা ডায়বেটিস, হার্টের অসুখ এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগতে শুরু করেছেন৷
মৌরিতানিয়ার সাদো ইসেলমো এমনই একজন মহিলা যিনি এই প্রচলিত কুপ্রথার শিকার৷ নিজের শৈশব নিয়ে ইসেলমোর অভিজ্ঞতা বেশ ভীতিপ্রদ৷ মাত্র সাত বছর বয়সেই তাঁকে তাঁর বাবা মা রোজ দু'বালতি পোরিজ খাওয়ানো শুরু করেন৷ কারণটা আর কিছুই না, যাতে শরীরের বিকাশ খুব দ্রুত হয় এবং পাত্রপক্ষ অতি সহজেই তাঁকে পছন্দ করেন৷ ইসেলমো এই জোর করে গলাধঃকরণ করার পদ্ধতিটিতে খুব বিরক্ত হতেন৷ এমনকি প্রায়ই খাবারদাবার ফেলে দিতেন৷ ইসেলমো জানালেন, রোজ তাঁকে জির্ক নামে একপ্রকার দুধ, জল এবং চিনির সমন্বয়ে তৈরি পানীয় খাওয়ানো হতো, যাতে তাঁর হজম ক্ষমতা বাড়ে৷ অতিরিক্ত মোটা বানানোর জন্য অধিক তেল, মাখন দিয়ে একটা আস্ত মেষ রান্না করে রাখতেন ইসেলমোর মা৷ সারা সপ্তাহ ধরে তাঁকে সেটা শেষ করতে হত৷ আর ইসেলমো এ সবের কার্যকারিতা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন৷ কারণ মাত্র চার মাস পরেই তিনি এত মোটা হয়েছিলেন যে নিজের কোনও জামাকাপড়েও আঁটেননি এবং হাঁটাহাঁটির ক্ষমতাটুকু হারিয়েছিলেন৷
অতিরিক্ত ওজন বাড়া বন্ধ করতে চিনির দাম বাড়াবে জার্মানি
অনেক দেশের মতো জার্মানিতেও অতিরিক্ত মোটা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা নিঃসন্দেহে ডায়বেটিস, হৃদরোগ বা ক্যানসারের জন্য হুমকিস্বরূপ৷ তাই তো মিষ্টি খাবার ও পানীয়তে ‘ট্যাক্স’ বা কর বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা৷
ছবি: imago/imagebroker
দু’শ কোটিরও বেশি মানুষ অতিরিক্ত মোটা
বিশ্বে যাঁদের ওজন অতি দ্রুত কমানো প্রয়োজন, তাঁদের সংখ্যা আকাশচুম্বী৷ হ্যাঁ, এ কথাই জানিয়েছেন একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল৷ তাঁরা জানিয়েছেন, সারা বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষই অতিরিক্ত ওজনের সমস্যায় ভুগছেন৷
ছবি: dpa
সমীক্ষার ফলাফল
স্বাস্থ্যকর খাবারের ওপর ‘কম’ কর এবং অস্বাস্থ্যকর বা মিষ্টি জাতীয় খাবার ও পানীয়তে করের পরিমাণ বাড়ালে মানুষের অতিরিক্ত ওজন বাড়া বন্ধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন জার্মানির অর্থনীতিবিদ টোবিয়াস এফের্টস৷ এ তথ্যটি বেরিয়ে এসেছে জার্মানির অতিরিক্ত ওজন বা ‘ওবিসিটি’ সোসাইটি ও ‘ডায়বেটিস সোসাইটি’-র অনুরোধে করা এক গবেষণা থেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Media for Medical
