মোট নয়টি রাজ্যের ৩৩টি বিধানসভা আসন এবং তিনটি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনের ফলাফল বিজেপির পক্ষে এক অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল৷ হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের ‘মেরুকরণের রাজনীতি' প্রত্যাখান করেছে মানুষ৷ ঘোষিত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার জয়৷ মোদী সরকারের ১০০ দিনের মাথায় প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া বইতে শুরু করেছে৷ ক্ষমতায় আসার পর মোদী শাসনের এটা দ্বিতীয় পরীক্ষা৷ দুটি পরীক্ষাতেই সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারেনি সরকার৷ উত্তর প্রদেশে ১১টি বিধানসভা আসনের উপ-নির্বাচনে শাসক দল সমাজবাদি পার্টি আটটি আসনে এবং মেইনপুরি সংসদীয় আসনে জিতে আবার তার হারানো জমি ফিরে পেয়েছে৷ যেখানে বিগত সংসদীয় নির্বাচনে ৮০টি আসনের মধ্যে ৭২টি আসন একাই দখল করেছিল বিজেপি৷
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd এই মাস তিনেকের মধ্যে কী এমন ঘটল যে রাজ্যের মানুষ বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল? পর্যবেক্ষকদের মতে, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, সাংসদ যোগী আদিত্যনাথ এবং সাক্ষী মহারাজের মত বিজেপি নেতারা বড্ড তাড়াহুড়ো করে ‘সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি' শুরু করেছিল জোরেসোরে৷ ‘লাভ-জিহাদ', মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষার নামে সন্ত্রাসবাদে মগজ ধোলাই করা হয়, স্বাধীনতা দিবসে এবং প্রজাতন্ত্র দিবসে মাদ্রাসাগুলিতে জাতীয় পতাকা না তোলা ইত্যাদি অভিযোগ নিয়ে সংঘ পরিবারের অপপ্রচার ভোট বাক্সে ছাপ ফেলেনি৷ বরং প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা প্রমাণ করে দিয়েছে তিনি জনমানসের ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা পড়তে পারেননি৷ তিনি পড়তে পারেননি যে, ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, স্মার্ট সিটি, বুলেট ট্রেন, পরিচ্ছন্ন টয়লেট, চীন জাপানের সঙ্গে দোস্তির চেয়ে সাধারণ মানুষ আগে চায় শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপদে থাকতে৷ উপ-নির্বাচনের ফলাফল আরেকটা বার্তা দিয়েছে, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুলের' দিন শেষ৷ বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য মনে করেন যে, এই ফলাফল বিচার করতে হবে স্থানীয় দৃষ্টিতে৷
পাশাপাশি, এত তাড়াতাড়ি এটা মনে করারও সময় এখনো আসেনি যে প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছেন৷ তবে উপ-নির্বাচনের ফলাফলকে অ্যালার্ম বেল মনে করে মোদীকে নতুন করে ঘুঁটি সাজাতে হবে আগামী ১৫ই অক্টোবরের হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটের বড় পরীক্ষায়৷ মহারাষ্ট এবং হরিয়ানা অনেক বছর ধরে কংগ্রেস পার্টির শাসনে৷
রাজস্থানে চারটি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ছিনিয়ে নিয়েছে তিনটি, বিজেপি পেয়েছে একটি৷ মোদীর স্বরাজ্য গুজরাটে নয়টি আসনের মধ্যে বিজেপি ধরে রাখতে পেরেছে মাত্র ছয়টি আসন৷ তবে মোদীর ছেড়ে যাওয়া বদোদরা সংসদীয় আসনটি বিজেপির দখলেই আছে৷ পশ্চিমবঙ্গের দুটি বিধানসভা আসনের মধ্যে চৌরঙ্গি আসন পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপি ছিনিয়ে নিয়েছে বসিরহাট দক্ষিণ আসনটি৷ এই প্রথম বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রবেশের ছাড়পত্র পেল৷ আসামে পাঁচটি আসনের মধ্যে শিলচর আসনটি এসেছে এবার বিজেপির ঝুলিতে৷ কংগ্রেস পেয়েছে দু'টি এবং নিখিল ভারত সংযুক্ত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট একটি৷ রাজ্যবিত্তিক এই ফলের ওপরে ভিত্তি করেই মোদী ঝড়ের বর্তমান গতি মাপতে চেষ্টা করছেন জাতীয় রাজনীতির বোদ্ধারা৷