স্কটল্যান্ডে করা একটি জরিপ থেকে গবেষকরা দেখেছেন, মোটা মহিলাদের সন্তানদের ৫৫ বছর বয়স হওয়ার আগে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ৩৫ শতাংশ বেশি৷ এছাড়া তাদের হৃদরোগ হবার সম্ভাবনাও ৪২ শতাংশ বেশি৷
বিজ্ঞাপন
জরিপটা করা হয়েছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে জন্ম, এমন ৩৭ হাজার ৭০৯ জন ‘ছেলেমেয়েকে' নিয়ে৷ সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে সেই সব ছেলেমেয়েদের জন্ম দিয়েছিলেন, এমন ২৮ হাজার ৫৪০ জন মায়ের তথ্য৷ ব্রিটিশ মেডিকাল জার্নালের অনলাইন সংস্করণ বিএমজে ডট কম-এ জরিপের ফলাফল প্রকাশিত হবার সময় জরিপে করা ‘ছেলেমেয়েদের' বয়স দাঁড়িয়েছিল ৩৪ থেকে ৬১-র মধ্যে৷ যে ৬ হাজার ৫৫১ জন ‘ছেলেমেয়ে' জরিপ শুরু হওয়ার আগেই মারা যান, তাদের তথ্যও অন্তর্ভুক্ত করেন গবেষকরা৷
মায়েদের মধ্যে ২১ শতাংশের ছিল মাত্রাধিক ওজন – অর্থাৎ তাদের বডি-মাস-ইনডেক্স বা বিএমআই ছিল ২৫ থেকে ২৯ দশমিক ৯-এর মধ্যে৷ বিএমআই বলতে উচ্চতার তুলনায় ওজনের অনুপাত বোঝায়৷ মায়েদের চার শতাংশ ছিলেন ‘ওবেস' বা ভীষণ মোটা: যাদের বিএমআই ৩০ কিংবা তার ঊর্ধ্বে৷ এ সবই সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় মায়ের ওজন৷
‘ইউরোপের ৫০ শতাংশ মানুষই মোটা’
স্বপ্নের পৃথিবী গড়তে চাইলে থাকতে হবে সুস্থ৷ আর সুস্থ থাকার জন্য খাওয়া থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার মান – সবকিছুতেই চাই পরিমিতি বোধ৷
ছবি: Fotolia/Yuri Arcurs
জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবধানবাণী উচ্চারণ
ইউরোপে অতিরিক্ত ওজনের মানুষের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলেছে৷ দেখা দিচ্ছে মোটা মানুষের মধ্যে নানা অসুখ-বিসুখ – যা অবশ্যই চিন্তার বিষয়৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবগুলো দেশেই গত কয়েক শতক ধরে এই সমস্যা শুরু হয়েছে৷ জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অতিরিক্ত মোটা হওয়ার সমস্যার বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছে৷
ছবি: Getty Images
হাঙ্গেরিতে মোটা মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি
ইউরোপের সবগুলো দেশের মধ্যে অতিরিক্ত ওজনের সমস্যায় এক নম্বরে রয়েছে হাঙ্গেরি, তারপর ইংল্যান্ড, তৃতীয় নম্বরে আয়ারল্যান্ড আর চতুর্থ নম্বরে মালটা৷ পাঁচ নম্বরে লুক্সেমবুর্গের স্থান৷
ছবি: Fotolia/Xuejun li
জার্মানি রয়েছে ১৮ নম্বরে
তুলনামূলকভাবে জার্মানির অবস্থা এতটা খারাপ নয়৷ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে জার্মানিতে মানুষের বয়সের সাথে সাথে ওজনও বাড়ে৷ তবে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মোটা হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়৷ আনুমানিক হিসেব – ইউরোপে মোটা মানুষের সংখ্যা বছরে এক মিলিয়ন বাড়ছে৷
ডাক্তারের পরামর্শ