স্বাস্থ্যকর খাবারে কম কর, অস্বাস্থ্যকর খাবারে বেশি
স্বাস্থ্যকর খাবার, অর্থাৎ সবজি ও ফলজাতীয় খাবার থাকবে করমুক্ত৷ এছাড়াড নুডলস, দুধ ও মাংসে থাকবে আগের মতোই শতকরা ৭ ভাগ কর৷ কিন্তু চিনি ও চর্বিযুক্ত খাবারে কমপক্ষে শতকরা ১৯ ভাগ এবং চিনি যুক্ত পানীয় বা সফটড্রিকংস-এ ২৯ শতাংশ ‘ট্যাক্স’ চাপানোর কথা বলা হয়েছে গবেষণায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ওজন বাড়ার পরিবর্তে ১০ ভাগ কমতে পারে
জার্মানির প্রায় অর্ধেক মানুষেরই ওজন নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি৷ তাই বিভিন্ন খাবারে কর বাড়ানো আর কমানোর পরিকল্পনাটি যদি সত্যিই প্রয়োগ করা হয় তাহলে যাঁদের অতিরিক্ত ওজন, তাঁদের ওজন আর ‘না’ বাড়ার বদলে ১০ ভাগ কমতে পারে বলে জানান অর্থনীতিবিদ টোবিয়াস এফের্টস৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hesse
রবার্ট কখ ইন্সটিটিউট
জার্মানির রবার্ট কখ ইন্সটিটিউট জানায়, ইতিমধ্যে জার্মানিতে নাকি প্রতি চার থেকে পাঁচজনেরই ওজন বেশি৷ বিশেষ করে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের৷ বলা বাহুল্য, দিনের পর দিন এদের কিনা হার্ট, ডায়বেটিস ও ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়েই চলেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Gambarini
মিষ্টি পানীয়তে কর বাড়িয়েছে যে সব দেশ
ফ্রান্স কিন্তু অতিরিক্ত ওজন বাড়া বন্ধ করতে ২০১২ সাল থেকেই মিষ্টি পানীয়তে কর বাড়িয়ে দিয়েছে৷ আর ব্রিটেনে আগামী ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে মিষ্টি পানীয়র ওপর কর ধার্য করা হবে বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মিষ্টি জিনিসের মূল্য বাড়নো হোক
ডায়বেটিস সোসাইটিও চায় চিনির তৈরি খাবার বা মিষ্টি পানীয়র ওপর কর বাড়ানো হোক৷ তারা মনে করে, এর মধ্য দিয়ে ডায়বেটিস টাইপ-টু রোগীর সংখ্যা কমানো সম্ভব৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনি ওজন বাড়ায়
চিনি শরীরে শক্তির চেয়ে দুই থেকে পাঁচগুণ তাড়াতাড়ি চর্বি তৈরি করে৷ অর্থাৎ চিনি খাওয়া মানে শরীরের ফ্যাট কোষগুলোকে সরাসরি খাবার দেওয়া৷ যার ফলে আপনার শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে টাইপ-টু ডায়বেটিস হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J.Kalaene
অতিরিক্ত ওজন শুধু শারীরিক সমস্যা নয়!
