মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় বৈঠকে ১০টি কাজকে অগ্রাধিকার দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ অগ্রাধিকার দিতে হবে সুশাসন, মানুষের কাছে দ্রুত পরিষেবা পৌঁছে দেয়া ও সময়-ভিত্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে৷
বিজ্ঞাপন
বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সরকারের নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বৃহস্পতিবার ২৯শে মে তাঁর মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় বৈঠকেই সরকারের আগামী ১০০ দিনের কাজের অ্যাজেন্ডা স্থির করে দিলেন৷ পুরোদমে কাজে নেমে সেই লক্ষ্যে কর্মসূচির রোডম্যাপও তৈরি করতে বললেন তিনি, যার বীজমন্ত্র হবে দক্ষ প্রশাসন, কর্মসূচি বাস্তবায়নের সুফল মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেয়া ইত্যাদি৷ তিনি মনে করেন, রাজ্যগুলির অগ্রগতি দেশের সার্বিক বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ৷ রাজ্য সরকার এবং সাংসদরা যেসব ইস্যু সরকারের সামনে আনবেন, সেগুলিকে অগ্রাধিকারের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে৷ মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু সাংবাদিকদের এ কথা জানান৷
মোদী সরকারের ১০০ দিনের অ্যাজেন্ডার মূল লক্ষ্য: বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়, আমলাদের আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা, প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জল, এনার্জি ও রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেয়া, নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনাকে স্বাগত জানানো, নীতি রূপায়ণ হবে সময়-ভিত্তিক এবং জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে আরো বেশি কাজে লাগানো৷ সর্বোপরি, উন্নয়নের সুফলকে দ্রুত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া৷ এছাড়া সাবেক কংগ্রেস-জোট সরকারের যেসব কাজ পড়ে আছে, নীতি পঙ্গুত্বের কারণে তা সম্পূর্ণ করতে হবে৷সরকারি কাজকর্মের জন্য যে টেন্ডার ডাকা হয় এবার থেকে তার জন্য জোর দেয়া হবে ই-অকশনের ওপর৷ টু-জি কেলেঙ্কারির প্রধান কারণই ছিল নিলাম বা অকশন না করা, এমনটাই অভিযোগ৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
উল্লেখ্য, মোদীর নির্বাচনি প্রচার অভিযানের মূলকথা ছিল উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি৷ পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের সমালোচনা করেছিলেন মুদ্রাস্ফীতি, নীতি পঙ্গুত্ব, দুর্নীতি এবং প্রবৃদ্ধির ঘাটতির জন্য৷ বিজেপির নির্বাচনি ইস্তেহারে অঙ্গিকার করা হয়েছিল অর্থনীতির হাল ফিরিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর৷ প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের মুখ্যসচিব নৃপেন্দ্র মিশ্র, যাঁকে মোদী স্বয়ং বেছে নিয়েছেন, তিনি জোর দেন আমলাতন্ত্রের আস্থাবোধ ফিরিয়ে আনার ওপর৷ কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজস্ব বিচার বুদ্ধি খাটাতে তাঁদের সব সময়েই একটা দ্বিধাভাব থাকতো – যার জন্য বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়নি, হাইওয়ে নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি, ভারতের বিশাল প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তার রপ্তানি তলানিতে৷ পক্ষান্তরে ভারতকে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করতে হচ্ছে৷ এর অন্তর্নিহিত কারণ শীর্ষস্তরের আমলারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঝুঁকি নেবার সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন৷ রাজনৈতিক বসদের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে তাঁদেরকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়৷ প্রধানমন্ত্রী এই ধারাকে বিপরীতমুখী করার চেষ্টা করছেন৷