অসাধারণ জয় পেয়েছেন মমতা। কিন্তু এরপর আরো অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তিনি।
বিজ্ঞাপন
মোদী-শাহের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করেছেন, বিশাল জয় পেয়েছেন, এরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে অপেক্ষা করছে আরো অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিশ্রুতি পূরণের চ্যালেঞ্জ। যে প্রতিশ্রুতি তিনি ভোটের আগে ইস্তাহারে দিয়েছেন। সেই তালিকাটা রীতিমতো লম্বা। আগামী পাঁচ বছরে যদি তিনি সেই প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারেন, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিপুলভাবে উপকৃত হবেন। কিন্তু সেই সব প্রতিশ্রুতি পালন করা রীতিমতো কঠিন।
গরিবি হঠাও এবং কর্মসংস্থান
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি, পাঁচ বছরে ৩৫ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য রেখার থেকে উপরে তোলা হবে। তার মানে বছরে সাত লাখ অত্যন্ত গরিব মানুষ একটু স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখবেন। তারপর অতি-গরিব মানুষের সংখ্যা থাকবে মাত্র পাঁচ শতাংশ। কীভাবে এই কাজ করা হবে, তার কোনো রূপরেখা ইস্তাহারে নেই।
ইস্তাহারের প্রতিশ্রুতি, প্রতি বছর পাঁচ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান হবে। রাজ্যে এখন বেকারের সংখ্যা বলা হয়েছে ২১ লাখ। প্রতি বছর নতুন বেকার যুক্ত হয়। পাঁচ লাখ কর্মসংস্থান দিয়ে পাঁচ বছর পরে বেকারের সংখ্যা অর্ধেক হবে বলে দাবি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জিডিপি বাড়বে এবং শিল্পের বিকাশ ঘটবে, তাতেই কর্মসংস্থান তৈরি হবে। সাধারণ মানুষের কাছে এটা কোনো বার্তা দেয় কি? দেয় না। বরং এর চেয়ে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি হলো, আগামী এক বছরে বিভিন্ন সরকারি দফতর ও পুলিশে এক লাখ ১০ হাজার খালি পদ পূরণ করা হবে।
শিল্পের প্রতিশ্রুতি
রাজ্যে প্রতি বছর ১০ লাখ ছোট ও মাঝারি শিল্প হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। পাঁচ বছরে বড় শিল্পের দুই হাজারটি ইউনিট যুক্ত হবে। আর বিনিয়োগ হবে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। মানে বছরে এক লাখ কোটি টাকা। এই তিনটি প্রতিশ্রুতি রূপায়ণ করা রীতিমতো কঠিন। বিশেষ করে অতীত অভিজ্ঞতার নিরিখে। যিনি অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী হবেন, তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়ার মতো প্রতিশ্রুতি।
পশ্চিমবঙ্গে জয়ের প্রতিক্রিয়া, হারের সাফাই
পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করবে তৃণমূল। তৃণমূলের বিপুল জয়ের পর কে কেমনভাবে হার বা জয়ের প্রতিক্রিয়া দিলেন?
ছবি: AP Photo/picture alliance
বাংলা পারে, বললেন মমতা
মমতা-ঝড়ে উড়ে গেছে মোদী-শাহের বিজেপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম প্রতিক্রিয়া, ''বাংলা পারে। এটা বাংলার জয়।'' পরে বললেন, ''এই জয় বাংলার মানুষকে বাঁচিয়ে দিল।'' নন্দীগ্রামের খবরে মমতা বললেন, ''আমরা পুনর্গণনা চাই।'' আদালতে যাওয়ার কথাও বললেন। তবে মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, এখন বিজয় উৎসব নয়। এখন প্রথম কাজ, করোনার মোকাবিলা করা। তাই সকলের জন্য বিনা পয়সায় মোদীর কাছ থেকে টিকা চেয়েছেন। না দিলে ধরনার হুমকিও।
ছবি: AFP/Getty Images
মোদীর টুইট
পশ্চিমবঙ্গের ফল বেরনোর পর টুইট করে নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মমতাকে অভিনন্দন জানিয়ে মোদী বলেছেন, বিধানসভায় তাদের উপস্থিতি বিপুলভাবে বেড়েছে। বিজেপি এখন রাজ্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাবে। অমিত শাহও বলেছেন, বিজেপি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে রাজ্যের মানুষের স্বার্থে ও উন্নতির জন্য কাজ করবে।
ছবি: Kuntal Chakrabarty/IANS
দিলীপ ঘোষের সাফাই
