মোদী-ইউনূসের ঈদ-বার্তা কি দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে?
শময়িতা চক্রবর্তী ভারত
৯ জুন ২০২৫
ভারত বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যেই ঈদ উপলক্ষে সৌহার্দ্যের চিঠি বিনিময় করলেন নরেন্দ্র মোদী এবং মুহাম্মদ ইউনূস।
মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদীছবি: Indian Ministry of External Affairs/AP Photo/picture alliance
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের মানুষকে ঈদের শুভেচ্ছা পাঠিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ত্যাগ, সহানুভূতি এবং ভ্রাতৃত্বের আদর্শের কথা বলেন। তিনি লেখেন, "ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আপনাকে এবং বাংলাদেশের মানুষকে ঈদের শুভেচ্ছা। ভারতে কয়েক কোটি মানুষ এই উৎসব পালন করেন। এই উৎসব আমাদের মধ্যে আত্মত্যাগ এবং ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়।" চিঠিতে ইউনূসের সুস্থতা কামনা করেন তিনি।
উত্তরে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস দুই দেশের মূল্যবোধের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, "আপনার চিঠি দুই দেশের মূল্যবোধের প্রতিফলন। ঈদ মানুষকে কাছে আনে। আমাদের দুই দেশের পারস্পরিক শ্রদ্ধা দুই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।"
গত বছরের অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। এই বছরের এপ্রিলে ব্যাংককে মোদী এবিং ইউনূসের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ হলেও দুই দেশের মধ্যে শীতলতা কমেনি। এর মধ্যেই বাংলাদেশের ক্রমাগত অভিযোগ, ভারতের সীমান্তরক্ষীরা পুশ-ইন করে সীমান্ত দিয়ে মানুষ ঢোকাচ্ছেন। এতে সম্পর্কে আরো দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি
চীনের পরই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে ভারতের কাছ থেকে৷ ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি সেই তুলনায় অনেক কম হলেও চলতি অর্থবছরে তা বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে৷ কিন্তু সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে সেই ধারাবাহিকতা কি ধরে রাখা যাবে?
ছবি: Amlan Biswas/Pacific Press/picture alliance
ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ (জুলাই-জুন) অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ১৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে৷ এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় নয় শতাংশ কম৷ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৭১ কোটি ডলার৷ গত বছরের জুলাই থেকে এই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ১৫১.৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে৷ আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩১.৭ কোটি ডলার৷ ১০ মাসে প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ৷
ছবি: BM Ahmed
বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি
বাংলাদেশ ভারত থেকে যে পরিমাণ রপ্তানি করে, তার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি আমদানি করে৷ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৯৪৯ কোটি ডলার৷ বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে, এটি তার ১৪ দশমিক তিন শতাংশ৷ ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ অর্থবছরে (এপ্রিল-মার্চ) বাংলাদেশে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১০৬ কোটি ডলার৷
ছবি: BM Ahmed
বাংলাদেশের ১০১২টি, ভারতের ৫৬২০টি
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির মতো বিশাল ব্যবধান রয়েছে পণ্যের পসরাতেও৷ বাণিজ্যে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের পণ্যের সম্ভার পাঁচগুণ বেশি৷ ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ইন্ডিয়া ব্র্যান্ড ইকুইটি ফাউন্ডেশন’ জানাচ্ছে ভারত বাংলাদেশ থেকে ২০২৪ অর্থবছরে ১০১২ ধরনের পণ্য আমদানি করেছে৷ অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারত রপ্তানি করেছে ৫ হাজার ৬২০ রকমের পণ্য৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বাংলাদেশের পোশাক, ভারতের তুলা
বাংলাদেশের প্রধাণ রপ্তানিপণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, মাছ, হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য৷ তবে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৪ কোটি ডলার৷ ভারত থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে তুলা৷ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তুলা আমদানির পরিমাণ ছিল ২৩৬.৮ কোটি ডলার, যা মোট আমদানির এক চতুর্থাংশ৷ এছাড়াও আছে খনিজ, পশুখাদ্য, পরমাণু রিয়্যাক্টর, বয়লার ও মেশিনারি, সবজি ইত্যাদিও৷
ছবি: Faisal Ahmed/DW
অভ্যুত্থানের পরের চিত্র
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের পরে দুই দেশের বাণিজ্য তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি৷ গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে ভারত বাংলাদেশে ৬৮২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা আগের একই সময়ে ছিল ৬৬৯ কোটি ডলার৷ অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে গত আগস্ট-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ১২২ কোটি ডলার, যা আগের একই সময়ে ছিল ১০৫ কোটি ডলার৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দুই দেশের ট্রানজিট সুবিধা
দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী, এক দেশ আরেক দেশের মধ্য দিয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা পাবে৷৷ ২০১৬ সালে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে অনুমতি দেয়া হয়৷ ২০২০ সালে ভারতের সমুদ্র এবং বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে বাণিজ্যের সুবিধা দেয় দিল্লি৷
ছবি: Md Manik/ZUMA Wire/imago images
তৃতীয় দেশের সুবিধা বাতিল ভারতের
২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল ভারত৷ বলা হয়েছিল, ভারতের সমুদ্র এবং বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারবে বাংলাদেশ৷ গত ৮ এপ্রিল সেই সুযোগ বাতিল করে ভারত৷ তবে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই নিয়ম চালু হবে না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দুই দেশের পাল্টাপাল্টি
দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ চারটি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানায়৷ এরপর ভারত বাংলাদেশি গার্মেন্টস পণ্যের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা স্থগিত করে৷ ১৭ মে ভারত স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাক, কৃষি-প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে৷ তবে বাংলাদেশ এই বিষয়ে পাল্টা কোনো পদক্ষেপ নেবে না বলে জানিয়েছে৷
ছবি: Amlan Biswas/Pacific Press/picture alliance
8 ছবি1 | 8
'প্রভাব পড়বে না সম্পর্কে'
ভারতের প্রাক্তন আমলা এবং সাংসদ জহর সরকার ডিডাব্লিউকে বলেন, "ইউনূস নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তার রাজনৈতিক স্বপ্ন আছে। তিনি ভারত বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। অন্যান্য অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায়। ইউনূস তা চান না। উনি ক্ষমতায় থাকতে চান। এটা এত পরিষ্কার যে সম্পর্ক রাতারাতি ভালো হয়ে যাবে, এমনটা ভাবার কারণ নেই। সৌহার্দ্যের চিঠি আসলে লেখেন আমলারা। রাষ্ট্রপ্রধানরা একাধিক খসড়া থেকে একটি বেছে নেন। এটাও তেমনি।"
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে 'অবৈধ এবং অসাংবিধানিক' আখ্যা দিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ইমনকল্যান লাহিড়ী বলেন, "ভারতের কাছে ওই দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা বৈধ, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ঈদের বার্তা প্রধানমন্ত্রী সবাইকে দিতে পারেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মানুষকে উনি শুভেচ্ছা জানাতেই পারেন। কিন্তু এই চিঠি আদান প্রদানে কোনো কূটনৈতিক লাভ বা ক্ষতি হবে বলে আমি মনে করি না।"
বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ভারসাম্যের নীতি রেখে চলেছে। একদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা এখনো হাসিনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে, ইউনূস সরকারের সঙ্গেও বিভিন্ন চ্যানেলে সম্পর্ক রাখা হচ্ছে। কূটনীতির ভাষায় একে ভারসাম্যের নীতি বা 'ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ' কৌশল বলা হয়। বিভিন্ন উৎসবে ভারতের চিঠি সেই কৌশলেরই একটি অঙ্গ বলে মনে করছেন কূটনীতিবিদেরা।