মোদী সরকার প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অবস্থান নাকি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়েছেন – সোমবার মোদী-মমতার বৈঠকের পর এমন কথাই শোনা যাচ্ছে৷ এ দিন সংসদ ভবনে মমতার সঙ্গে ছিল একটি বড় মাপের প্রতিনিধিদলও৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar/K. Frayer
বিজ্ঞাপন
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ৯-১০ মাসের মধ্যে তাঁর মুখোমুখি হননি মমতা, এড়িয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সব রকমের সৌজন্য সাক্ষাৎ৷ প্রধানমন্ত্রীর ডাকা রাজ্য-মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকেও যোগ দেননি তিনি৷ শুধু তাই নয়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে আয়োজিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া, সংক্ষেপে নীতি আয়োগ গঠনের বৈঠকে গরহাজির ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ নীতি আয়োগ গঠন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থি বলে সমালোচনা করতেও ছাড়েনি তিনি৷ এমনকি সংসদের চলতি অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদসূচক প্রস্তাবের ওপর সংশোধনি আনতে তৃণমূলের চিরবৈরি সিপিএম-এর হাত ধরতেও কসুর করেনি তৃণমূল৷ কী এমন ঘটলো যাতে মমতার এই পরিবর্তন? রাজনৈতিক মহলে এই বৈঠক নিয়ে তাই আজ জল্পনার অন্ত নেই৷
হাসিনা-মনমোহন শেষ বৈঠকেও তিস্তা নিয়ে কিছু হয়নি!ছবি: AP
মমতা মুখে অবশ্য বললেন, রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি, উন্নয়ন এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মাথায় ঋণের বোঝা লাঘব করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করতেই এই বৈঠক৷ তিনি বলেন, গত ৩৪ বছরের পূর্বতন বাম জমানায় সুদে আসলে হিমালয় প্রমাণ ঋণ জমে গেছে রাজ্য সরকারের ঘাড়ে, যা শোধ করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার৷ তাই কেন্দ্রীয় সরকার যেন রাজ্য সরকারকে তা মেটানোর দায় থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেন৷ এ জন্য মোদীর সহযোগিতা চেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধায়৷ আর রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী৷
এরপরেও বিশ্লেষকরা এই বৈঠকের পেছনে রাজনৈতিক গন্ধ পাচ্ছেন৷ মমতা-মোদীর একে অপরের প্রতি অবস্থান বদলের নেপথ্য কারণ হিসেবে যেটা দেখা হচ্ছে, তা হলো সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি এবং কেন্দ্রীয় তদন্থ ব্যুরো সিবিআই তদন্তে রাজ্যের শাসকদলের মন্ত্রী থেকে হোমড়া-চোমড়ারা যেভাবে ফেঁসে যাচ্ছেন, তাতে শেষ পর্যন্ত এই জল কোথায় গড়ায় – তা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রয়েছেন ঘোর অস্বস্তিতে৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো তৃণমূলের একদা স্তম্ভ মুকুল রায় সিবিআই জেরার মুখে রাজসাক্ষী হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন কিনা – তা নিয়েও শঙ্কার শেষ নেই৷ জেরার পর মুকুল রায়ের শরীরী ভাষাকে সেভাবেই অনেকে ব্যাখ্যা করেছেন৷ এখন মুকুল রায় মমতার চক্ষুশূল৷ তাহলে এ পরিস্থিতির সামাল দিতেই কি মমতা মোদীর সহযোগিতা চান? প্রশ্নটা কোটি টাকার৷ মুকুল রায়ের ডানা ছাঁটা চলছে৷ তাই ভবিষ্যতে মুকুল রায়কে যাতে বিজেপি প্রশ্রয় না দেয়, সেই পথ বন্ধ করতে মমতা তাঁর চেষ্টার কার্পণ্য একেবারেই করছেন না, ধারণা এমনটাই৷
অন্যদিকে মোদীরও দরকার মমতাকে৷ বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা ও সদিচ্ছা বাড়াতে মোদী চান ঢাকার সঙ্গে যে দুটি বিষয় এখনো ঝুলে আছে, তার গ্রহণযোগ্য সমাধান করতে৷ এ দুটি বিষয় হলো স্থলসীমা চুক্তি এবং তিস্তার জল বা পানি বণ্টন চুক্তির জট ছাড়ানো৷ বলা বাহুল্য, এই দুটি চুক্তির বাস্তবায়নে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সমর্থন জরুরি৷ কারণ সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় মোদী সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও, উচ্চকক্ষ রাজ্যসভাতে বিজেপির নেই৷ সেক্ষেত্রে মমতার তৃণমূলের সমর্থন দরকার৷
উল্লেখ্য, শীঘ্রই বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী৷ তার আগে সংসদের শিলমোহর নিয়ে ঢাকাকে মোদী সরকারের দেয়া বড় উপহার হবে ঐ দুটি চুক্তির বাস্তবায়ন৷ এছাড়া জমি অধিগ্রহণ বিলের মতো অন্যান্য বিল পাশ করাতেও তৃণমূলকে পাশে পেতে চান তিনি৷ এক কথায় রাজনীতির সেই ‘গিভ অ্যান্ড টেক পলিসিটা' এবার নিয়েছেন মোদী, যেটা কখনোই একতরফা হয় না৷