বার্লিনের টিকা সম্মেলনে বক্তারা টিকাপ্রাপ্তদের মুক্তভাবে চলাফেরার অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে অনেক কথা বলেছেন৷ ডয়চে ভেলের লিজা হ্যানেল মনে করেন চলাফেরার স্বাধীনতা মৌলিক অধিকার, বিষয়টিকে বিশেষ সুবিধা মনে করার কিছু নেই৷
বিজ্ঞাপন
সোমবারের এ সম্মেলনের আগে থেকেই টিকার দুটি ডোজ পাওয়া ব্যক্তিদের ‘স্বাধীনতা' ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জোরালো হচ্ছিলো৷রবার্ট কখ ইন্সটিটিউটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত জার্মানির মোট জনসখ্যার শতকরা সাত ভাগের মতো মানুষ টিকার দুটো ডোজই পেয়েছেন৷ এই সাত ভাগের মাধ্যমে অন্য কারো সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি খুবই কম৷
জার্মানির এথিক্স কাউন্সিলও মনে করে, টিকার দুটো ডোজ পেয়ে যাওয়াদের এখন মুক্তভাবে চলাফেরার অধিকার ফিরিয়ে দেয়া যেতে পারে৷ তবে তাদের মতে, সেই অধিকার সবাই টিকা পাওয়ার পর ফিরিয়ে দিলেই ভালো হয়৷
অনেকে আবার এ-ও বলছেন যে, এখন কিছু মানুষকে মুক্তভাবে চলাচলের অধিকার ফিরিয়ে দেয়াটা তরুণ প্রজন্মের জন্য চপেটাঘাত হতে পারে৷ বয়স্কদের স্বার্থে তরুণদের অনেক দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে৷ এখন বয়স্করা টিকা পেয়েছেন বলে অবাধে চলাফেরা করতে পারবেন, অথচ তরুণদের বিধিনিষেধ মেনে যেতে হবে- এমন অবস্থা তরুণদের মনে অসন্তোষের জন্ম দিতেই পারে৷
করোনার টিকা নেয়া বিশ্ব নেতারা
করোনা ভাইরাসের টিকা দেয়া হচ্ছে দেশে দেশে৷ বেশ কিছু দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীরাও ইতিমধ্যে টিকা নিয়েছেন৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Frank Augstein/AP Photo/picture alliance
জো বাইডেন
যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত ১২ কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে৷ তাদের মধ্যে সাত কোটি মানুষ টিকার দুটো ডোজই পেয়ে গেছেন৷ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন৷ গত জানুয়ারিতে বায়োনটেক-ফাইজারের টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় তাকে৷
ছবি: Tom Brenner/REUTERS
বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু
ইসরায়েলের ৯৩ লাখ মানুষের মধ্যে শতকরা ৫৩ ভাগকে বায়োনটেক ফাইজার টিকা দেয়া হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুও ইতিমধ্যে টিকা নিয়েছেন৷
ছবি: Amir Cohen/REUTERS
নরেন্দ্র মোদী
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে গত মার্চে কোভ্যাক্সিন টিকা দেয়া হয়েছে৷ ভারতে করোনা সংক্রমণ আবার খুব বাড়ছে৷ স্ংক্রমিতের সংখ্যার দিক থেকে দেশটি এখন বিশ্বের সব দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে৷
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা নিয়েছেন গত মাসে৷
ছবি: Frank Augstein/AP Photo/picture alliance
জঁ কাস্তেক্স
ফ্রান্সের জনগণকে টিকা নেয়ায় উদ্বুদ্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী জঁ কাস্তেক্সকে টিকা দেয়ার দৃশ্য টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়৷ কাস্তেক্সকেও মার্চ মাসে টিকা দেয়া হয়৷
ছবি: Thomas Coex/AP Photo/picture alliance
স্কট মরিসন
ছবিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের বায়োনটেক-ফাইজার টিকা নেয়ার দৃশ্য৷ অস্ট্রেলিয়া এ বছরের মধ্যে দেশের সব নাগরিককে টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল৷ পরে অবশ্য সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয় বলে জানানো হয়৷
ছবি: Murat Cetinmuhurdar/Presidential Press Office/REUTERS
জোকো উইদোদো
