1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মেয়েদের পায়ে পায়ে ‘সাইকেল-বিপ্লব’, বিশ্বে সমাদৃত বাংলাদেশ

সমীর কুমার দে ঢাকা
২১ অক্টোবর ২০২২

শীতের সকালে ঘন কুশায়া ভেদ করে বাইসাইকেল চালিয়ে একদল কিশোরী ছুঁটে চলেছে স্কুলের পথে৷ উত্তরের জনপদে এমন দৃশ্য এখন খুবই পরিচিত৷ অন্যদিকে দেশের বাইরে ধীরে ধীরে বিপুল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বাংলাদেশের সাইকেল৷

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার কাজী সাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যাচ্ছে কিশোরীরা
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার কাজী সাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যাচ্ছে কিশোরীরাছবি: Ashraful Islam/DW

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন ছোটখাটো এক ‘বাইসাইকেল বিপ্লব’ ঘটে গেছে৷ শুধু স্কুল-কলেজ নয়, চাকরিস্থলে যেতেও ইদানিং অনেকেরই পছন্দ বাইসাইকেল৷ ফলে দেশের বাজারে বাইসাইকেলের চাহিদা অনেক বেড়েছে৷ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন অনেক উদ্যোক্তা৷ 

লালমনিরহাটের ফুলগাছ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা আক্তার জানালেন, তার স্কুলের অধিকাংশ মেয়েই এখন বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে৷ বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার অনুভুতি জানাতে গিয়ে ডয়চে ভেলেতে ফারজানা বলেন, ‘‘আগে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম৷ অনেকদিনই পৌঁছাতে দেরি হয়ে যেতো৷ পা ব্যাথা করতো, এতে রাতে পড়তে সমস্যা হতো৷ এখন স্কুলে যেতে আর দেরি হয় না৷ কষ্টও কম হয়৷’’ ক্লাস ফোর থেকেই বাইসাইকেল চালানো জানলেও সিক্সে উঠার পর বাবা তাকে একটি সাইকেল কিনে দিয়েছেন৷ এখন সব বান্ধবী মিলে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যান ফারজানারা৷

লালমনিরহাটের ফুলগাছ উচ্চ বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী অনন্যা রায়ও সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যান৷ এলাকার অধিকাংশ ছাত্রী সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসায় রাস্তায় তেমন কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না৷ মাঝে মধ্যে কিছু মোটরসাইকেল চালকের কারণে খানিকটা সমস্যা হলেও এমনিতে এলাকার সবাই তাদের এই সাইকেল চালানোকে ভালো চোখেই দেখছেন বলেই ডয়চে ভেলেকে জানান অনন্যা৷ 

লালমনিরহাটের পাটগ্রামের সরকারি জসমুদ্দিন কাজী আব্দুল গনি কলেজে যাচ্ছে কিশোরীরা৷ছবি: Dilip Roy/DW

শুধু লালমনিরহাট নয়, এই চিত্র এখন উত্তরের প্রায় সবগুলো জেলার৷ বিশেষ করে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে৷ যশোরের মনিরামপুরের উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহজাহান আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু উত্তর কেন, দক্ষিণের জেলাগুলোতেও কিশোরীরা এখন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসছে৷ আমার স্কুলে তো ৯০ শতাংশ মেয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে৷ আশপাশের এলাকাগুলোর চিত্রও একই রকম৷’’