মোটা রোগীরা যখন ডাক্তারের কাছে যান, ডাক্তাররা প্রথমেই ওজন কমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন৷ অতিরিক্ত ওজনের মানুষদেরই উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিস হবার আশঙ্কা থাকে৷ প্রতিদিন খাবারে তালিকায় দুধ বা দুধ জাতীয় খাবার রাখতে হবে৷ তবে মাছ, মাংশ ডিমের প্রয়োজন প্রতিদিন নেই, সপ্তাহে এক বা দু’দিন হলেই যথেষ্ট৷
ছবি: picture alliance/Arco Images
কি খাচ্ছেন, বুঝে খান
খাদ্য সংস্থার তথ্যে জানানো হয়েছে, খাবার নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর, অস্বাস্থ্যকর বা নিষিদ্ধ খাবার বলে কিছু নেই৷ আসলে তা নির্ভর করে খাবারের পরিমাণ, খাবার নির্বাচন বা খাবারের উপকরণের ওপর৷ জার্মানির খাদ্য সংস্থা আরো জানিয়েছে, ওজন ঠিক রাখতে হলে মনে রাখতে হবে, রান্নার সময় কম তাপ, অল্প সেদ্ধ, কম তেল আর কম পানির ব্যবহারের কথা৷ এসব দিকে লক্ষ্য রাখলেই কেবল খাবারের আসল স্বাদ ও পুষ্টি ধরে রাখা সম্ভব৷
ছবি: picture alliance/Bildagentur Huber
কে খাচ্ছে সেটাও জরুরি
মানুষের বয়স, ওজন, ছেলে না মেয়ে বা দিনে সে কতটুকু পরিশ্রম করে – তার ওপর নির্ভর করে খাবারে পরিমাণ৷ প্রতিদিনের খাবারে থাকতে হবে তাজা শাক-সবজি, রুটি, নুডলস, বিভিন্ন শস্যদানা, আলু ইত্যাদি৷ এসবে চর্বি নেই বললেই চলে, তবে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন আর মিনারেল, পুষ্টি এবং আঁশ, যা প্রতিদিনই মানুষের শরীরে প্রয়োজন৷ তবে কার জন্য কি প্রয়োজন সেটা জেনে খেতে হবে৷
ছবি: Fotolia/Tatyana Gladskih
বিশেষজ্ঞের মত
একবেলা না খেলেও অসুবিধা নেই তবে সকালের নাস্তা ভালো করে করতে হবে৷ তা না হলে কনসেন্ট্রেশন বা মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে যা বাড়ন্ত ছেলে-মেয়েদের অত্যন্ত প্রয়োজন৷ বিভিন্ন খাবারের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন বাচ্চাদের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলে৷ জার্মানির বাডেম ভুর্টেমব্যার্গ শহরের একটি স্কুলের টিফিনের সময় বাচ্চাদের আপেল খাওয়ার অভ্যাস করানো হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফাস্ট ফুড
ফাস্ট ফুড খাওয়া কমাতে হবে এবং সপ্তাহে অন্তত দু’দিন ব্যায়াম করা প্রয়োজন৷ ওজন কমানোর জন্য শুধু খাদ্যাভাসের পরিবর্তন করলেই হবে না, করতে হবে প্রচুর হাঁটা-চলা, ব্যায়াম৷ এছাড়াও পান করতে হবে প্রচুর পানি৷ একমাত্র তবেই কাঙ্খিত ফিগার পাওয়া সম্ভব৷
ছবি: Fotolia/st-fotograf
প্রবীণদের জন্য ব্যায়াম
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ওজন বাড়ে – যা সবারই জানা৷ তাই শরীর ঠিক রাখতে ফিটনেস সেন্টারগুলোতে বয়স্কদের জন্যও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা৷ এ ব্যাপারে তাদের আরো আগ্রহী করে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Fotolia/Robert Kneschke
সুন্দর জীবন
