ভারতের নতুন সরকার নিয়ে বাংলাদেশ কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না৷ তাই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকারের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধি দল দিল্লি যাবে বলে জানা গেছে৷ এছাড়া মোদীর প্রথম বিদেশ সফর যেন বাংলাদেশে হয় সে চেষ্টাও চলছে৷
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিক মোহাম্মদ জমির মনে করেন, ভারতের নতুন এই সরকার কংগ্রেসের বিপরীত৷ সেকারণে বাংলাদেশ সরকার চাইছে যেন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো ঝুঁকি তৈরি না হয়৷ তার জন্য আগেভাগেই ব্যবস্থা নিচ্ছে৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
শুধু সরকার নয়, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলই এখন বিজেপি এবং মোদীকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত৷ শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া রবিবার মোদীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন৷
এদিকে ভারতের নতুন মন্ত্রিসভা গঠন হওয়ার পর পরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এবং প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল দুই দিনের সংক্ষিপ্ত সফরে ভারত যাবেন বলে জানা গেছে৷ বাংলাদেশ সরকার চাইছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর মোদী যেন সবার আগে বাংলাদেশ সফরে আসেন৷ প্রতিনিধি দলটি সে চেষ্টাই চালাবে৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোনে এবং চিঠিতে এরইমধ্যে মোদীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিক মোহাম্মদ জমির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘উদ্যোগগুলো একটু আগাম হলেও এর যৌক্তিক কারণ আছে৷ ভারতের নতুন সরকার যারা গঠন করছেন তারা কংগ্রেসের থেকে ভিন্ন আদর্শের৷ তাই বাংলাদেশ সরকার চাইছে, যে দূরত্ব আছে তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে৷ বাংলাদেশ সরকার ভারতের নতুন সরকার নিয়ে কোনো ঝুঁকিতে থাকতে চাইছে না৷ তাই খুব দ্রুত মোদী সরকারের প্রকৃত মনোভাব জানতে চাইছে তারা৷''
মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘‘নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ নিয়ে মোদীর নানা ধরণের বক্তব্য এখানে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে৷ তাই বাংলাদেশ সরকার চাইবে আসলেই যেন কোনো বিতর্কিত কাজের সূচনা না করে মোদী সরকার৷ আর এসব কারণেই ভারতের নতুন সরকার নিয়ে বাংলাদেশে তৎপরতা একটু বেশি৷''
তিনি বলেন, ‘‘কৌশলগত এবং ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এছাড়া নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে৷ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পানিবণ্টন, সীমান্ত, সমুদ্রসীমা এবং সীমান্ত হত্যাসহ নানা বিষয়ে সমঝোতার বাকি আছে, যা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা এবং উদ্যোগ প্রয়োজন৷''
মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘‘এতদিন কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি বোঝাপড়া ছিল৷ সেই বোঝাপড়ায় যাতে ছেদ না পড়ে এবং সমস্যা সমাধানে যাতে সামনে আরো এগিয়ে যাওয়া যায় তার চেষ্টাই করছে বাংলাদেশ সরকার৷'' আর বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলও মোদী সরকারের গুড বুকে থাকতে চাইছে৷ এটাই স্বাভাবিক৷ কারণ ভারত সরকারের মনোভাব বাংলাদেশের অনেক কিছুর ওপরই প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন মোহাম্মদ জমির৷