লিন্ডা নামের যে স্কুলের মেয়েটি জার্মানি থেকে পালিয়ে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, সে তার প্রথম সাক্ষাৎকারে বলেছে, সে শুধু বাড়ি ফিরতে চায়৷
বিজ্ঞাপন
লিন্ডার বয়স আজ ১৬৷ এক বছর আগে সে ড্রেসডেনের কাছে একটি শহরে তার বাড়ি থেকে পালিয়ে ইরাকে যায় ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যোগ দিতে৷ রবিবারে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে লিন্ডা তার ঐ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অনুশোচনা প্রকাশ করেছে৷
লিন্ডাকে আপাতত বাগদাদের কাছে একটি সামরিক হাসপাতালে রাখা হয়েছে কেননা সে জনতার রোষের শিকার হতে পারে, এমন আশঙ্কা ছিল৷ জার্মানির স্যুডডয়চে সাইটুং পত্রিকা ও এনডিআর এবং ডাব্লিউডিআর টেলিভিশন সংস্থার হয়ে একজন ইরাকি রিপোর্টার লিন্ডার সঙ্গে কথা বলেন৷
Civilians struggle to survive after Mosul has been freed
01:24
‘‘আমি শুধু এখান থেকে চলে যেতে চাই'', লিন্ডা ডাব্লিউ. তার সাক্ষাৎকারে বলেছে: ‘‘আমি যুদ্ধ থেকে চলে যেতে চাই, এত সব অস্ত্রশস্ত্র থেকে, এই আওয়াজ থেকে৷''
লিন্ডা রিপোর্টারদের বলে যে, তুরস্ক ও সিরিয়া হয়ে ইরাক পৌঁছতে তার এক মাস সময় লেগেছিল৷ সে গিয়েছিল একজন আইএস যোদ্ধাকে বিয়ে করতে৷ সে মোসুলে যেতে চায়নি, কিন্তু তাকে জোর করে সেখানে পাঠানো হয় ও এর কিছু পরেই তার স্বামী যুদ্ধে প্রাণ হারায়৷
লিন্ডা বলে, সে টাইগ্রিস নদীর কাছে একটি ভূগর্ভস্থ ভাঁড়ারে লুকিয়ে ছিল, যেখানে ইরাকি সৈন্যরা তাকে খুঁজে পায় ও সংখ্যালঘু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের সদস্য বলে ধরে নেয় – কেননা আইএস সদস্যরা প্রায়ই ইয়াজিদি মহিলাদের যৌন ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করত৷ তাকে ইয়াজিদি হিসেবে গণ্য করায় লিন্ডা দৃশ্যত রুষ্ট হয়ে বলে, ‘‘আমি জার্মান৷''
সহযোগিতা করতে রাজি
সাক্ষাৎকারের সময় অবধি লিন্ডাকে জেরা করা হয়নি, তবে সে ইরাকি রিপোর্টারটিকে বলে যে, সে তদন্তকারীদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত৷ একজন ইরাকি বিচারক প্রথমে লিন্ডার ডাক্তারি চিকিৎসার নির্দেশ দেন৷
অত্যাচারিত ইয়াজিদি নারীদের জন্য নতুন আশা
ইরাকে গড়ে তোলা হয়েছে তখাকথিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর নির্যাতনের শিকার ইয়াজিদি নারীদের জন্য নতুন সাইকোলজিক্যাল ট্রমা সেন্টার৷ সে অঞ্চলে এমন চিকিৎসাকেন্দ্র এটাই প্রথম৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
এক নির্যাতিতা
ছবির এই ইয়াজিদি নারীর নাম পেরভিন আলি বাকু৷ ২৩ বছর বয়সি পেরভিনকে তাঁর তিন বছরের মেয়েসহ ধরে নিয়ে গিয়েছিল আইএস৷ দু’বছরেরও বেশি সময় অকথ্য নির্যাতন সইতে হয়েছে তাঁকে৷ এখন তিনি ইরাকের এক শরণার্থী শিবিরে৷ আইএস-এর কবল থেকে মুক্ত৷ তবু আতঙ্ক কাটেনি৷ এখনো কেউ একটু জোরে কথা বললেই মনে হয় এই বুঝি বর্বর লোকগুলো এলো, এই বুঝি আবার শুরু হলো অত্যাচার-নির্যাতন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