যে মানুষটির ওজন অতিরিক্ত, তাঁর যে শুধু শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা বা ডায়বেটিস, ক্যানসার এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে, তা নয়৷ শিশুরা অতিরিক্ত ওজনের কারণেই স্কুলে মবিং-এর শিকার হয়, যা একসময় মানসিক রোগেরও রূপ নিতে পারে৷ এমনটাই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: picture alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
এই জোরপূর্বক খাওয়ানোর পদ্ধতির সাফল্য হিসেবে ইসেলমোর বিয়ে হয়েছিল মাত্র ১৩ বছর বয়সে৷ এক বছর পরে তিনি এক সন্তানের মাও হয়ে যান৷ কিন্তু চল্লিশে পা দিয়ে তিনি টাইপ টু ডায়বেটিসের শিকার,মাত্রাতিরিক্ত মোটা৷
ঘটনাচক্রে ইসেলমো একা নন, বহু মহিলাই এমন পরিস্থিতির শিকার৷ এমন জোরপূর্বক খাওয়ানোর ফলে সাধারণভাবে আট বছরের বালিকারা ১৪০ কেজির কাছাকাছি দাঁড়ায়৷ ধরেই নেওয়া হয়, মহিলাদের ওজনের মাপকাঠিটা ২০০ কেজি, নইলে পাত্রপক্ষের চোখে পড়বেন না! কিন্তু অল্পবয়সেই এই অস্বাভাবিক ওজনের জন্য হৃৎপিণ্ডে অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং তা শরীরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে৷
মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলি এই প্রথার বিপক্ষে জানিয়েছেন, বালিকাদের দ্রুত বয়ঃসন্ধির দিকে ঠেলে তাঁদের বেশি নারীসুলভ দেখানোর এই প্রথা বাল্য বিবাহেরই সমতুল৷ স্থানীয় নারী অধিকার সমিতির তরফে অ্যামিন মিন্ট মোক্তার বলেন, ‘‘মৌরিতানিয়ার পুরুষেরা হৃষ্টপুষ্ট মহিলাদেরই বেশি পছন্দ করেন৷ তাঁরা মনে করেন, এটা তাঁদের সৌভাগ্যের প্রতীক এবং এ ধরনের স্বাস্থ্যবতী মহিলারা ভালো স্ত্রী হবেন৷''
ডায়েটিং সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা
স্বাস্থ্য সম্পর্কে আজকাল অনেকেই সচেতন হয়ে উঠছেন৷ তাই অনেকেই ওজন কমাতে চান৷ কিন্তু দেখা যায়, কম খেয়ে বা ভুল ডায়েটিংয়ের কারণে তাদের ওজন কমাছে না৷ ছবিঘর-এ থাকছে ওজন কমানোর সহজ কিছু টিপস৷
ছবি: Fotolia/rico287
সকালের নাস্তায় তাড়াহুড়ো নয় !
সকালে অনেকেই তাড়াহুড়ো করে কিছু মুখে দিয়ে বের হয়ে যান৷ তা না করে ঘুম থেকে উঠেই এক চাপ হালকা চা বা কুসুম গরম পানি পান করে নিন ৷ কিছুক্ষণ পরে সিরিয়াল, ডিম এবং বড় দুই কাপ চা বা কফি পান করে নিন৷ কারণ, রাতে শরীর থেকে যে তরল চলে গেছে তা ফিরিয়ে আনতেই সকালে যথেষ্ট পরিমাণ তরল পান করা প্রয়োজন৷
ছবি: Colourbox
দুপুরের খাবার বাদ নয় কিন্তু !
দুপুরের খাবার বা এক বেলা না খেলেই ওজন কমবে –এ ধারণা অনেকেরই, যা পুরোপুরি ভুল বলে জানান বিশেষজ্ঞরা৷ সকালের নাস্তার পর চার পাঁচ ঘন্টা না খেলে বিকেলে ভীষণ খিদে পায়, তখন কেউ কেউ চকলেট বা মিষ্টি কিছু খেয়ে ফেলেন৷ তাই পরামর্শ, দুপুরে অল্প পরিমাণে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার খাওয়াই শ্রেয়৷
ছবি: DW/K.Safronova
রাতে চর্বিযুক্ত খাবার নয়!
ডায়েটিং করতে যেয়ে অনেকে দুপুরে না খেয়ে রাতে বেশি পরিমাণে ফ্যাটযুক্ত খাবার খেয়ে ফেলেন৷ এতে আসলে পুরো ডায়েটিংই বিফলে যায়৷ বরং যেসব ক্যালোরি রাতে সহজে বার্ন হয় অর্থাৎ ডিনারে মাছ, ডিম, সবজি, ছানা, দই ইত্যাদি প্রোটিনযুক্ত খাবারই খাওয়া উচিত বলে জানান স্বাস্থ্য বিষয়ক এক্সপার্ট৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
যথেষ্ট হাঁটা-চলা করতে হবে
হাঁটাহাটি না করে শুধু কম খেয়ে বা একবেলা না খেয়ে ওজন কমানো কোনোভবেই সম্ভব নয়৷ রাতে খাওয়ার পর খানিক্ষণ হাঁটুন৷ এর ফলে ক্যালোরি বার্ন হবে৷ তাছাড়া হাঁটা-হাটি বা ব্যায়াম শুধু ওজনই কমায় না, মানুষকে খুশিও রাখে৷
ছবি: Cornelia Giurgiuman
যথেষ্ট ঘুম প্রয়োজন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় জানা গেছে, যারা রাতে কম ঘুমায় তাদের খাওয়ার রুচি বেশি হয়৷ আর তারা সাধারণত স্লিম, যারা রাতে সাত থেকে নয় ঘন্টা ঘুমান৷ কাজেই যারা ডায়েটিং করছেন, তাদের কিন্তু যথেষ্ট ঘুমানোর কথাটাও মাথায় রাখতে হবে !