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, তারা যে লক্ষ্য নিয়েছিলেন, সেই তুলনায় তাদের সাংগঠনিক শক্তি ছিল না। তাদের আরো লড়াই করতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৫ বছর লড়াই করে ক্ষমতায় এসেছেন। বিজেপি-কেও রাজ্যে অনেক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
ছবি: Imago Images/Pacific Press Agency/S. Paul
অধীরের যুক্তি
অধীর চৌধুরী বলছেন, ''সাম্প্রদায়িক প্রচারের কাছে হেরেছি। মমতা সাম্প্রদায়িক প্রচার করলেন। মোদীকে ঠেকাতে দিদিকে ভোট দাও। কংগ্রেস যে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মোদীর বিরুদ্ধে লড়ছে, লড়বে সেই ভরসা মুসলিমরা রাখতে পারলেন না। আমরা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মুসলিমরা মারা গেলেন। প্রচার হলো, মোদী মুসলিমদের মারবে। এর মোকাবিলা আমরা করতে পারলাম না।''
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
হার স্বীকার রাহুল গান্ধীর
ভোটে বিপর্যয়ের পর রাহুল গান্ধী বলেছেন, ''আমরা সবিনয়ে হার স্বীকার করে নিলাম। আমাদের নেতা ও কর্মী, যারা কাজ করেছেন এবং লাখ লাখ মানুষ যারা আমাদের সমর্থন করেছেন, সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা আমাদের মতাদর্শ ও মূল্যবোধের লড়াই চালিয়ে যাব।''
ছবি: Getty Images/AFP/S. Hussain
বিমান বসুর বক্তব্য
জন্মলগ্নের পরে এই প্রথম বামেদের কোনো প্রতিনিধি বিধানসভায় থাকবেন না। বাম জোটের তরফে বিমান বসু বলেছেন, ''জনগণ বিজেপি-কে পরাস্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই তৃণমূল লাভবান হয়েছে। আমরা যৌথ পর্যালোচনা করব। এই হার থেকে শিক্ষা নেব। আমাদের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল।''
ছবি: UNI
আইএসএফ চুপ
ভোটের কিছুদিন আগে দল গঠন করেছিলেন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি। ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ। তারা হাত মেলায় বাম ও কংগ্রেসের সঙ্গে। জোটের হয়ে একমাত্র জয় আব্বাসের ভাই নওসাদ সিদ্দিকির। কিন্তু এরপর প্রতিক্রিয়া দেননি আব্বাস। তবে দিল্লিতে কংগ্রেস মুখপাত্র বলেছেন, আইএসএফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভালো হয়েছে না ভুল হয়েছে, তা পরে পর্যালোচনা করা হবে।
ছবি: Naushad Bhai
পিকে-র প্রতিক্রিয়া
তৃণমূলকে জেতানোর পিছনে তার কৌশলও কাজ করেছে। সেই প্রশান্ত কিশোর বা পিকে-র প্রতিক্রিয়া, ''কঠিন লড়াই ছিল। নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা আছে বলে বিজেপি সব লড়াই জিতবে তার কোনো মানে নেই।'' পিকে দাবি করেছিলেন, বিজেপি একশ ছুঁতে পারবে না। সেটা মিলেছে। তারপরেও পিকে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেছেন, ''আমাদের প্রচার করতে অসুবিধা হচ্ছিল।'' তবে এই জয়ের পর তার ঘোষণা, আর কোনো দলের হয়ে কাজ করবেন না তিনি।
ছবি: Hindustan Times/Imago Images
8 ছবি1 | 8
শিক্ষা ও শিক্ষক
মমতার প্রতিশ্রুতি প্রতিটি ব্লকে একটি করে মডেল আবাসিক স্কুল হবে। পার্শ্ব শিক্ষকদের বছরে বেতন তিন শতাংশ করে বাড়বে, অবসরের পর তারা তিন লাখ টাকা করে পাবেন। পার্শ্ব শিক্ষক মানে স্কুলগুলিতে ২০০৪ সাল থেকে ক্লাসে পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের সহায়তা করার জন্য নিয়োগ করা শিক্ষক। পশ্চিমবঙ্গে তারা মাসে ১৩ হাজার ৭০০ টাকা করে পান। অথচ, তাদের পুরো সময়ের শিক্ষকদের মতোই ক্লাস নিতে হয়।
ডাক্তার, নার্সদের সংখ্যা দ্বিগুণ
প্রতিটি জেলায় মেডিকেল কলেজ, অতিরিক্ত সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এবং ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়েছে ইস্তাহারে। এই প্রতিশ্রুতির রূপায়ণও খুবই চ্যালেঞ্জিং। সব পরিবারকে স্বাস্থ্য সাথীর আওতায় নিয়ে আসা হবে।
পাঁচ টাকায় ডিম-ভাত
কলকাতা পুর এলাকায় এবং মফস্সলে মাত্র পাঁচ টাকায় ডাল-সবজি-ডিম-ভাত। ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রীর মাস্টারস্ট্রোক বলছেন অনেকে। বিরোধীদের প্রশ্ন, রাজ্যের সব মানুষ কেন পাবে না?
