এক রিপোর্ট বলছে, আগামী ২০ বছরে গঙ্গা নদী-ভিত্তিক প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার মৃত্যু হতে পারে যদি না গঙ্গার জলপ্রবাহ অবাধ ও দূষণমুক্ত করা হয়৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীর গঙ্গা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প সেই লক্ষ্যে এক ইতিবাচক পদক্ষেপ৷
বিজ্ঞাপন
তবে নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মেগা প্রকল্পে অতীতের ভুলভ্রান্তি পরিহার করা জরুরি৷
ভারতবর্ষ নদীমাতৃক দেশ৷ গোটা উত্তর ও পূর্ব ভারতের বৃহত্তর জনজীবন শস্য শ্যামল হয়ে উঠেছে এই গঙ্গা নদীকে ঘিরে৷ কিন্তু অকৃতজ্ঞের মতো গঙ্গার সঞ্জীবন শক্তিকে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে৷ প্লাস্টিকের আবর্জনা, গঙ্গার দু পাড়ের কলকারখানার দূষিত নোংরা পানি, পুজার ফুল বেলপাতা আর অর্ধদগ্ধ শব ও শবদাহের পোড়া কাঠ আর শ্মশানের পড়ে থাকা আবর্জনা ফেলে গঙ্গাকে মেরে ফেলা হচ্ছে৷
পানির সংকটে বন্দি জীবন
ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লিতে এখন চলছে তীব্র তাপদাহ এবং পানির সংকট৷ চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় ঝলসে যাচ্ছেন দিল্লিবাসী৷
ছবি: DW
তাপদাহ
গ্রীষ্মের সময়ে পানির সংকট লাখ লাখ দিল্লিবাসীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে৷ আবহাওয়ার কাছে বড় বেশি অসহায় তারা৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন৷
ছবি: DW/M. Krishnan
পানি বিতরণ
নতুন দিল্লির দক্ষিণের একটি বস্তিতে পানি বিতরণের ছবি এটি৷ বস্তিবাসীদের জন্য নিয়মিত পানির সংযোগ নেই৷ মূলত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষ এখানে বাস করে৷
ছবি: DW/M. Krishnan
ঘুসের বিনিময়ে পানি
পানির জন্য এভাবেই লড়াই করতে হয় বস্তির মহিলাদের৷ পৌরসভার পানি বিতরণের এই সেবা বিনা খরচার হওয়ার কথা৷ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পানির জন্য ঘুস দিতে হয়৷ মোটের উপর পানির ট্যাংকার নিয়মিত আসেও না৷
ছবি: DW
আকাল এবং বর্জ্যের মধ্যে
পানির জন্য এ রকম অপেক্ষা বস্তিবাসীর জীবনে এক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এত অপেক্ষার পর যে পানিটুকু মেলে তাও আবার অধিকাংশক্ষেত্রে পরিষ্কার থাকে না৷ ময়লা পানি নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই তাদের৷
ছবি: DW
সবচেয়ে বিপদে আছেন যারা
দিল্লির বস্তি এবং কোলোনিগুলোতে অবস্থানরতরা পানি সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন৷
ছবি: DW
দৈনিক রুটিন
নিয়মিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থার আওতায় আসা এই মানুষদের কাছে স্বপ্নের ব্যাপার৷ পৌরসভার পানির ট্যাংকার তাই ভরসা তাদের৷ ছবিতে এক ব্যক্তি পৌরসভার ট্যাংকার থেকে পানি নিয়ে ভ্যানে করে বাড়ি ফিরছেন৷
ছবি: DW/M. Krishnan
অপর্যাপ্ত সরবরাহ
এসব পানির পাত্র পূর্ণ করতে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয় বস্তিবাসীকে৷ কিন্তু তারপরও অপর্যাপ্ত সরবরাহের জন্য সবাই পানি পায় না৷ এই পরিস্থিতির পরিবর্তনে সরকারও বিশেষ উদ্যোগী নয়৷
ছবি: DW
7 ছবি1 | 7
এবার নরেন্দ্র মোদী তীর্থ শহর বারাণসী থেকে সংসদে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন৷ তাই ভোটের আগে এবং পরে বারাণসী তথা গঙ্গা নদীর পুনরুজ্জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ সেই প্রতিশ্রুতি পালনে প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর সরকারের প্রথম বাজেটে বরাদ্দ করেন ৬,৩০০ কোটি টাকা৷
কি আছে এই মেগা গঙ্গা প্রকল্পে?
