অবশেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাহলে স্বীকার করলেন যে, মোদীর বিজেপি সরকার সম্পর্কে ভারতীয় মুসলিম সমাজে একটা ভীতির মানসিকতা কাজ করছে৷ সেই কারণেই গত ২৬শে জুন সর্বভারতীয় ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের দিল্লি শাখার সভাপতি সিরাজুদ্দিন কুরেশির সঙ্গে বৈঠকে মোদী তাঁদের ‘ভয়ের রাজনীতি' থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেন৷ বৈঠকের পর প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সেকথাই উঠে এসেছে৷
পরে কুরেশি সংবাদমাধ্যমের কাছে এর বিশদ ব্যাখ্যা দেন, যার সারমর্ম হলো কোনো সন্ত্রাস মামলায় মুসলিম যুবকদেরই কেন জড়ানো হয় এবং তাঁরা এবং তাঁদের পরিবারকে হয়রানির শিকার হতে হয় কেন? এই অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী খতিয়ে দেখার জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে এক কমিটি গঠনের কথা বলেন৷ এর অন্তর্নিহিত অর্থ এই যে, সব সন্ত্রাসে ভারতীয় মুসলিমদের যেমন সন্দেহ করা হয়, তেমনি এ কথাও সত্য যে তাঁরা সবসময় সন্দেহের বাইরে থাকে না৷ ভারতীয় মুসলিমদের একাংশের ভোট বিজেপিকে দেয়ায় মোদী তার প্রশংসা করেছেন৷ তবে মোদী মনে করেন না ভারতীয় মুসলিমদের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতার নিরিখে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, অন্ততপক্ষে সরকারি সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে৷ এর পরেও অবশ্য সাচার কমিটির রিপোর্টে সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলিমদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেবার সুপারিশ করা হয়৷ ভারতের নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোদী মনে করেন, ভারতীয় মুসলিমদের শিক্ষা শুধু মাদ্রাসা-কেন্দ্রিক না হয়ে আধুনিক শিক্ষাকেও গ্রহণ করা উচিত৷
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd ভারতের মুসলিম সমাজের মানসিকতায় বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের মতাদর্শ সম্পর্কে ভীতি জন্মানোর জন্য দায়ী কে বা কারা? প্রথমেই আঙুল ওঠে অ-বিজেপি রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি৷ তারা ভোটব্যাংকের জন্য বিজেপি সম্পর্কে মুসলিমদের মন বিষিয়ে তোলে৷ দ্বিতীয়ত, মোদীর কথাবার্তা বা হাবভাব সর্বদাই মুসলিম-বিরোধী৷ এইভাবে মোদী সরকারের প্রতি একটা ভীতি বদ্ধমূল হয়ে ওঠে মুসলিম সমাজে, যার পরিণামে হয়েছে ভয়ংকর৷ সাম্প্রদায়িক হিংসা ছাড়ানোর অভিযোগে বহু কমিশন বসে সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে৷ স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৬১ সালে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে প্রথম বড় ধরণের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে৷ সাম্প্রতিককালে ৯০-এর দশকে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবানির রথযাত্রা, অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙা এবং ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গা৷
মোদী সরকারের ৩০ দিনের শাসনে সংখ্যালঘু মুসলিমদের মন থেকে কি শঙ্কা দূর হয়েছে? ফিরে এসেছে কি তাঁদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ? না আসেনি৷ বিশ্লেষকদের মতে, আদতে তার বিপরীতটাই হয়েছে৷ বিশাল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে বিজেপি ক্ষমতা আসায় তাঁদের মনে আরো বেশি ভয় ঢুকেছে৷ তবে এ কথা সত্য যে, এই ৩০ দিনে বড় কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেনি৷ ভারতের হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রে ২০১৪ সালেই বিধানসভা ভোট৷ বিজেপি ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের বিভেদকামী লাইনেই দলীয় কর্মকৌশল স্থির করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ সাধারণ নির্বাচনের সময় মুজফ্ফরনগরে জাট-মুসলিম দাঙ্গার পর মোদীর সেখানে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তিনি সেখানে যাননি৷ বরং যাঁদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা ঘটানোর অভিযোগ ছিল তাঁদের সম্বর্ধনা সভাতেও উপস্থিত ছিলেন নরেন্দ্র মোদী৷