সবশেষে বলা যায় স্বপ্নের পৃথিবী গড়তে চাইলে থাকতে হবে সুস্থ৷ আর সুস্থ থাকার জন্য খাওয়া থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার মান – সবকিছুতেই চাই পরিমিতি বোধ৷ তখন মোটা হওয়ার সম্ভবনাও থাকবে না আর ওজন নিয়েও সমস্যা হবে না৷ অনেক স্বপ্নই তখন পূরণ করা সম্ভব হবে৷
ছবি: Fotolia/Yuri Arcurs
10 ছবি1 | 10
জরিপে দেখা যায়, ভীষণ মোটা মায়েদের সন্তানদের ৫৫ বছর বয়স হওয়ার আগে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল সাধারণ মায়েদের সন্তানদের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি৷ এমনকি শুধুমাত্র মোটা মায়েদের সন্তানদের ঝুঁকিও ১১ শতাংশ বেশি৷ এছাড়া ভীষণ মোটা মায়েদের ছেলেমেয়েদের কালে হৃদরোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবার সম্ভাবনা ৪২ শতাংশ বেশি৷
অজাত শিশু মাতৃশরীরে যে পরিবেশে থাকে, তার স্বাস্থ্য ও আয়ুর উপর তার স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে – জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে৷ এ গুলি এমন সব শারীরিক পরিবর্তন, যা সারা জীবন বজায় থাকে, যেমন ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ কিংবা মেটাবলিজম-এর মতো শারীরিক প্রক্রিয়া৷ অবশ্য মায়ের মোটা হওয়াকেই নিশ্চিত করে একমাত্র কারণ বলা চলে না, কেননা বেশি খাওয়াদাওয়া, কম হাঁটাচলা এবং স্রেফ বংশগত কারণেও জরিপের ‘ছেলেমেয়েদের' স্বাস্থ্যের হানি ঘটে থাকতে পারে – অন্তত এই জরিপ থেকে সে সম্ভাবনা একেবারে বাদ দেওয়া চলে না৷
তা সত্ত্বেও সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে মায়ের ওজন কমানোর বিষয়টির দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া উচিত বলে গবেষকদের ধারণা৷ বিশেষ করে যখন যুক্তরাজ্যে সন্তানসম্ভবা মায়েদের পাঁচজনের মধ্যে একজন ভীষণ মোটা বলে গণ্য৷ সেই সঙ্গে প্রয়োজন মোটা মায়েদের সন্তানদের গোড়া থেকেই খাওয়া-দাওয়া, ডায়েট সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়া৷ এছাড়া এই গোত্রীয় মানুষদের উচ্চ রক্তচাপ, ব্লাড সুগার, ব্লাড ফ্যাট ও ধূমপান ইত্যাদির বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দেওয়া উচিত – বলেছেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেটাবলিক মেডিসিনের অধ্যাপক রেবেকা রেনল্ডস, যিনি জরিপের ফলাফল সংক্রান্ত লেখাটির দুই রচয়িতার একজন৷
জরিপটি যে সব মায়েদের নিয়ে করা হয়েছে, তাদের মধ্যে মাত্র চার শতাংশ ছিলেন ওবেস বা ভীষণ মোটা৷ সে যাবৎ সারা বিশ্বে মোটা এবং ভীষণ মোটা মানুষদের – ও মায়েদের – সংখ্যা অনেক বেড়েছে: বিপদটা সেখানেই৷ অপরদিকে এও সম্ভব যে, মোটা মায়েদের ছেলেমেয়েদের নিজেদেরই মোটা হবার প্রবণতা থাকে এবং সেই কারণেই হয়তো তাদের হৃদরোগ ইত্যাদি হয়, বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷
তবে খোদ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতো চুলচেরা হিসেবে না গিয়েও বলা যায়: মা যদি মোটা হন, তাহলে তার দাম দিতে হয় সন্তানকে৷ সেটাই হল মোদ্দা কথা৷