ভারতের নির্বাচনে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদীর অভাবনীয় সাফল্যের ঢেউ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও এসে লেগেছে৷ ফেসবুকে অনেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের প্রতিক্রিয়ার৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরপরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও বিএনপির অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে মোদীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়৷ এ সংক্রান্ত পাঁচটি খবরের শিরোনাম একসঙ্গে করে সুমন মাহবুব ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘ভারত হামকো জানসে পেয়ারা হে....৷''
বিএনপি ও জামায়াতের অভিনন্দন নিয়ে আরিফ জেবতিক ফেসবুকে একটি নোট লিখেছেন, যার শিরোনাম ‘মোদীর মদিরা ফর্মুলা: বঙ্গের আশা কেমন?'
তিনি লিখেছেন, ‘‘উগ্র মৌলবাদ ভাতৃপ্রতীম ব্যাপার, সেটা আলাদা আলাদা ধর্মের হলেও নিজেদের মাঝে এক ধরনের খায়খাতির আছে বলে মনে হয়৷ হাজার হাজার মুসলমানের রক্তে যে লোকটির হাত রাঙা, পুরো ফলাফল ঘোষণা হওয়ার আগেই তাঁর প্রতি শুভেচ্ছা জানানোর তড়িৎ আকুতি জানাচ্ছেন বঙ্গের সেই দল, যারা নিজেদেরকে ইসলামপন্থি বলে জাহির করে ভোট করে থাকে! এই আকূল আনন্দের মূল কারণ হয়ত ভারতে কংগ্রেস সরকারের পতনের কারণে বাংলাদেশে কংগ্রেসের মিত্র বলে পরিচিত আওয়ামী লীগ সরকার বেকায়দায় পড়বে বলে মনে করা৷''
আরিফ জেবতিক অবশ্য মনে করেন, ক্ষমতায় যে দলই থাকুক, ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতিতে তার খুব বেশি প্রভাব পড়বে না৷
‘‘উগ্র হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-এর সন্তান মোদী পাশের দেশ বাংলাদেশে নতুন করে বড় উৎপাত তৈরির চেষ্টা ছাড়া আর কিছুতে মনোযোগ দেবে বলে আমার মনে হয় না৷ কিন্তু ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগের অতিরিক্ত বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের কারণে রাষ্ট্র হিসেবে ভারত স্বস্তিতেই আছে এবং এখানে সরকার অস্থিতিশীল করে তুলে মোদীর আলাদা কোনো লাভ নেই৷''
ভারতীয় জনগণের রায়ে হতাশা প্রকাশ করে আবু বকর সিদ্দিক লিখেছেন, এভাবেই ইতিহাসব্যাপী ভারত-সংস্কৃতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্ত্যজেরা নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরে আসছে৷
‘‘ভারতের মানুষ ভারতের অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে সমুন্নত রাখবে এমন আশাই করেছিলাম৷ ভারতের শিক্ষিত সমাজ, গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন মানুষ একটা হোঁচট খেল আর কি! তবে এটা ভারত আবার কাটিয়ে উঠবে এটাও আমি আশা করি৷ কর্পোরেট অঢেল অর্থ, মিডিয়ার অতিতৎপরতার কাছে সচেতন মানুষের প্রতিরোধটুকু পেরে ওঠেনি এবার, যদিও আগের দুবার পুঁজি ও গণমাধ্যমই পরাস্ত হয়েছিল, আমি দৃঢ়ভাবে আশা রাখি, আবার পরাস্ত হবে তারা৷''
ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের অফিশিয়াল ফেসবুক পাতাতেও বহু পাঠকের প্রতিক্রিয়া এসেছে৷ তাঁদের কেউ কেউ ‘এক সময়ের চা বিক্রেতা' মোদীকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করেছেন৷ কেউ আবার তীব্র সমালোচনা করেছেন ২০০১ সালের গুজরাটের দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা নিয়ে৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
মোদীকে অভিনন্দন জানানোর সমালোচনা করে হিমেল আহমেদ লিখেছেন, ‘‘অভিনন্দন জানানো খারাপ কিছু না৷ তবে একটু খেয়াল করেন, যে আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছে সেই লোকটির হাতে লেগে আছে ভারতের জনগণ (মুসলিম) নিধনের রক্ত৷ সেই রক্ত পিপাসুকে ভারতের জনগণ চিনতে না হয় ভুল করেছে, কিন্তু আপনি করলেন কেন? আপনার মতো রাজনীতিবিদের কাছে আমরা এটা আশা করিনি৷''
বাবু আনা নামে আরেকজন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘অভিনন্দন জানিয়ে ম্যাডাম জিয়া কি পরোক্ষভাবে মোদীর মুসলিম নিধনকেই সমর্থন দিলেন?''
চমন সিকদার জুলকারনাইন লিখেছেন, ‘‘বেগম জিয়া অপেক্ষায় মোদীজির জন্য৷ বিজেপি ও বিএনপি নামের মিল রয়েছে৷ এবার যদি আওয়ামী লীগকে হটানো যায় – এই তাঁর আশা৷ তবে মনে রাখতে হবে ভারত চালায় আমলারা৷''