বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা এখন অনেকটাই ‘রিল্যাক্সড'৷ তাঁরা কেন্দ্রের ইঙ্গিতেই এই অবস্থান নিয়েছেন৷ ঢাকায় তৃণমূল পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, আপাতত তাঁদের কোনো আন্দোলনের প্রস্তুতি নেই৷ বরং তাঁরা কে কোন পদ পাবেন – তাই নিয়ে তদবির এবং লবিং করে সময় কাটাচ্ছেন৷
তাঁরা জানান, জাতীয় কাউন্সিলের আগেই ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড, এমনকি পাড়া মহল্লার কমিটিও চূড়ান্ত করা হবে৷ কমিটি চূড়ান্ত করার পরই হয়ত নতুন কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়া হবে৷ তাই ঈদের আগে স্বাভাবিক কারণেই কোনো আন্দোলনের প্রস্তুতি নেই তাঁদের৷ এঁদেরই কয়েকজন জানান, ভারতে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসায় বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন৷ তাঁদের সঙ্গে দেখা-সক্ষাতে তাঁরা উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছেন৷ তাঁরা মনে করেন, কংগ্রেস সরকারের ‘গুড বুক'-এ থাকলেও বিজেপি সরকারের ‘গুড বুক'-এ থাকার সম্ভাবনা কম বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের৷ তাই তাঁরা মোদী সরকারের নীতি ও পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণের পরই নতুন আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন৷
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
ঢাকার বাইরে তৃণমূলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেও একই চিত্র পাওয়া গেছে৷ তাঁরাও জানান যে, তাঁরা নতুন কমিটি গঠন এবং দল গোছানোর কাজেই এখন ব্যস্ত৷ আপাতত তাঁদের কঠিন কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তুতি বা নির্দেশনা নেই৷ তাই তাঁরা এ সব নিয়ে এখন তেমন ভাবছেনও না৷ কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে যে, পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি৷ ঈদ আর রোজার কারণে আরো আড়াই থেকে তিন মাস আন্দোলন জমানো যাবে না বলেও জানিয়েছেন তাঁরা৷
এদিকে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আহমেদ আজম খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা সঠিক তথ্যই দিয়েছেন৷ কারণ বর্তমান সরকার যেভাবে নিপীড়কে পরিণত হয়েছে, তাতে অবস্থান শক্ত না করে সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়া বাস্তবসম্মত নয়৷ সে কারণেই অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এবার সংগঠনকে শক্তিশালী করার কাজ চলছে৷ বিশেষ করে তৃণমূলের নেতৃত্বকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে৷ এ অবস্থায় তাই সহসাই সরকার পরতনের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হচ্ছে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘ভারতে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির জয়ে আমরা খুশি নই৷ আমরা খুশি কংগ্রেসের পতনে৷ কারণ তারা বাংলাদেশের একটি অগণতান্ত্রিক একতরফা নির্বাচনে নগ্নভাবে সমর্থণ দিয়েছে৷ তারা কূটনৈতিক শিষ্টাচারও রক্ষা করেনি৷ তাই এখন মোদী সরকার বাংলাদেশের ‘অবৈধ' সরকারের ক্ষেত্রে কী মনোভাব দেখায়, তা পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি৷''
আহমেদ আজম খানের কথায়, ‘‘ভারতের নতুন গণতান্ত্রিক সরকার, বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক সরকার না নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার দেখতে চায় – সেটাই এখন জানতে চায় বিএনপি৷ তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সরকার পতনের কঠোর আন্দোলনে যেতে সময় নিচ্ছে তাঁর দল৷''