বাংলাদেশে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের কিশোরীরা দিন দিন অধিকার সচেতন হয়ে উঠছে৷ অধিকার আদায়েও তারা সক্রিয় হচ্ছে৷ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এক্ষেত্রে মেয়েদের সহায়তা করছে৷
বিজ্ঞাপন
রংপুরের সায়মা আক্তারকে (১৬) তার বাবা ১১ বছর বয়সে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেয়৷ নিরাপত্তার নামে তাকে এক বৃদ্ধের সঙ্গে তখন বিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন তার বাবা৷ এর আগেও সায়মার বয়স যখন পাঁচ বছর ছিল, তখন থেকেই তাকে পর্দা প্রথায় অভ্যস্ত করা হয়, পরিয়ে দেয়া হয় বোরকা৷ কিছুটা ভীত আর দ্বিধান্বিত সায়মা শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করেছে৷
ইউনিসেফের অর্থায়নে ‘কিশোর অভিযান' নামের একটি সংগঠন ঐ এলাকায় কিশোর-কিশোরীদের লিঙ্গবৈষম্য, জেন্ডার, বাল্যবিবাহ, প্রজনন স্বাস্থ্য ও শিশু শ্রমসহ আরো কিছু বিষয়ের উপর শিক্ষা কর্মসূচি চালু করেছে৷ তাই সায়মা এখন জানে তার অধিকার সম্পর্কে৷ জেন্ডার নিয়ে সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারণা পরিবর্তন করে দিতে চায় সে৷
কিশোর অভিযান সংস্থাটি ‘ইন্টারএ্যাকটিভ পপুলার থিয়েটার' পদ্ধতিতে নারীদের অধিকার সচেতন করার কাজ করছে৷ জনপ্রিয় লোককথা, ঐতিহ্যবাহী গান, নাচ আর নাটকের মাধ্যমে তারা স্থানীয় পর্যায়ের নানা বিষয় সেখানকার মানুষের কাছে তুলে ধরছে৷ এছাড়া সমাজের নীতি নির্ধারক এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনেও তা তুলে ধরা হচ্ছে৷
রংপুরের ‘সেন্টার ফর ম্যাস এডুকেশন ইন সায়েন্স' অভিনয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সামনে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়৷ তারা নারীদের কাজে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরে৷
অ্যাসিড সন্ত্রাস!
একটা সময় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসতো নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর৷ এমন বর্বরোচিত হামলা এখনও হয় কিছু দেশে৷ কয়েকটি দেশ ঘুরে জার্মান ফটোগ্রাফার অ্যান-ক্রিস্টিন ভোর্ল-এর তোলা ছবি নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Griebeler
বাংলাদেশের ফরিদা
ফরিদার স্বামী ছিলেন ড্রাগ এবং জুয়ায় আসক্ত৷ ঋণের দায়ে একসময় বাড়িটাও বিক্রি করে দেয় নেশাগ্রস্ত লোকটি৷ রেগেমেগে ফরিদা বলেছিলেন, এমন স্বামীর সঙ্গে আর ঘর করবেন না৷ সেই রাতেই হলো সর্বনাশ৷ ঘুমন্ত ফরিদার ওপর অ্যাসিড ঢেলে দরজা বন্ধ করে দিল পাষণ্ড স্বামী৷ যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন ফরিদা৷ প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে তাঁকে৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
মায়ের স্নেহে, বোনের আদরে...
অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়ার সময় ফরিদা ছিলেন ২৪ বছরের তরুণী৷ ১৭টি অস্ত্রোপচারের পর এখন কিছুটা সুস্থ৷ তবে সারা গায়ে রয়েছে দগদগে ঘায়ের চিহ্ন৷ পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলোর ত্বক মসৃণ রাখতে প্রতিদিন মালিশ করে দেন মা৷ নিজের কোনো বাড়ি নেই বলে মায়ের সাথেই বোনের বাড়িতে থাকেন ফরিদা৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
উগান্ডার ফ্লাভিয়া
ফ্লাভিয়ার ওপর এক আগন্তুক অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল ৫ বছর আগে৷ আজও ফ্লাভিয়া জানেন না, কে, কেন তাঁর ওপর হামলা চালালো৷ বিকৃত চেহারা নিয়ে অনেকদিন ঘরেই ছিলেন৷ বাইরে যেতেন না৷ এক সময় ফ্লাভিয়ার মনে হলো, ‘‘এভাবে ঘরের কোণে পড়ে থাকার মানে হয় না৷ জীবন এগিয়ে চলে৷ আমাকেও বেরোতে হবে৷’’
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আনন্দময় নতুন জীবন
এখন প্রতি সপ্তাহে একবার সালসা নাচতে যায় ফ্লাভিয়া৷ আগের সেই রূপ নেই, তাতে কী, বন্ধুদের কাছে তো রূপের চেয়ে গুণের কদর বেশি! ফ্লাভিয়া খুব ভালো নাচ জানেন৷ তাই একবার শুরু করলে বিশ্রামের সুযোগই পান না৷ এভাবে পরিবার আর বন্ধুদের সহায়তায় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ফ্লাভিয়া৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
ভারতের নীহারি
নীহারির বয়স তখন ১৯৷ একরাতে আত্মহত্যা করার জন্য আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শরীরে৷ স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি মনে হয়েছিল তখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
নতুন রূপ
যে ঘরটিতে বসে নীহারি তাঁর চুল ঠিক করছেন এটা ছিল বাবা-মায়ের শোবার ঘর৷ এখানেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন৷ দেয়াশলাইয়ের বাক্সে একটা কাঠিই ছিল৷ তা দিয়েই আগুন জ্বালিয়েছিলেন শরীরে৷ তবে এখন আর দুর্বল মনের মেয়েটি নেই নীহারি৷ নিজেকে সামলে নিয়ে একটা সংস্থা গড়েছেন৷ সংস্থাটির নাম, ‘পোড়া মেয়েদের রূপ’৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
পাকিস্তানের নুসরাত
দু-দুবার অ্যাসিড ছোড়া হয়েছে নুসরাতের ওপর৷ প্রথমে স্বামী আর তারপর দেবর৷ ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন নুসরাত৷ ভালোই আছেন এখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আশার আলো
দু-দুবার অ্যাসিড হামলার শিকার হওয়ায় মাথার অনেকটা চুলও হারিয়েছেন নুসরাত৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মাথার ক্ষতস্থান পুরোপুরি সারিয়ে চুল এবং আগের হেয়ারস্টাইল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
বন্ধুদের মাঝে...
নিজের ভাবনা, যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে কিংবা গল্প করতে প্রায়ই অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)-এ যান নুসরাত৷ সেখানে এমন অনেকেই আসেন যাঁদের জীবনও অ্যাসিডে ঝলসে যেতে বসেছিল৷ এখন সকলেই জানেন, তাঁরা আর একা নন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
9 ছবি1 | 9
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালে বাংলাদেশে যৌতুক সংক্রান্ত নির্যাতনে ৩৩০ জন নারী নিহত হয়েছেন৷ তার আগের বছর নিহত হয়েছেন ১৩৭ জন৷ আর ২০১৩ সালে এধরনের ঘটনা ঘটেছে ৪৩৯টি৷
সেন্টার ফর ম্যাস এডুকেশন ইন সায়েন্স-এর মোহাম্মদ রাশেদ মনে করেন সবার অংশগ্রহণে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে এই প্রচার প্রচারণা বেশ কাজে আসছে৷ এর মাধ্যমে অনেক দু:খজনক ঘটনা এড়ানো সম্ভব হচ্ছে৷
ইউনিসেফ মনে করে এর ইতিবাচক ফল এরইমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে৷ দেশের ৬ লাখ অল্পবয়েসি, যাদের মধ্যে ৬০ ভাগই কিশোরী, এখন বিয়ের সঠিক বয়স, শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব সম্পর্কে সরাসরি জানতে পেরেছে৷
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘উন্নয়ন অন্বেষণ' তাদের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক জরিপে দেখতে পেয়েছে, ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা কমে আসছে৷
আর নারী শিক্ষার হার বাড়ানোর নীতি-কৌশলের কারণেও মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার বেড়েছে৷ তবে শহরে আর গ্রামে এখনো নারী শিক্ষায় বৈষম্য আছে৷ ৯৭ ভাগ মেয়ে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, যা উন্নয়নশীল বিশ্বে সর্বোচ্চ৷
প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষায়ও অগ্রগতি লক্ষ্যণীয়৷ এখন গ্রামে ২৩ ভাগ মা সন্তান প্রসব করেন প্রশিক্ষিত ধাত্রীর উপস্থিতিতে৷ নব্বইয়ের দশকে যা ছিল মাত্র শতকরা পাঁচ ভাগ৷ ১৯৭৫ সালে মাত্র ৮ ভাগ নারী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন৷ ২০১১ সালে এই হার দাঁড়ায় শতকরা ৬২ ভাগে৷
এই উন্নয়নের পরও বাংলাদেশের নারীরা এখনো পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে আছে৷ ছেলে শিশুর চেয়ে কন্যাশিশুর মৃত্যুর হার এখনো বেশি৷ উন্নয়ন অন্বেষণ এর ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী ১,০০০ নবজাতকের মধ্যে কন্যা শিশু মারা যায় ২০টি৷ আর ছেলে শিশু ১৬টি৷