মোসুল পুনর্দখলের জন্য ইরাকি সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা৷ কিন্তু মানবিক সংকট শেষ হতে এখনও অনেক বাকি, বলছে জাতিসংঘ৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার ইরাকি প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদি সরকারিভাবে ঘোষণা করেন যে, মোসুলে ইসলামিক স্টেট যোদ্ধাদের পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে৷ আল-আবাদি রবিবারেই মোসুলে যান, তবে আইএস-এর বিরুদ্ধে জয় নিশ্চিত না হওয়া অবধি তিনি সম্ভবত সে কথা ঘোষণা করতে চাননি৷ বাগদাদ সরকারের তরফ থেকে অতীতে একাধিকবার বলা হয়েছে যে, মোসুলের পতন আসন্ন, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি৷ কাজেই আল-আবাদির সতর্কতা বোধগম্য৷
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর মোসুলের পতনকে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি ‘‘গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক'' বলে অভিহিত করেছেন৷ যুক্তরাষ্ট্র ও তার জোট সহযোগীরা মোসুলের বিভিন্ন এলাকায় স্থিতি আনার জন্য জাতিসংঘের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে, বলে টিলারসন জানান৷
ইরাকি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে আল-আবাদি ‘‘দায়েশ-এর মোসুল থেকে ঘোষিত মিথ্যা ও সন্ত্রাসের রাজ্যের ব্যর্থতা ও পতন''-এর কথা বলেন৷ তবে মোসুলে স্থিতি আনার এবং ছোট ছোট আইএস সেলগুলিকে নির্মূল করার কাজ এখনও বাকি আছে, বলে আল-আবাদি মন্তব্য করেন৷ ইরাকের সরকারি সেনা, কুর্দ পেশমার্গা যোদ্ধা এবং বিভিন্ন শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী মিলে মোসুল পুনর্দখল করে – বিমান থেকে ও ভূপৃষ্টে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য প্রদান করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রজোট৷
মানবিক সংকট
ইরাকে জাতিসংঘের মানবিক সাহায্য সমন্বয়ের দায়িত্বে আছেন লিজে গ্রান্দে; তাঁর মতে, যুদ্ধ শেষ হলেও, মানবিক সংকট শেষ হয়নি৷ ‘‘বহু মানুষ, যারা পালিয়েছেন, তারা সব কিছু হারিয়েছেন'', বলেন গ্রান্দে; ‘‘তাদের আশ্রয়, খাদ্য, স্বাস্থ্য সেবা, স্যানিটেশান ও এমার্জেন্সি কিট-এর প্রয়োজন৷'' মোসুলের বাসিন্দাদের ট্রমা বা বিভীষণ অভিজ্ঞতা অন্য যে কোনো জায়গাকে ছাড়িয়ে যায়, বলে গ্রান্দে মন্তব্য করেন: ‘‘মানুষজন যা অভিজ্ঞতা করেছেন, তা অকল্পনীয়৷''
যুদ্ধে মোসুল শহর এমনভাবে ধ্বংস হয়েছে যে, পলাতক বাসিন্দাদের শীঘ্র সেখানে ফিরতে পারার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ মোসুলের প্রাচীন অংশে ৬৫ ভাগ বাড়িঘর গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বলে জানিয়েছেন ইরাকি সরকার – শহরের পশ্চিমাঞ্চলে জঞ্জিলির মতো এলাকাগুলিতে ধ্বংসের পরিমাণ আরো বেশি৷
অ্যামনেস্টির অভিযোগ
মোসুলের যুদ্ধে সব পক্ষই আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে, বলে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর অভিযোগ৷
আইএস গোষ্ঠী হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে ও তাদের মোসুল পরিত্যাগ করতে দেয়নি৷ শত শত, এমনকি হাজার হাজার বেসামরিক ব্যক্তিকে পালানোর সময় অথবা পালানোর অভিযোগে হত্যা করেছে আইএস – বলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ৷
দাড়ি-গোঁফ কেটে পালাচ্ছে আইএস
ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর দখল থেকে মসুল মুক্ত হয়েছে আগেই৷ এখন চলছে তাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার অভিযান৷ তবে এখন দাড়ি-গোঁফ কেটে মানুষের সাথে মিশে পালাচ্ছে তারা৷ ফলে সাধারণ মানুষকেও পড়তে হচ্ছে ইরাকি বাহিনীর সন্দেহে৷
ছবি: Reuters/E. De Castro
মোসুল ঘেরাও
প্রতিদিনই মুক্ত হচ্ছে মোসুলের নতুন নতুন এলাকা৷ মুক্ত হচ্ছেন শহরটিতে দীর্ঘদিন আটকে থাকা সাধারণ ইরাকিরাও৷ কমান্ডাররা বলছেন, এখন হাতে গোনা দু-তিনশ’ আইএস জঙ্গি বিভিন্ন গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিয়ে আছে৷ তারা যাতে পার্শ্ববর্তী সিরিয়ায় পালিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য শহর ঘেরাও করা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/A. Al-Marjani
জঙ্গি খুঁজতে ড্রোন
আগের মতো আইএসে প্রকাশ্য কোনো আস্তানা মসুলে আর নেই৷ আজ এ বাড়িতে তো কাল ঐ ভবনে, এমন করেই যুদ্ধ চালাচ্ছে অবশিষ্ট জঙ্গিরা৷ ফলে নির্দিষ্ট করে হামলা চালানো বেশ কষ্টকরই হচ্ছে ইরাকি বাহিনীর জন্য৷ এই কাজ সহজ করতে নেয়া হচ্ছে প্রযুক্তির ব্যবহার৷ ড্রোন ব্যবহার করে চিহ্নিত করা হচ্ছে জঙ্গিদের অবস্থান৷ তারপর আক্রমণ৷
ছবি: Reuters/E. De Castro
কারা জঙ্গি?