ছাত্রীদের ঝরে পড়া ঠেকাচ্ছে সাইকেল

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থানা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগের দশকে উত্তরে শিক্ষায় বিল্পব ঘটে গেছে৷ তবে ঝরে পড়া ঠেকানো যাচ্ছিল না৷ বাইসাইকেল ঝরে পড়ার হার কমিয়ে দিয়েছে৷ কারণ, এই শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের দূরত্ব একটু বেশি৷ ভ্যানে করে যেতে প্রতিদিন তাদের ৪০-৫০ টাকা খরচ করতে হতো৷ এই টাকা অনেকের পরিবারের পক্ষে দেয়া সম্ভব ছিল না৷ খেটে খাওয়া এই মানুষগুলোর উপার্জন খুব বেশি ছিল না৷ তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে গরিব কিন্তু মেধাবী ছাত্রীদের সাইকেল দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ আমি নিজেই গত দুই বছরে সাড়ে ৩শ’ ছাত্রীকে সরকারি উদ্যোগে সাইকেল দিয়েছি৷ অনেকের পরিবার কিনেও দিয়েছে৷ এতে স্কুলে উপস্থিতি অনেক বেড়েছে৷ আগে যেখানে সপ্তাহে দুই-তিন দিন তারা স্কুলে যেতো এখন একদিনও মিস করে না৷ এতে তাদের রেজাল্টও ভালো হচ্ছে৷ ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের পাসের হার এখন বেড়েছে৷’’

উত্তরবঙ্গে সাইকেল শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমিয়েছে: ইউএনও সোহাগ চন্দ্র সাহা

This browser does not support the audio element.

ঠাকুরগাঁওয়ের গিলাবাড়ী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে আফরফুন নেছা৷ তার বাবা রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা আর পিছিয়ে নেই৷ তারাও এখন শিক্ষায় এগিয়ে গেছে৷ বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসা করছে৷ এতে তাদের সময় নষ্ট হচ্ছে না৷ পাশাপাশি বখাটেদের উৎপাত থেকেও রক্ষা পাচ্ছে৷ স্কুলে যেতেও তাদের আগ্রহ অনেক বেড়েছে৷ পাশাপাশি মনোযোগ বেড়েছে লেখাপড়ায়৷’’  

বাইসাইকেল এখন দেশি ব্র্যান্ড

দেশে চাহিদা বাড়ায় মেঘনা গ্রুপ স্থানীয় বাজারের জন্য সাইকেল নিয়ে আসে ২০১১ সালে৷ প্রতিষ্ঠানটি ভেলোস ব্র্যান্ডের সাইকেল বিক্রি করছে৷ এজন্য ‘সাইকেল লাইফ’ ও ‘সাইকেল লাইফ এক্সকুসিভ’ নামে আলাদা বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে৷ সর্বনিম্ন ১২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত দামের সাইকেল রয়েছে তাদের৷

প্রাণ আরএফএল ২০১৪ সালে সাইকেল উৎপাদনে বিনিয়োগ শুরু করে৷ দেশের বাজারের বড় অংশ আমদানিনির্ভর হওয়ায় সম্ভাবনার বিবেচনায় দুরন্ত ব্র্যান্ডের সাইকেল উৎপাদন শুরু করে তারা৷ অল্প সময়ে ব্যাপক সাড়াও পায়৷

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রতি বছর দেশের বাজারে আমরা সাড়ে তিন থেকে ৪ লাখ বাইসাইকেল সরবরাহ করছি৷ এছাড়া আমরা বিদেশে রপ্তানি করছি প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ বাইসাইকেল৷ বিশেষ করে মফস্বলে বাইসাইকেলের চাহিদা দ্রুত গতিতে বাড়ছে৷’’

সাইকেল চালিয়ে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে৷ ছবিটি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চলবলা গ্রাম থেকে তোলা৷ছবি: Dilip Roy/DW

বাংলাদেশ বাইসাইকেল মার্চেন্টস অ্যাসেম্বলিং অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিবিএমএআইএ)-এর সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম জাহিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বংশালে দুই শতাধিক বাইসাইকেল বিক্রির প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ সারাদেশে সাড়ে চার হাজার খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ আগে বিদেশ থেকে আমদানি করে আমরাই সারাদেশে সাইকেল সরবরাহ করতাম৷ এখন দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরুর পর আমাদের গুরুত্ব কমেছে৷ তারাই সারাদেশে সাইকেল সরবরাহ করছে৷ ফলে আমরা এখন স্থানীয় বিক্রেতায় পরিণত হয়েছি৷’’