ছবি: picture-alliance/beyond/Vladimir Godnik
আধুনিক ডায়েটিং
একই খাবার নিয়মিত খেলে এবং তা পরিমাণে কম হলেও শরীরে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না৷ তাই বিশেষজ্ঞরা, প্রতিদিনের একঘেয়ে খাবার থেকে বেরিয়ে এসে পুষ্টিগুণসম্পন্ন একটু ভিন্ন খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন৷ তা হতে পারে সাদা চালের পরিবর্তে কাউনের চাল বা লাল চাল কিংবা আলু, অথবা মাংসের বদলে ডিম - অনেকটা এরকম৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images GmbH/O. Dietz
6 ছবি1 | 6
কিন্তু এ সব প্রথা মেনে চলার ফলশ্রুতি হিসেবে সমাজে নেমে আসছে বড় সমস্যাও৷ খরা বা অন্যান্য কারণে ফসল উৎপাদন কম হলে, মেয়েকে স্বাস্থ্যবতী গড়ে তোলার জন্য পরিবার শরণ নিচ্ছে রাসায়নিক পদার্থের৷ তখন কর্টিকয়েড বা স্টেরয়েড ধর্মী হরমোন প্রয়োগ করে মেয়ের চেহারার বাহ্যিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলে৷
মোক্তার জানান, ‘‘এ সমস্ত স্টেরয়েড ধর্মী ওষুধপত্র প্রাণীদের ওপর প্রয়োগের জন্যই ব্যবহার হয় সাধারণত৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে মেয়েদের ওপর প্রয়োগ হচ্ছে৷ এটা তো বেশি খাবার খাওয়ানোর থেকেও মারাত্মক৷ আবার বৃষ্টি হলে মাংস এবং দুধের যোগান বাড়লে সেটাও জোর করে খাওয়ানো হবে৷'' এমন জোর করে খাওয়ানোর পদ্ধতিকে তাঁর সংস্থা অপরাধমূলক বলে আখ্যা দিয়েছে৷
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা এখনও রয়ে গিয়েছে৷ তবে শহরাঞ্চলের কর্মরতা মেয়েরা এই ওজন বাড়ানোর ব্যাপারে কান দিতে রাজি নয়৷ কাজ করার দরুণ তাঁরা তাঁদের চলাফেরায় বাধা দিতে নারাজ৷ চাকরি এবং রোজগার মহিলাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সাহস জোগাচ্ছে৷ সেই সঙ্গে তাঁরা নিজেদের মতকেও প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন৷
ফিরে আসা যাক ইসেলমোর প্রসঙ্গে৷ তিনি নিজে শৈশবে যেমনটি দেখে এসেছেন, তেমনটি কিন্তু প্রশ্রয় দিচ্ছেন না মোটেই৷ বরং নিজের দুই মেয়ের ক্ষেত্রে তিনি কখনোই এমন জোরপূর্বক খাওয়াতে চাইবেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘শরীরটা তাদের, আমার নয়৷''
পিএস/ডিজি
প্রতিবেদনটি পড়ে কেমন লাগল তা নীচের মন্তব্যের ঘরে জানান৷