চারপাশ থেকে ঘেরাও হওয়ায় প্রাণে বাঁচতে আইএস জঙ্গিরাও আশ্রয় নিচ্ছে নতুন কৌশলের৷ ইসলামি কায়দা অনুযায়ী দাড়ি-গোঁফ রাখলেও, এখন সবাই ‘ক্লিন শেভড’৷ যতক্ষণ পারছে যুদ্ধ, হেরে যাওয়ার শঙ্কা দেখলে পোশাক পালটে সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে যাচ্ছে জঙ্গিরা৷
ছবি: Reuters/A. Saad
নতুন বিপদ আত্মঘাতি নারী
অগ্রসর হতে থাকা ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে টিকতে না পেরে আরেক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে আইএস জঙ্গিরা৷ নারী জঙ্গিরা বোমা বেঁধে সাধারণ নারীদের সাথে মিশে যাচ্ছে৷ চেষ্টা চালাচ্ছে ইরাকি বাহিনীর কাছাকাছি গিয়ে হামলা চালানোর৷ গেল এক সপ্তাহে এমন বেশকটি হামলায় হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে৷
ছবি: Reuters/Stringer
সাধারণের বিপদ
দীর্ঘদিন আইএসের নির্যাতনে জরাজীর্ণ অবস্থা, তা থেকে মুক্তির পরও কমছে না সাধারণ মানুষের ঝামেলা৷ সেই কারণটাও আইএস৷ লুকিয়ে থাকা জঙ্গি খুঁজতে গিয়ে সবাইকেই সন্দেহের তালিকায় রাখছে ইরাকি বাহিনী৷ না থেমে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হচ্ছে তাদের৷ একাধিকবার খতিয়ে দেখা হচ্ছে পরিচয়৷ মাঝে মধ্যেই করা হচ্ছে শরীর তল্লাশি৷ রেহাই পাচ্ছেন না শিশু-বুড়োরাও৷
ছবি: Reuters/A. Al-Marjani
শিশুদের জন্য সহায়তা
দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি অধ্যুষিত এলাকায় পৌঁছায়নি কোনো ত্রাণ৷ জরুরি ওষুধ তো দূরের কথা, একেবারেই সাধারণ ঠান্ডার ওষুধও মসুলবাসীর কাছে ছিলো আকাশের চাঁদ৷ তবে দ্রুতই পালটাচ্ছে এই অবস্থা৷ মুক্ত অঞ্চল এবং জঙ্গি এলাকা থেকে পালিয়ে আসা শিশুরা পাচ্ছে বিভিন্ন রোগের টিকা৷ সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থা থেকে মিলছে জরুরি ত্রাণও৷
ছবি: Reuters/A. Al-Marjani
6 ছবি1 | 6
অপরদিকে ইরাকের সরকারি সেনাবাহিনী ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট মোসুলে যুদ্ধাপরাধ করে থাকতে পারে – বলেছে অ্যামনেস্টি এবং এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিশন দাবি করেছে৷ অ্যামনেস্টি স্বীকার করেছে যে, আইএস-এর রণকৌশল সরকারপক্ষের সৈন্যদের পক্ষে ‘‘বিশেষ চ্যালেঞ্জ'' সৃষ্টি করে৷ ‘‘ইরাকি সরকার ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট এই চ্যালেঞ্জ অনুযায়ী তাদের রণকৌশল সঠিকভাবে বদলে নিতে পারেনি'' – বেসামরিক জনগণের পক্ষে যার ফল হয়েছে মারাত্মক –এই হলো অ্যামনেস্টির রায়৷ এই প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টি সরকারপক্ষের সেনাবাহিনীর ‘ইমপ্রোভাইজড রকেট অ্যাসিস্টেড মিউনিশনস'-এর কথা বলেছে, যা কোনো লক্ষ্যবস্তুর উপর নির্ভুলভাবে নিশানা করা সম্ভব নয়৷
মোসুলের যুদ্ধে কতোজন বেসামরিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও, এয়ারওয়ার্স নামের একটি মনিটরিং গ্রুপ গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস অবধি ইরাকের সরকারি সৈন্য ও মিত্রজোটের আক্রমণে ৩,৭০৬ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হবার কথা বলেছে৷ অ্যামনেস্টির মতে বাস্তবিক সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে৷
এসি/ডিজি (রয়টার্স, এপি, এএফপি, ডিপিএ)
কোণঠাসা হলেও ফুরিয়ে যায়নি আইএস
তথাকথিত ইসলামিক স্টেট সিরিয়া ও ইরাকে তাদের মূল ক্ষমতাকেন্দ্রে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে৷ তবে মিশর, লিবিয়া, আফগানিস্তানের মতো দেশেও তাদের প্রভাব কম নয়৷ ইউরোপে আইএস ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ব্যক্তিদের কার্যকলাপের ঝুঁকিও বাড়ছে৷