এই প্রকল্পে ২,০৩৭ কোটি টাকা খরচ করা হবে নদীর পুনরুজ্জীবনে আর ৪,২০০ কোটি টাকা আগামী পাঁচ বছরে নদীর নাব্যতা বাড়িয়ে নৌ-চলাচলের জন্য বিশেষ করিডর গড়ে তোলার কাজে খরচ করা হবে৷ আর ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে গঙ্গাঘাটগুলির সংস্কার এবং নদী তীরের সৌন্দর্যায়নে৷
পাশাপাশি গঙ্গা নদীকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে নানারকম কর্মসূচি হাতে নেয়া হবে৷ যেমন, গঙ্গায় নৌকা বিহারের জন্য কাশ্মীরের ধাঁচে শিকারা, ভাসমান হোটেল ইত্যাদি নির্মাণ করা হবে৷ বারাণসী ও হুগলির মধ্যে গঙ্গাপথের নাব্যতা বাড়াতে প্রতি ১০০ কিলোমিটার অন্তর একটি সেতু নির্মিত হবে৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা করতে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে নদী বিশেষজ্ঞ, এনজিও ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব বহিরাঙ্গিক প্রসাধনী বিকাশে কি প্রকৃত সমস্যার সমাধান হবে? গঙ্গা নদী কি তার জীবন ফিরে পাবে? অতীতেও ‘অ্যাকশন প্ল্যান' ‘গঙ্গা বাঁচাও গণআন্দোলন' হয়েছিল৷ কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই৷ বর্তমান গঙ্গা প্রকল্পে অতীতের সেইসব ভুলভ্রান্তি তাই প্রথমে পরিহার করতে হবে৷ তা না হলে নদীর ভঙ্গুর ইকো-সিস্টেম আরো ভেঙে পড়বে৷
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গঙ্গার দুই তীরের শতাধিক শহরে অবস্থিত কলকারখানা ও গৃহস্থ বাড়ি থেকে দৈনিক ৩০০ কোটি লিটার নোংরা, বর্জ্য পদার্থ ও বিষাক্ত নিকাশি জল গঙ্গায় ফেলা হয়৷ ভারতের বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র ডয়চে ভেলেকে জানান, কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ এবং বিষাক্ত রাসায়নিক নদীতে যাতে বিনা ট্রিটমেন্টে ফেলা না হয়, সেটা সুনিশ্চিত করতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে৷ এরই সঙ্গে জাগিয়ে তুলতে হবে জনমানসে সচেতনতা৷ তারজন্য চাই একটা প্লাটফর্ম বা মঞ্চ৷
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের মতে, গঙ্গা পাড়ের শ্মশানে বছরে ৩৩ হাজার মরা পোড়ানো হয়৷ তারজন্য জ্বালাতে হয় ১৬ হাজার টন কাঠ৷ তা থেকে বের হয় ৭০০ টন ছাই ও অন্যান্য আবর্জনা৷ এরথেকেও বড় সমস্যা বাঁধ নির্মাণ৷ গঙ্গার ওপর ৬০০ বাঁধের নির্মাণ হয় সম্পূর্ণ হয়েছে, না হয় নির্মীয়মান অবস্থায় আছে৷ তাই প্রথমে দরকার যথেচ্ছ বাঁধ নির্মাণে কড়াকড়ি৷ বাঁধ নির্মাণের ফলে গঙ্গার জলপ্রবাহ আটকে টানেলে প্রবাহিত করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে৷ এতে স্থানীয় মানুষজনদের জীবিকাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই নয়, জীববৈচিত্র্য ও পারিপার্শিক ইকো-সিস্টেম বিপন্ন হয়ে পড়ে৷ এটাকে আগে মাথায় রাখতে হবে৷ নাহলে মোদীর মেগা গঙ্গা প্রকল্প অতীতের মতোই সাফল্যের মুখ দেখবে না৷ তাই করণীয় হলো মেকি শ্লোগান, মিছিলের বদলে সত্যিকারের সচেতনতা৷ না হলে প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে কেউ রক্ষা পাবে না৷