অন্ধ্র প্রদেশে সহিংসতার কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে শুরু হলো ভারতের জাতীয় নির্বাচন৷ সাত পর্বের প্রথমটিতে বৃহস্পতিবার অন্ধ্র প্রদেশ ছাড়াও আরো ১৭টি রাজ্য ও ২টি ইউনিয়ন টেরিটরিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র এই অগ্নিপরীক্ষায় বৃহস্পতিবার প্রথম পর্বের ভোটে সহিংসতায় একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে৷ নিহত ব্যক্তি অন্ধ্র প্রদেশের ক্ষমতাসীন তেলেগু দেশাম পার্টির স্থানীয় পর্যায়ের এক নেতা৷ আঞ্চলিক পর্যায়ের দলগুলোর মধ্যে বিরোধের জেরে অন্ধ্র প্রদেশে আরো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷
এই প্রদেশ থেকে নিম্নকক্ষ বা লোকসভায় ২৫ জন সদস্য ও রাজ্যের ১৭৫ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন৷ এছাড়াও প্রথম পর্যায়ে আরো ১৭টি রাজ্য ও ২টি ইউনিয়ন টেরিটরিতে ভোটগ্রহণ হয়েছে৷ ছয় সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলবে সাত পর্বের এই নির্বাচন৷
বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ভোটার হলেন ৯০ কোটি৷ প্রায় দশ লাখের মতো ভোটকেন্দ্রে লোকসভার ৫৪৫টি আসনের মধ্যে ৫৪৩টি আসনের জন্য ভোটগ্রহণ হবে৷ বাকি দু'টি আসনের সদস্য প্রেসিডেন্ট সরাসরি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় থেকে মনোনীত করবেন৷
মোট ৪৩ কোটি নারী ভোট দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে৷ আর নতুন ভোটার ৮ কোটি ৪০ লাখের মতো৷
২০১৪ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি বিপুল ব্যবধানে জয় নিয়ে সরকার গঠন করে৷ এবারকার জরিপগুলোও মোদীকেই এগিয়ে রাখছে৷ তবে আগেরবারের মতো বড় ব্যবধানে জয় পাওয়ার আশা দুরাশা হবে৷
বিজেপি'র আইনপ্রণেতা রাকেশ সিনহা প্রধানমন্ত্রী মোদীর অর্জনের প্রশংসা করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যদি কেউ আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো মূল্যায়ন করে, তাহলে একে সমাজবাদী সরকারই মনে করবে৷ আমাদের সরকার গরিবদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা তৈরি করেছে; যেগুলোর আওতায় আগে কেবল মধ্যবিত্ত পর্যন্ত লোকেরা ছিলেন৷''
ভোটের যুদ্ধে ভারত
01:52
নির্বাচনি ইশতাহারে বিজেপি কৃষকদের কল্যাণ, জাতীয় নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, স্বাস্থ্য সেবা ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে৷ এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে সম্প্রতি কাশ্মীরকে ঘিরে যে বৈরিতা তৈরি হয়েছিল, তার কথাও রয়েছে তাদের নির্বাচনি প্রচারণায়৷
তবে মোদী বিরোধীরা বার বার তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনলেও তা ধোপে খুব একটা টেকেনি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ ‘‘তাঁর দুর্নীতিপরায়ণ ইমেজ কিন্তু নেই৷ তাঁর ‘মোদী ব্র্যান্ড' রাফালে কেলেঙ্কারির মতো বিষয়ে খুব একটা টলেনি, বিশেষ করে সমর্থকদের কাছে৷ কারণ, তাঁরা এতে বিশ্বাস করেন না,'' ডয়চে ভেলেকে বলেছেন সিভোটার নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ইয়াশওয়ান্ত দেশমুখ৷
২০১৪-তে যে কংগ্রেসকে সহজেই হারিয়েছিল বিজেপি, সেই কংগ্রেসই এখন রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী৷ কংগ্রেস তাদের ইশতাহারে সবচেয়ে গরিব ২০ ভাগের নিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছে৷ এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা, সুলভে বাসস্থান ও আগামী পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের হার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে৷ কংগ্রেস বিজেপিকে হারানোর জন্য আঞ্চলিক দলগুলোর জাতীয় জোট করার আহ্বানও জানিয়েছে, যাকে তারা বলছে ‘মহাগাথাবন্ধন'৷ দেশমুখ বলেন, ‘‘যদি দলগুলো তাদের ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তবেই উদ্দেশ্য সফল হবে৷''