ছবি: Reuters/Rodi Said
সিরিয়া ও ইরাকে জমি হাতছাড়া
রাকা শহরকে কেন্দ্র করে বিশাল খিলাফত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল আইএস৷ সিরিয়া ও ইরাকের বিস্তীর্ণ অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছিল৷ মার্কিন নেতৃত্বে কোয়ালিশন বাহিনীসহ একাধিক শত্রুর চাপে তারা অনেক এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে৷
ছবি: Reuters
আর্থিক সংকট
‘খিলাফত’ স্থাপন করতে অর্থের প্রয়োজন৷ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের মতোই এলাকা দখল করে কর বাবদ টাকা তুলে, সেখানকার প্রাকৃতিক ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে এসেছে আইএস৷ তাদের যোদ্ধা ও কর্মীদের বেতন-ভাতাও এসেছে সেখান থেকে৷ বর্তমানে জমি হারিয়ে চরম অর্থাভাবে ভুগছে আইএস৷
ছবি: Reuters/Rodi Said
লিবিয়ায় আবার মাথাচাড়া দেবার প্রচেষ্টা
যেখানেই অরাজকতা, সেখানেই সুযোগ খোঁজার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে আইএস৷ সিরিয়া ও ইরাকে ধাক্কা খেয়ে লিবিয়ায় আবার উপস্থিতি বাড়াতে চাইছে তারা৷ সে দেশের একনায়ক গাদ্দাফির বিরুদ্ধে সংগ্রামের পর অনেক চরম ইসলামপন্থি গোষ্ঠী আইএস-এর ছত্রছায়ায় চলে আসে৷ প্রাথমিক সাফল্যের পর সেখানেও জমি হারায় তারা৷ এবার নতুন করে উপস্থিতি বাড়াতে চাইছে আইএস৷
ছবি: Reuters/I. Zitouny
ইয়েমেনে কঠিন লড়াই
অরাজকতার সুযোগ নিয়ে ইয়েমেনেও পা রাখতে চেয়েছিল আইএস৷ কিন্তু সেখানে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কম নয়৷ আল-কায়েদা ও শিয়া বিদ্রোহীদের দৌরাত্ম্যের মাঝে জায়গা করে নিতে আইএস-কে বেগ পেতে হয়েছে৷ শিয়া-সুন্নি সংঘাতের বৃহত্তর কালো ছায়া তাদের অ্যাজেন্ডা অনেকটা দাবিয়ে রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y.Arhab
মিশরে উপস্থিতি
মিশরের সিনাই উপদ্বীপে আইএস ঘাঁটি গেড়েছে৷ খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে তারা মিশরের প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলছে৷ দু’টি গির্জার উপর সাম্প্রতিক হামলার পর সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে৷
ছবি: Reuters/A. Aboulenein
আফগানিস্তানে তালেবানকে চ্যালেঞ্জ
দুর্বল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে এতকাল আফগানিস্তানে চরমপন্থি সন্ত্রাস চালিয়ে এসেছে তালিবান৷ তাদের শক্তিক্ষয়ের ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তার অনেকটাই দখল করতে এগিয়ে এসেছে আইএস৷ জেহাদি ভাবধারার সওদাগর হিসেবে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চাইছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/TTP
অনুপ্রেরণার উৎস
সরাসরি এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ পরিচালনা ছাড়াও ভাবাদর্শ ও জেহাদি রপ্তানির কাজেও সাফল্য দেখিয়েছে আইএস৷ কোনো দেশে সন্ত্রাসী হামলার ডাক দিয়ে এমনকি অচেনা মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করে লক্ষ্য হাসিল করেছে এই গোষ্ঠী৷ নিস, প্যারিস, বার্লিন, লন্ডন, স্টকহোম-এর মতো শহরে হামলার ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গেছে৷
ছবি: picture alliance/ZUMAPRESS.com
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বনাম আইএস
পূর্বসূরি বারাক ওবামা-র কড়া সমালোচনা করে ডোনাল্ড ট্রাম্প আইএস-কে নির্মূল করার ব্রত নিয়েছেন৷ ক্ষমতায় আসার পর ইয়েমেন ও আফগানিস্তানে সরাসরি আইএস-এর বিরুদ্ধে সামরিক হামলার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি৷ তবে এক্ষেত্রে কোনো সার্বিক নীতি এখনো স্পষ্ট নয়৷