যে কারণে স্বস্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ইরাকি সেনাবাহিনীর আক্রমনে আইএস অনেকটাই দিশাহারা৷ পিছু হঠতে বাধ্য হচ্ছে তারা৷ তাদের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে অনেক ইয়াজিদি নারী৷ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে জার্মানির বাডেন ভ্যুরটেমব্যার্গ রাজ্য৷ রাজ্যটি ইতিমধ্যে আইএস-এর কবল থেকে মুক্ত ১১শ ইয়াজিদি নারীকে জার্মানিতে নিয়ে এসেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
শরণার্থী শিবিরে বাড়ছে ইয়াজিদি নারী
আইএস-এর কাছ থেকে মু্ক্ত হয়ে প্রায় নিয়মিতই ইয়াজিদি নারীরা আসছেন শরণার্থী শিবিরে৷ জার্মানিতে অবস্থানরত ইয়াজিদিদের উদ্যোগে অত্যাচারের শিকার ওই নারীদের কেউ কেউ আবার আশ্রয় পাচ্ছেন জার্মানিতে৷ জার্মানিতে প্রায় এক লক্ষ ইয়াজিদির বসবাস৷ তাদের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে ইয়াজিদি নারীদের নিয়ে আসার জন্য ইতিমধ্যে ৯ কোটি ৫০ লক্ষ ইউরোর বাজেট অনুমোদন করেছে বাডেন ভ্যুরটেমব্যার্গ রাজ্যের সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
তাঁদের কোনো চিকিৎসা নেই
মোসুলে আইএস কোণঠাসা হয়ে পড়ায় প্রতিদিনই সেখান থেকে ইয়াজিদিরা ইরাকের কুর্দি অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চলে আসছেন৷ মোসুল থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের এই শরণার্থী শিবিরে তেমন কোনো চিকিৎসা সুবিধা নেই৷ অত্যাচারের ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে ফেরা নারীদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসারও ভালো ব্যবস্থা নেই৷ ৫৫ লাখ কুর্দির এই অঞ্চলে আছে মাত্র ২৬ জন মনরোগ চিকিৎসক৷ কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই ইয়াজিদি নারীদের চিকিৎসা করছেন তাঁরা৷
অবশেষে আশার আলো
বয়স যখন মাত্র ছয়, তখনই ইরাক ছেড়ে জার্মানিবাসী হয়েছিলেন ইয়াজিদি ট্রমা স্পেশালিস্ট ইয়ান কিজিলহান৷ ইরাকের ডোহুকে সাইকোলজিক্যাল ট্রমা সেন্টার গড়ে তোলায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
প্রশিক্ষণের সুযোগ
ভ্যুরটেমব্যার্গ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে আগামী তিন বছরে ইরাকের ৩০ জন সাইকোথেরাপিস্টকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে৷ আগামী দশ বছরে অন্তত হাজারখানেক প্রশিক্ষিত সাইকোথেরাপিস্ট তৈরির উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ধীরে ধীরে উন্তত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
পাশে দাঁড়ানোটা দায়িত্ব
এ পর্যন্ত কয়েক হাজার ইয়াজিদি নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন কিজিলহান৷ তাঁদের কাছ থেকে জেনেছেন নির্যাতনের ভয়ংকর সব কাহিনি৷ জার্মানিতে স্থায়ীভাবে বসবাসরত ট্রমা স্পেশালিস্ট ইয়ান কিজিলহান জানালেন, তাঁর কাছে অসহায় ওই নারীদের সহায়তা করা এখন অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Martins