গত ২৭ জানুয়ারি চীনের সিনোভ্যাক টিকা নেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো৷ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় সেই দৃশ্য৷ এ বছরের মধ্যে দেশের ১৮ কোটি ১৫ লাখ নাগরিককে টিকা দেয়া শেষ করতে চায় ইন্দোনেশিয়া সরকার৷
জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলও টিকা নিয়েছেন৷ অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা দেয়া হয়েছে তাকে৷ তবে বিদায়ী চ্যান্সেলরকে টিকা দেয়ার ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করা হয়নি৷
করোনাকালে কোনো কষ্ট করতে হয়নি, নিয়মের বেড়াজালে জীবনকে একেবারেই বাঁধতে হয়নি- এমন একটা মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ যাদের কোনো সন্তান নেই, তারা দেখেছেন স্কুল খোলা রাখা হয়েছে, সেখান থেকে সংক্রমণও ছড়াচ্ছে৷ অন্যদিকে বাবা-মায়েরা শিশুসেবা নিশ্চিত হয়নি জেনেও চাকরিদাতাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘরে বসে কাজ করে গেছেন৷ যাদের একাকী জীবন, তারা কারো সাহচর্য পাবেন না জেনেও মেনে নিয়েছেন গৃহকোণের একাকিত্ব৷ তরুণরা আপাতত তাদের ভবিষ্যৎভাবনাকে শিকেয় তুলে রেখেছেন৷ গত একটা বছর প্রবীণদের নার্সিংহোমে নিয়মিত দেখতে যাওয়াও হয়ে ওঠেনি কারো৷
আসলে কারো জন্যই সময়টা সুন্দর ছিল না, তবে এমন সময়ের মুখোমুখি আমরা একসঙ্গেই হয়েছিলাম৷
রাশিয়ায় ট্রেনে চড়ে করোনার টিকা দেয়া
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবার আগে আরেকটি নজির গড়লো রাশিয়া৷ প্রথম করোনা টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়া দেশে এবার ট্রেনে চড়ে টিকা দেয়াও শুরু হলো৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Evgeny Kozyrev/REUTERS
শতবর্ষ সেবা দেয়া চিকিৎসককে শ্রদ্ধা
১০২ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাওয়ায় গিনেস বুকে নাম উঠেছিল রাশিয়ার চিকিৎসক ফিয়োডর উগ্লভের৷ তার নামে চালু করা অ্যাকাডেমিসিয়ান ফিয়োডর উগ্লভ মেডিকেল ট্রেনেই এখন চলছে করোনা ভ্যাকসিন দেয়া৷
ছবি: Evgeny Kozyrev/REUTERS
টিকা দিতে ট্রেনে উঠছেন স্বাস্থ্যকর্মী
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন তার দেশে স্পুটনিক ফাইভ টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়ার পর পশ্চিমের অনেক দেশই রাশিয়ার এ সাফল্য নিয়ে সংশয়ে ছিল৷ সংশয়ের মূল কারণ ছিল কার্যকারিতা পরীক্ষার আগেই টিকা দেয়া শুরু করা৷সেই টিকার কার্যকারিতা এখন প্রমাণিত৷ ইতিমধ্যে টিকা দেয়ার বিশেষ উদ্যোগ শুরু হয়েছে সে দেশে৷ টিকা দিতে অ্যাকাডেমিসিয়ান ফিয়োডর উগ্লভ মেডিকেল ট্রেনে উঠছেন এক স্বাস্থ্যকর্মী৷
ছবি: Evgeny Kozyrev/REUTERS
ট্রেনে টিকা দেয়ার অপেক্ষা
রাশিয়ার ইরকুৎস্ক অঞ্চলের তুলুঁ স্টেশনে থেমেছে ট্রেন৷ ভেতরে চলছে স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকা দেয়ার প্রস্তুতি আর যাত্রীদের টিকা নেয়ার অপেক্ষা৷
ছবি: Evgeny Kozyrev/REUTERS
ভিন্ন পরিবেশে টিকা দেয়া
অ্যাকাডেমিসিয়ান ফিয়োডর উগ্লভ মেডিকেল ট্রেনের কামরায় এক ব্যক্তিকে টিকা দিচ্ছেন এক স্বাস্থ্যকর্মী৷ টিকা দেয়া স্বাস্থ্যকর্মী এবং টিকা নেয়া ৷ দেখে মনে হয় ট্রেনটই যেন এক হেল্থ ক্লিনিক৷
ছবি: Evgeny Kozyrev/REUTERS
হাসপাতাল ট্রেনে...
‘পাতাল ট্রেন’ তো দেখা হয়েছে আগেই, এবার হাসপাতাল ট্রেনও দেখা হয়ে গেল রাশানদের৷অ্যাকাডেমিসিয়ান ফিয়োডর উগ্লভ মেডিকেল ট্রেনে স্পুটনিকের ডোজ নেয়া শেষে বাড়ি ফিরছেন দুই নারী৷
ছবি: Evgeny Kozyrev/REUTERS
স্বাস্থ্য পরীক্ষা
রাশিয়ার ইরকুৎস্ক অঞ্চলের তুলুঁ স্টেশনে অ্যাকাডেমিসিয়ান ফিয়োডর উগ্লভ মেডিকেল ট্রেনে টিকা দিতে এসেছেন এক জন৷ টিকা দেয়া শুরুর আগে চলছে তার স্বাস্থ্যপরীক্ষা৷
ছবি: Evgeny Kozyrev/REUTERS
টিকা যায় যেভাবে...