ছবি: Sirsha Bandyopadhyay/DW
মা ক্যান্টিন
কলকাতা পুরসভার বিভিন্ন বরো-তে রাস্তার ধারে, পার্কের ভেতর তৈরি হয়েছে মা ক্যান্টিন।
ছবি: Sirsha Bandyopadhyay/DW
পাঁচ টাকায় ভরপেট
মাত্র পাঁচ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে ডাল-সবজি-ডিম-ভাত। প্রতিদিন দুপুর ১টা থেকে ২টো।
ছবি: Sirsha Bandyopadhyay/DW
কাতারে সবাই
শুধু এলাকার গরিব বাসিন্দারাই নন, মধ্যবিত্ত মানুষজনও ভিড় জমাচ্ছেন মা ক্যান্টিনে।
ছবি: Sirsha Bandyopadhyay/DW
স্কুলের রান্নাঘরে
সরকারি স্কুলের মিড ডে মিল রাঁধার যে ব্যবস্থা, সেটাকেই কাজে লাগানো হচ্ছে খাবার বানাতে।
ছবি: Sirsha Bandyopadhyay/DW
সরকারি ডিম
সরাসরি খামারিদের থেকে ডিম আনার ব্যবস্থা করেছে সরকার। তাই দিয়েই চলছে ক্যান্টিন।
ছবি: Sirsha Bandyopadhyay/DW
ঘড়ি ধরে কাজ
ঠিক সময়ে এসে হাজির হচ্ছে পুরসভার গাড়ি। বিভিন্ন কিয়স্কে খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
ছবি: Sirsha Bandyopadhyay/DW
সুষ্ঠু ব্যবস্থা
এলাকার পুরকর্মীরাই দায়িত্ব নিয়েছেন খাবার বিলি করার। বাসিন্দারাও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন তাঁদের পালা আসার।
ছবি: Sirsha Bandyopadhyay/DW
সসম্মানে খাওয়া
গরিবের লঙ্গরখানার চেনা ছবি নয়, সুন্দর করে সাজানো টেবিলে, রঙিন ছাতার তলায় খেতে বসছেন সকলে।
ছবি: Sirsha Bandyopadhyay/DW
বিরোধী কাঁটা
শহরের লোকেরা পেটপুরে খাচ্ছেন, কিন্তু জেলার লোকেরা কেন পাবেন না? প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা।
ছবি: Sirsha Bandyopadhyay/DW
9 ছবি1 | 9
খাদ্য ও সাহায্য
মমতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, রাজ্যের ৫০টি শহরে মা ক্যান্টিন খোলা হবে। যেখানে পাঁচ টাকায় ডিম-ভাত পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে রেশন বাড়িতে পৌঁছে দেবে সরকার। গরিব পরিবারের কত্রীরা মাসে ৫০০ টাকা ও তফসিল জাতি ও উপজাতির ক্ষেত্রে হাজার টাকা পাবেন। বছরে দুই বার 'দুয়ারে সরকার' পরিকল্পনা নেয়া হবে।
এত প্রতিশ্রুতি পালন করা কতটা কঠিন? প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''কয়েকটা কাজ মমতা করবেন। স্বাস্থ্য সাথী বা পাঁচ লাখ টাকার বিমা প্রকল্প করবেন। মানুষকে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দেবেন। গরিব পরিবারের মেয়েদের পাঁচশো টাকা দেয়া বা মা ক্যান্টিন করা এসবও করবেন।'' কিন্তু শুভাশিস মনে করেন, ''শিল্প আনা থেকে শুরু করে বাকি কাজগুলোর জন্য প্রচুর অর্থ লাগবে। এটা করা অসম্ভব নয়।
কিন্তু কঠিন, খুবই কঠিন। সরকারি হিসাবে অনেক কিছুই হয়ে যায়। বাস্তবের মাটিতে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়ার কাজটা মমতার কাছে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।'' ফলে বিজেপি-র চ্যালেঞ্জ তিনি অতিক্রম করেছেন ঠিকই, তবে আরো অনেক বড় চ্যালেঞ্জ তার জন্য অপেক্ষা করছে।