7 ছবি1 | 7
লিন্ডা জানায় যে, সে ভালোই আছে, যদিও তার বাঁ উরুতে গোলার টুকরো লেগে একটি ক্ষত আছে ও ডান হাঁটুতে একটা চোট আছে৷ ‘‘একটা হেলিকপ্টার আক্রমণ থেকে ওটা হয়'', বলে লিন্ডা রিপোর্টারকে জানায়৷
সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারটি একজন সৈনিক, জনৈক মার্কিন প্যারামেডিক ও তদন্তকারী কৌঁসুলির উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়৷ দৃশ্যত লিন্ডাকে প্রথমে একটি সাধারণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেন যে, তারা লিন্ডার নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারবেন না, কেননা আইএস-এর শিকার হয়েছে, এমন অনেকের ঐ হাসপাতালেই চিকিৎসা চলেছে৷
আরেক জার্মান ‘আইএস পত্নী' ফতিমাকেও আহত অবস্থায় ঐ হাসপাতালে রাখা হয়েছে৷ ফতিমা ১৫ বছর বয়সে চেচনিয়া থেকে অস্ট্রিয়ায় পালায় ও মোগামেদ নামের এক জার্মান নাগরিককে বিবাহ করে৷ পরে উভয়ে তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে আইএস-এ যোগদান করে ও মোসুল যাত্রা করে৷ ফতিমা ইরাকি রিপোর্টারটিকে বলে যে, তার স্বামী বেশ কয়েক মাস আগেই নিহত হয়েছে ও মিত্রজোটের একটি বিমান আক্রমণের পর তার সন্তানদেরও কোনো খোঁজখবর নেই৷
লিন্ডার ভবিষ্যৎ
লিন্ডার বোন মিরিয়াম রিপোর্টারদের বলেছেন, লিন্ডা যে বেঁচে আছে, তাতেই তিনি সুখি৷ শনিবার জার্মান সরকারি কৌঁসুলি লোরেনৎস হাজে নিশ্চিত করেন যে, লিন্ডাকে ইরাকে খুঁজে পাওয়া গেছে ও বাগদাদের জার্মান কনস্যুলেটের তরফ থেকে তাকে সাহায্য করে হচ্ছে৷
লোরেনৎস বলেন, লিন্ডার ইরাকে বিচার হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে, যেক্ষেত্রে তাকে সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হতে পারে৷ অথবা বিদেশি হিসেবে লিন্ডাকে ইরাক থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে৷
যুদ্ধে নারী, নারী যোদ্ধা
২০১৪ সালের গ্রীষ্মে ইসলামিক স্টেট উত্তর ইরাকের ইয়াজিদি এলাকাগুলি দখল করে৷ হাজার হাজার ইয়াজিদি মহিলা ও কিশোরীকে ধরে নিয়ে গিয়ে দাসী হিসেবে রাখা হয় ও ধর্ষণ করা হয়৷ আজ সেই ইয়াজিদি নারীরাই সন্ত্রাসবাদিদের বিরুদ্ধে লড়ছেন৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
শত্রুর খোঁজ
শত্রু বাইরে কোথাও - কুর্দি নারী যোদ্ধা হাসেবা নৌজাদ ইরাকের মোসুল শহরের কাছে চোখে দুরবিন লাগিয়ে ‘ফ্রন্ট লাইন’ পরখ করে দেখছেন৷ কুর্দ এলাকা ও আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যে সীমারেখা হলো এই ফ্রন্ট৷ কুর্দিরা ইরাকি সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় ক্রমেই আরো এগিয়ে যাচ্ছে, পিছু হটছে ইসলামিক স্টেট৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
গুপ্তপ্রতিরোধের ভ্যানগার্ড
