চিরাচরিত প্রথা হিসেবে ঈদের এক শুভেচ্ছা বার্তা দিয়ে মোদী সরকার তার দায়িত্ব পালন শেষ করেছে৷ ঈদ উৎসবের সাবেক মেজাজটা যেন বিজেপির গৈরিক মহলে ইফতার ভোজ থেকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি৷
বিজ্ঞাপন
দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী তাঁর সরকারি দায়িত্ব পালনে চিরাচরিত প্রথা হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায়কে এক শুভেচ্ছা বার্তায় বলেছেন, ঈদ-উল-ফিতর দেশে শান্তি, ঐক্য ও সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করবে৷
ব্যস এই পর্যন্ত৷ প্রধানমন্ত্রীসহ বিজেপি নেতাদের মধ্যেও ঈদ উৎসব পালনে একটা চাপা অনীহা ছিল৷ আড়ম্বরের তো প্রশ্নই নেই৷ এই অনীহার ভাব লক্ষ্য করা গেছে ইফতার ভোজ থেকেই৷ প্রধানমন্ত্রী মোদী কোনো ইফতার দেননি, এমনকি তাঁর মন্ত্রীদেরও তা দিতে নিষেধ করেছেন বলে জানা গেছে৷ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনও তিনি কোনো ইফতার দেননি৷ এমনকি এবছর রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দেয়া ইফতার ভোজেও যোগ দেননি মোদী৷ শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং সংখ্যালঘুমন্ত্রী নাজমা হেপতুল্লা ছাড়া মোদী মন্ত্রিসভার অন্য কোনো সদস্য যোগ দেননি৷ বিজেপি শাসনাধীন রাজ্যগুলিতেও সরকারি স্তরে কোনো ইফতারের আয়োজন করা হয়নি৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
প্রত্যাশিতভাবেই ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিতর্ক ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে৷ কংগ্রেস সরকার প্রায় প্রতি বছরই ইফতার ভোজ দিয়ে আসছে৷ এবার ক্ষমতায় না থাকায় কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীও ইফতার ভোজ না দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদী ইফতার ভোজ না দেয়ায় তিনি মত পালটান৷ কারণ সোনিয়ার পরামর্শদাতারা মনে করিয়ে দেন কংগ্রেস ইফতার ভোজ না দিলে মোদীর অনুগামী বলে সোনিয়া গান্ধীকে মুসলিম সমাজ ভুল বুঝতে পারে৷
ইফতারের রাজনীতি?
স্বাধীন ভারতের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে জহরলাল নেহেরু কিংবা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর আমলে ইফতার দেবার রীতি ছিল না৷ ইফতার রাজনীতির মতো অনেক অনাকাঙ্খিত রাজনীতি শুরু হয় ইন্দিরা গান্ধীর আমলে৷ তারপর থেকে প্রধানমন্ত্রীদের ইফতার দেয়াটা একটা রীতি হয়ে ওঠে৷ ১৯৯৯ সালে বিজেপির নির্বাচনি সাফল্যের পর বিজেপির সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী মুসলিম সমাজের মন জয় করতে ইফতার আয়োজন করেছিলেন৷ তারপর থেকে বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার শাহ নওয়াজ হোসেন প্রতি বছর বাজপেয়ীর নির্দেশমতো ইফতার ভোজ দিয়ে আসছেন৷ ‘‘ইফতার ভোজ দেয়া না দেয়া নিজের ইচ্ছা৷ দিতেই হবে এমন কোনো কথা নেই,'' বলেন শাহ নওয়াজ হোসেন৷
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম আজাদ ইফতার ভোজ না দিয়ে সেই অর্থ দান করতেন গরিব দুখিদের মধ্যে৷
নাগরিক সমাজের ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা অবশ্য মনে করেন, ইফতার ভোজ নিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ অহেতুক৷ রমজান মাসের উপবাস ভঙ্গে চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় দিয়ে ভোজ দেয়ার সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগ নেই৷ এদিয়ে মুসলিম প্রেম বা অপ্রেম বিচার করা যায় না৷
ঈদ জামাতে গাজাবাসীর জন্য প্রার্থনা
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো গোটা ভারতেও পালিত হয় পবিত্র ঈদ উৎসব৷ সেই পরিচিত চেহারা৷ দিল্লির ঐতিহাসিক জামা মসজিদে সমবেত নামাজ, শুভেচ্ছা বিনিময়৷ জামা মসজিদ সংলগ্ন অলিগলি থেকে মোঘলাই খানার সুগন্ধ৷ নতুন জামাকাপড়, মিষ্টি বিতরণ ও কোলাকুলি৷ উত্তর প্রদেশের শাহারামপুরে মুসলিম-শিখ জমি সংঘর্ষে কারফিউ থাকায় ঈদের আনন্দে ভাটা পড়ে৷ এছাড়া একমাত্র ব্যতিক্রম দিল্লির চাণক্যপুরিতে ফিলিস্তিনি দূতাবাস৷ গাজায় ইসরায়েলি হানায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ায় শোকের ছায়া পড়েছে ভারতের ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মনে৷ অন্যবারের মতো তাই এবার দূতাবাস ভবনে নেই কোনো আলোকসজ্জা, নেই ইফতার ভোজ, নেই কোনো আনন্দ উৎসব৷ জম্মু-কাশ্মীরেও সেই শোকের ছায়া৷ ঈদের নামাজের পর ৩০ মিনিট ইসরায়েলি হানার প্রতিবাদ জানানো হয়৷