ভারতের সাতপর্বের ভোটগ্রহণ শেষ হবে ১৯ মে৷
বিজেপিকে চিনে নিন
ভারতে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি৷ বর্তমানে জাতীয় ও রাজ্যস্তরে সর্বাধিক প্রতিনিধিত্ব রাখা দলটি সদস্য সংখ্যায় বিশ্বের বৃহত্তম৷ ঐতিহাসিকভাবে হিন্দু-জাতীয়তাবাদী অবস্থানের বিজেপির গল্প এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. K. Singh
আদর্শগত উৎস
বিজেপিকে চিনতে হলে ‘সংঘ পরিবার’-এর অন্তর্গত হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলির উৎস আরএসএস অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে জানা দরকার৷ বিশ্বের বৃহত্তম এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা মারাঠি চিকিৎসক কেশব হেডগেওয়ার৷ ১৯২৫ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি৷ ভি ডি সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণই আরএসএস-এর প্রধান উদ্দেশ্য৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে দূরত্ব
কংগ্রেসের নেতৃত্বে চলা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে দূরে ছিল আরএসএস৷ ১৯৪০-এর দশকে সংগঠনের নেতা হিসেবে এম এস গোলওয়ালকর হিন্দু রাষ্ট্র গড়তে ব্রিটিশ বিরোধিতার বদলে ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার ডাক দেন৷ উল্লেখ্য, পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া অটলবিহারী বাজপেয়ী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় সত্যাগ্রহীদের সাথে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ লিখিত মুচলেকা দিয়ে আন্দোলনে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে ছাড়া পান তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M.Desfor
দেশভাগ ও আরএসএস
দেশভাগের সময় আরএসএস পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের সাহায্য করে৷ আরএসএস ও বর্তমানের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কর্মীরা মনে করেন, দেশভাগ মুসলিমদের প্রতি নরম আচরণের ফল৷ এজন্য গান্ধী ও নেহরুকে বিশেষভাবে দায়ী মনে করেন তাঁরা৷ স্বাধীনতার পর কংগ্রেসকে ঠেকাতে ১৯৫১ সালে জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়৷ সেই জনসংঘই আসলে বিজেপির উৎস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
জরুরি অবস্থা ও জনতা পার্টির জন্ম
১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন৷ বিক্ষোভে অংশ নেয়ার কারণে জনসংঘের অসংখ্য সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা শেষে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন৷ কংগ্রেসকে হারাতে অন্যান্য দলের সঙ্গে মিলে যায় জনসংঘ, জন্ম নেয় জনতা পার্টি৷ নির্বাচনে জিতেও যায় জনতা পার্টি৷ প্রধানমন্ত্রী হন মোরারজি দেশাই৷ স্বাধীন ভারতে সূচিত হয় হিন্দুত্ববাদীদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ জয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিজেপির জন্ম
১৯৮০’র পর দল ও আরএসএসের দ্বৈত সদস্য হবার বিধান না থাকায় জন্ম নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি৷ নতুন দলে নতুন সদস্য যোগ দিলেও, গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল পুরোনোদের দাপট৷ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন বাজপেয়ী৷ মূলত, ইন্দিরা হত্যার পর ভোটে খারাপ করার কারণেই নেতৃত্বে এই পরিবর্তন৷ তবে বিজেপির উত্থান শুরু ১৯৮৪ সালে৷ সে বছর দলের সভাপতি হন লালকৃষ্ণ আডবানি৷ রাম জন্মভূমির দাবিকে ঘিরে তাঁর নেতৃত্বেই শক্তিশালী হতে থাকে বিজেপি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Raveendran
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও বাবরি মসজিদ
নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই বিজেপি সরাসরি ধর্মের রাজনীতিতে নামে৷ বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির গঠনের দাবিতে সারা দেশ থেকে অযোধ্যার পথে রওয়ানা দেয় হাজার হাজার ‘করসেবক’৷ পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে উত্তেজিত জনতা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে৷ এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হন দু’ হাজারেরও বেশি মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
সরকার গঠন ও জোটের রাজনীতি
সাম্প্রদায়িক আবেগকে হাতিয়ার করে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজেপি ১৬১টি লোকসভা আসনে জয়ী হয়৷ প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন অটলবিহারী বাজপেয়ী৷ কিন্তু ১৩ দিন পর, লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার গঠন করতে পারেনি বিজেপি৷ ১৯৯৬ সালে আঞ্চলিক দলগুলির একটি জোট সরকার গঠন করে৷ কিন্তু সেই সরকারের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হয়নি৷ ১৯৯৮ সালে আবার নির্বাচন হয়৷
ছবি: UNI
প্রথম এনডিএ সরকার
নির্বাচনে জিতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) সরকার গড়ে৷ জোটে অংশগ্রহণ করে সমতা পার্টি, অকালী দল, শিব সেনা, নিখিল ভারত আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্র কড়গম (এআইএআইডিএমকে), বিজু জনতা দল ও শিব সেনা৷ ১৯৯৯ সালে তাঁরা সংসদে ৩০৩টি আসন জিতলে বাজপেয়ী তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন৷ পাঁচ বছরের পূর্ণমেয়াদী এই জোট সরকার প্রতিরক্ষা ও সন্ত্রাসের মোকাবিলার পাশাপাশি নব্য-উদার অর্থনীতির ওপর জোর দেয়৷
ছবি: Imago/photothek/T. Koehler
দুর্নীতি ও দাঙ্গায় কোণঠাসা বিজেপি
বিজেপির জয়রথে প্রথম ‘বাধা’ গোধরা দাঙ্গা৷ তীর্থযাত্রীবাহী ট্রেনে আগুন লাগাকে ঘিরে প্রায় ২০০০ মানুষ মারা যান৷ তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতার নাম এই দাঙ্গার সাথে জড়ায়৷ বিজেপি-প্রধান বঙ্গারু লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে ওঠে দুর্নীতির অভিযোগ৷ সব মিলিয়ে বিপন্ন বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোট ২০০৪ সালে নতুন সরকার গড়ে৷ প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং৷
ছবি: AP
নেতৃত্বে কে? মোদী, না আডবাণী?
২০১৪’র লোকসভা নির্বাচনে জেতার পর নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত করে বিজেপি৷ অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, দলের নেতৃত্বের দায়ভার বর্ষীয়ান নেতা এল কে আডবানির ওপর বর্তানোর কথা উঠলেও, বাস্তবে তা হয়নি৷
ছবি: AP
মোদীর উত্থান
বিজেপির ইতিহাসে ব্যক্তিকেন্দ্রীক নির্বাচনী প্রচার মোদীর ক্ষেত্রেই প্রথম৷ পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে মোদীর ‘গুজরাট মডেল’-কে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হয় প্রচারে৷ সুবক্তা মোদী শীঘ্রই হয়ে ওঠেন তরুণ প্রজন্ম থেকে সংবাদমাধ্যম, সকলের প্রিয়পাত্র৷ নির্বাচনের আগে বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে গেলেও, মোদীর প্রাক-নির্বাচন বক্তব্যের বড় অংশ জুড়েই ছিল ‘হিন্দুত্ব’৷
ছবি: picture alliance/AA/M. Aktas
মোদী থেকে ‘মোদীজি’
২০১৪ সালে বিজেপি ২৮২টি আসন জিতে ক্ষমতায় আসে৷ ভোটারদের কংগ্রেসের প্রতি অনাস্থার পাশাপাশি বিজেপির সাফল্যের আরেকটি কারণ ছিল আরএসএসের নিঃশর্ত সমর্থন৷ নরেন্দ্র মোদীই হন প্রধানমন্ত্রী৷ পিউ গবেষণা কেন্দ্রের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রথম বছরের তুলনায় বর্তমানে মোদীর জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে, যা ২০১৯-র নির্বাচনে কংগ্রেস-সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলির জন্যও নিঃসন্দেহে ভাবনার বিষয়৷