শত্রু নজরে পড়েছে, এবার তাদের দিকে গুলি চালানো হবে৷ হাসেবা নৌজাদ দেখাচ্ছেন কোনদিকে; আসেমা দাহির (ডান দিক থেকে তৃতীয়) ও অন্যান্য ইয়াজিদি নারী যোদ্ধারা নিশানা ঠিক করছেন৷ শুধুমাত্র বিমান থেকে আইএস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লাভ নেই৷ তাই ইয়াজিদি আর কুর্দ মহিলাদের নিয়ে রণক্ষেত্রে এই ভ্যানগার্ড তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
সুন্দর দেখানোর জন্য নয়
বন্দুক নিয়ে ঠিকমতো নিশানা করার জন্য মাথার চুল কপালে বা চোখে পড়লে চলবে না৷ তাই চুল টান টান করে বেঁধে নেন হাসেবা নৌজাদ, ‘মিলিটারি লুক’ ফ্যাশনের জন্য নয়৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
লাকি চার্ম
যুদ্ধের ফাঁকে আসেমা দাহির৷ হাতে যে লাল রঙের টেডি বেয়ারটি রয়েছে, সেটা হয়তো অতীতের সেই সুন্দর, শান্তিপূর্ণ দিনগুলির প্রতীক, যখন আইএস ইয়াজিদিদের স্বদেশকে দখল করেনি৷ ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে সেই শান্তি শেষ হয়ে যায়, শুরু হয় আইএস-এর সন্ত্রাস৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
পালানো ছাড়া পথ ছিল না
শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, আইএস কাউকে ক্ষমা করেনি৷ ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে লক্ষ লক্ষ ইয়াজিদি বাস্তু ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন, তাদের পিছনে আইএস৷ এক বৃদ্ধ ও দুই তরুণীর এই ছবিটি যেন বিশ্বের সামনে ইয়াজিদিদের যন্ত্রণাকে তুলে ধরে৷
ছবি: Reuters
বিভীষিকা
এই ইয়াজিদি কিশোরী ক্যামেরার সামনে তার মুখ দেখাতে চায় না৷ ২০১৪ সালে এই ১৫ বছর বয়সের মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে একজন আইএস যোদ্ধার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ তার দু’মাস পরে মেয়েটি পালাতে সমর্থ হয়৷ আজ সে আবার নিজের পরিবারের সঙ্গেই বাস করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Bennett
ধ্বংসস্তূপ
উত্তর সিরিয়ার কোবানি শহরটি তুর্কি সীমান্তের অদূরে৷ আইএস যোদ্ধারা মাসের পর মাস শহরটি অবরুদ্ধ করে রেখেছিল৷ কুর্দিরা সব কিছুর পরও প্রতিরোধ চালিয়ে যায় ও শেষমেশ মার্কিন বিমানবাহিনীর সাহায্যে সন্ত্রাসবাদীদের পরাজিত করতে সমর্থ হয়৷ পড়ে থাকে একটি শহর নয়, যেন শহরের ধ্বংসস্তূপ৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Akgul
সবে মিলে করি কাজ
যারা আইএস-এর আদর্শে বিশ্বাস করে না, আইএস-এর দৃষ্টিতে তারা সবাই শত্রু৷ বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করাই হলো আইএস-এর উদ্দেশ্য৷ সে উদ্দেশ্য সর্বক্ষেত্রে সফল হয় না৷ কুর্দি আর ইয়াজিদি মেয়েদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, এক অর্থে তা আইএস-এর প্রতীকী পরাজয়৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
স্বাধীনতার সড়ক
শুধু অস্ত্র দিয়ে আইএস-কে হারানো যাবে না৷ সিরিয়া আর ইরাকের অনেক এলাকা এখনও আইএস-এর নিয়ন্ত্রণে৷ কুর্দি আর ইয়াজিদি মেয়েরাও তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে৷ তাদের প্রতিরোধের আর একটি শিক্ষা হলো, মেয়েরা পুরুষের দাস নয় - সন্ত্রাসবাদিদের যা কাজে লাগার কথা!