নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম দিনে সার্ক দেশগুলির রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন৷ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক নাকি ছিল খুবই ইতিবাচক৷
বিজ্ঞাপন
প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী তাঁর কাজের প্রথমদিনে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি ঝালিয়ে নিয়ে৷ সেই লক্ষ্যে তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সার্ক দেশগুলির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের অবস্থান নিয়ে আলোচনার সুযোগকে কাজে লাগান৷ বলা যায়, স্রেফ কূটনৈতিক সৌজন্যে তা সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং কূটনৈতিক সংযোগের মাধ্যমে পরস্পরকে নতুন করে জানা ও বোঝা৷ সেদিক থেকে সকলের চোখ ছিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠকের দিকে, যা নিয়ে প্রথম দিকে একটা ধোঁয়াশা ছিল যে নওয়াজ শরিফ দিল্লি আসবেন কিনা৷ কিন্তু তিনি শুধু একা আসেননি৷ সঙ্গে নিয়ে এসেছেন উচ্চস্তরের এক প্রতিনিধিদল৷ নির্ধারিত সময় ছিল ৩০ মিনিট, কিন্তু চলে ৫০ মিনিট ধরে৷
বৈঠক শেষে নওয়াজ শরিফ মোদীর সঙ্গে আলোচনাকে অত্যন্ত ভালো ও ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন৷ আশা প্রকাশ করেছেন এর ফলাফল হবে ইতিবাচক৷ আলোচনা হয় কী কী ইস্যু নিয়ে? ভারতের তরফে মূলত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার ওপার থেকে জঙ্গি হামলা বন্ধ করা, মুম্বই সন্ত্রাসী হামলার অভিযুক্তদের দ্রুত বিচার এবং দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির স্বার্থে ভারতকে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের মর্যাদা দেবার দাবি জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী৷
প্রসঙ্গত, আফগানিস্তানের হেরাটে ভারতীয় কনসুলেটে জঙ্গি হামলার বিষয়টিও ওঠে বলে জানা গেছে৷ কারণ আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ঐ জঙ্গি হামলার জন্য অভিযোগের আঙুল তোলেন পাকিস্তানের মদতপুষ্ট লস্কর-ই-তৈয়বার দিকে৷ কাজেই পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গিরা বিদেশেও যে ভারতকে নিশানা করছে সে বিষয়ে ভারতের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন তিনি৷
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বলেন, ১৯৯৯ সালে তিনি ও তৎকালীন বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী যেখানে শেষ করেছিলেন, সেই সূত্র থেকেই আবার তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শুরু করতে চান৷ দীর্ঘদিনের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ একটা ধারাবাহিক আস্থার ঘাটতি তৈরি করেছে৷ তাই ভবিষ্যতের জন্য দরকার একটা অনকুল পরিস্থিতি গড়ে তোলা৷ নওয়াজ শরিফ মোদীকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং তিনি তা গ্রহণ করেন৷ তার আগে দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিবস্তরে বৈঠক হবে৷ কাশ্মীর নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি৷ উল্লেখ্য, এবারের দিল্লি সফরে নওয়াজ শরিফ কাশ্মীরের বিচ্চিন্নতাবাদী হুরিয়াত সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেননি৷
বাংলাদেশ সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিস্তা জল বণ্টন চুক্তি এবং স্থলসীমা চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের দিকে মোদীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন৷ মোদী তাতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন বলে বলা হয়েছে৷ শিরীন চৌধুরিও মোদীকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানান৷
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের সঙ্গে বৈঠকে ওঠে ভারতীয় মৎসজীবীদের ইস্যু, যাঁরা শ্রীলঙ্কার জলসীমা অতিক্রম করার অভিযোগে হামেশাই হয়রানির শিকার হচ্ছে৷ অথচ এটা তাঁদের রুজি-রোজগারের বিষয়৷ শ্রীলঙ্কা সরকারকে এ বিষয়ে আরো মানবিক হবার অনুরোধ জানানো হয়৷ দ্বিতীয়ত, তামিলদের অধিকার হস্তান্তরের জন্য শ্রীলঙ্কা সংবিধানের ১৩নং সংশোধনের কথাও বলা হয়৷ তামিল ইস্যুতে ভারতের তামিল রাজনৈতিক দলগুলি যে অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সেটা মাথায় রেখে একটা জাতীয় সমঝোতার পথে এগিয়ে যাবার দাবিও জানানো হয়৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