এর মাধ্যমে শাসকদল বিজেপির ‘মোদীকরণের বৃত্ত’ সম্পূর্ণ হলো৷ দল এবং সরকারকে হাতের মুঠোয় নিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী৷ নতুন দিল্লিতে বিজেপির সংসদীয় দলের বৈঠকে অমিত শাহকে বিজেপির নতুন সভাপতি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ অমিত শাহ প্রধানমন্ত্রী মোদীর ডানহাত বলে পরিচিত হলেও তাঁর সাংগঠনিক তথা রাজনৈতিক যোগ্যতা নিয়ে দলে কোনো দ্বিমত নেই৷ ৪৯ বছর বয়সি অমিত শাহ দলের তৃণমূল স্তর থেকে ধাপে ধাপে উঠে অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বিজেপির শীর্ষপদে আসীন হলেন৷ তিনি হলেন বিজেপির সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি৷ হালের সংসদীয় নির্বাচনে দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাইয়ে দেবার পেছনে এই অমিত শাহ ছিলেন নেপথ্য নায়ক, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে৷
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd উল্লেখ্য, সংসদের ৫৪৩টি আসনের মধ্যে বিজেপির ঝুলিতে গেছে ২৮২টি আসন৷ তার মধ্যে উত্তর প্রদেশের ৮০টি আসনের মধ্যে ৭২টি পায় বিজেপি৷ অমিত শাহের সাংগঠনিক এবং কৌশলগত বিচক্ষণতাই তাঁকে দলীয় নেতৃত্বের প্রথম সারিতে তুলে এনেছে৷ সমালোচকরা অবশ্য মোদীর হাতে দল ও সরকারের একাধিপত্য থাকায় প্রমাদ গুণছেন৷
বিতর্কও কম হয়নি এই অমিত শাহকে নিয়ে৷ গুজরাটে নরেন্দ্র মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে তিনি ছিলেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ সেই সময় পুলিশের সঙ্গে ভুয়া সংঘর্ষে সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তিনি ইস্তফা দিতে বাধ্য হন এবং পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ অমিত শাহের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, মাফিয়া ডন সোহরাবুদ্দিন মার্বেল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত তোলা আদায় করতো৷ এতে অতিষ্ট হয়ে মার্বেল ব্যবসায়ীরা গুজরাটের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে প্রচুর টাকা দেন সোহরাবুদ্দিনকে হত্যা করতে৷ পুলিশ সোহরাবুদ্দিননকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভুয়া সংঘর্ষে মেরে ফেলে, এমনটাই অভিযোগ৷ ঐ মামলায় পরে তিনি জামিন পেলেও সুপ্রিম কোর্ট ২০১০ সালে তাঁর গুজরাটে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তিনি দিল্লিতেই থেকে যান এবং জাতীয় রাজনীতিতে দলের অবস্থান এবং ভবিষ্যত কর্মপন্থা নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু করেন৷ নিঃশব্দে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খন্ডন করার মাল মসলা সংগ্রহ করে প্রমাণ করেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন৷ তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে ২০১২ সালে গুজরাট বিধানসভা ভোটের আগে তাঁর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়৷
অমিত শাহ কেবল দলের নয়, সংঘপরিবারের বিশ্বাসভাজন৷ ছাত্রাবস্থায় তিনি ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সক্রিয় সদস্য৷ বিজেপিতে যোগ দিয়ে তিনি হন দলের যুব শাখা ভারতীয় জনতা যুব মোর্চার সক্রিয় সদস্য৷ গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে কংগ্রেসের প্রভাব খর্ব করতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নেন৷
দলের নতুন সভাপতি হিসেবে অমিত শাহের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ৷ মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড ও জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা ভোটের আর দেরি নেই৷ ভোটে দলের জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে তাঁর ভবিষ্যত নির্বাচনি কৌশল কী হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়৷