ইউরোপে রপ্তানি, ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ

মেঘনা ও আরএফএল ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিটা ও করভো নামের প্রতিষ্ঠানের ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে রপ্তানিমুখী সাইকেল তৈরির কারখানা করেছে৷ এসব প্রতিষ্ঠানের বছরে মোট রপ্তানির পরিমাণ ১০ লাখের বেশি৷ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে শুধু বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৮ কোটি ৪২ লাখ ডলার৷

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলছিলেন, আরএফএল রপ্তানি শুরু করে ২০১৫ সালে৷ বর্তমানে ১০ দেশে যাচ্ছে তাদের সাইকেল৷ বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশের সাইকেলের চাহিদা বেশ ভালো৷

বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, এ বছরেই বিশ্ববাজারে সাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশ অষ্টম স্থানে পৌঁছাবে৷ তবে ইউরোপের বাজারে এখন রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে৷ ২০০৯ সালে ইউরোপে নবম স্থানে থাকলেও পরের বছর পঞ্চম স্থানে উঠে আসে৷ এবছর আরো এগিয়ে ইউরোপে সাইকেল রপ্তানিতে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ৷

ঢাকার বংশালে সাইকেল বিক্রির দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছেছবি: Rajib Paul/DW

আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক এ এইচ এম ফেরদৌস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশের বাজারে আমরা বিপণন করি না৷ ইউরোপে রপ্তানি করি৷ বর্তমানে বছরে দেড় লাখ সাইকেল আমরা রপ্তানি করছি৷ তবে কিছু সংকট আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে৷ কিছুদিন আগেও শিপমেন্ট খরচ ছিল দুই হাজার ডলার, এখন সেটা হয়েছে ১৫ হাজার ডলার৷ কস্টিং বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপ চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে৷ আবার সঠিক সময়ে পাঠানোর জন্য কন্টেইনার পাওয়া যাচ্ছে না৷ এতে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাচ্ছে বাইসাইকেল রপ্তানি৷’’

বাইসাইকেল উৎপাদনের শুরুর গল্প

বাংলাদেশে প্রথম বাইসাইকেলের কারখানা করে আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেড৷ ১৯৯০ সালে যখন মালয়েশিয়ায় দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছিল তখন সেখানে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়৷ কারখানায় দক্ষ জনবলের প্রয়োজন৷ অনেক বাংলাদেশি কাজ করতো সেখানে৷ তখন সেখানে ইয়া চ্যাং মিন নামে একজন তাইওয়ানি একটি সাইকেল তৈরির কারখানা চালাতেন৷ সেখানে কাজ করতেন কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিক৷ ইয়া চ্যাং-এর কারখানাটিও তখন শ্রমিক সংকটে পড়েছিল৷ তিনি তার বাংলাদেশি কর্মীদের সাথে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন৷ তখন তারা বাংলাদেশে তার কারখানাটি স্থানান্তর করার পরামর্শ দেন, কারণ, বাংলাদেশে সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়৷ এভাবেই  বাংলাদেশে বাইসাইকেল উৎপাদন শিল্পের সূচনা হয়৷

১৯৯৪ সালে মালয়েশিয়ার বাইসাইকেল প্রস্তুতকারক কোম্পানি আলিটা দেশে একটি কারখানা স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিবন্ধন লাভ করে৷ ১৯৯৫ সালের মার্চে নতুন কোম্পানি আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেড উৎপাদন শুরু করে৷ কোম্পানিটি দেড় বছরের মধ্যেই ইউরোপে রপ্তানি শুরু করে৷ ফলে বিশ্ব বাজারে ধীরে ধীরে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ সাইকেলের একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়৷

আলিটা বাংলাদেশ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক এ এইচ এম ফেরদৌস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রাথমিকভাবে রপ্তানির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছিল প্রমাণ করা যে সাইকেলগুলো বাংলাদেশেই তৈরি৷ আমাদের সাইকেলের গুণমানও প্রমাণ করতে হয়েছিল৷ ১৯৯৭ সাল থেকে রপ্তানি অনেক মসৃণ হয়েছে৷ ২০০৮ সাল থেকে সাইকেল রপ্তানি লাভজনক হতে শুরু করে৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