এভাবেই ব্যাগে করে স্পুটনিক ফাইভ টিকা নিয়ে ট্রেনে ওঠেন স্বাস্থ্যকর্মীরা৷
ছবি: Evgeny Kozyrev/REUTERS
ট্রেনের বাইরে অপেক্ষা
স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ট্রেনের ভেতরে গাদাগাদি করার প্রশ্নই ওঠে না৷ তাই টিকা দেয়ার জন্য ট্রেনের বাইরেই অপেক্ষা করছেন কয়েকজন৷
ছবি: Evgeny Kozyrev/REUTERS
রাশিয়ায় করোনা পরিস্থিতি
প্থম দেশ হিসেবে করোনা ভ্যাকসিন তৈরির ঘোষণা দিলেও করোনাকে এখনো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি রাশিয়া৷ সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুও বাড়ছে৷ সে দেশে এখন পর্যন্ত ৪৪ লাখ ১৮ হাজারেরও বেশি মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছে আর করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৯৩ হাজারেরও বেশি মানুষের৷ ছবিতে টিকা নিয়ে অ্যাকাডেমিসিয়ান ফিয়োডর উগ্লভ মেডিকেল ট্রেন থেকে নামছেন এক নারী৷
ছবি: Evgeny Kozyrev/REUTERS
9 ছবি1 | 9
আর এ কারণেই ‘আমরা বনাম তোমরা', তরুণ বনাম বয়স্ক, টিকা পাওয়া বনাম না পাওয়া কিংবা পরিবার বনাম সিঙ্গেলদের আলাদা করার ভাবনাটা কেমন যেন৷ তবে আমাদের সবার লক্ষ্য তো এক আর তা হলো যত তাড়াতাড়ি যতটা সম্ভব অতিমারির আগের জীবনে ফিরে যাওয়া৷ তাই এই পথে এগোনোর প্রতিটি পদক্ষেপই আসলে সঠিক পদক্ষেপ৷
অতিমারি যেন স্বাভাবিক নিয়তি না হয়
আমাদের মৌলিক অধিকারগুলোকে বিশেষ অগ্রাধিকার মনে করার সুযোগ নেই৷ এগুলো প্রাপ্য৷ বিষয়টা এমন নয় যে, জনগণকে কারণ ব্যাখ্যা করে অধিকারগুলো ফেরত চাইতে হবে, বরং যারা খর্ব করতে চান, তাদেরই তা ফিরিয়ে দিতে হবে৷ দিতে হবে, কারণ, একটা স্বাধীন দেশে সবাই যখন ইচ্ছা স্বাধীনভাবে দেশের বাইরে যেতে পারবেন এবং দেশে ফিরতেও পারবেন, এটা স্বাভাবিক৷ সবাই বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোঁরায় বসে গল্প, হাসাহাসি করতে পারবেন- এটাও স্বাভাবিক৷ কেউ রাতে নিজের অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে যেতে পারবেন, প্রয়োজনে যে-কোনো কিছুর সমর্থনে বা বিরোধিতায় সমাবেশ করতে পারবেন- স্বাধীন দেশে এসবও খুব স্বাভাবিক৷ সুতরাং যদি বড় কোনো সমস্যার ঝুঁকি না থাকে, যদি নতুন করে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা না থাকে, তাহলে টিকার দুটো ডোজই পেয়ে যাওয়াদের চলাফেরার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া উচিত৷
সংহতি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা
বয়স্ক কোনো যুগল টিকা নিয়েছেন বলে ছুটিতে বেড়াতে যাচ্ছেন, ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফিরছেন, তাদের আর কোয়ারান্টিনে যেতে হচ্ছে না- এখনো টিকার প্রথম ডোজই পাননি এমন কারো পক্ষে তা সানন্দে মেনে নেয়া নিশ্চয়ই কঠিন৷ কিন্তু কোনো যুক্তিঙ্গত কারণ ছাড়া ওই যুগলকে কোয়ারান্টিনে যেতে বাধ্য করলে তো অন্য কারো লাভ হবে না৷ এমনও নয় যে, অবসরে চলে যাওয়া প্রবীণদের টিকা নেয়ার পরও বন্ধুদের সঙ্গে বসে তাস খেলতে না দিলেই দেশের সব তরুণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ এক্ষুনি পুরোদমে শুরু করে দেয়া যাবে৷
হ্যাঁ, কারো কারো কাছে কিছু মানুষকে এখন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরার সুযোগ দেয়াকে অন্যায় মনে হতে পারে৷ তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাজের সবাইকে মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার স্বার্থেই এটা খুব প্রয়োজন৷ এভাবে অল্প অল্প করে সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে আর চূড়ান্ত বিচারে সেটাই তো আমরা সবাই চাই৷