ম্যারাডোনা চিকিৎসায় সহযোগিতা করতেন না, বললেন ডাক্তাররা
২৫ এপ্রিল ২০২৫
২০২০ সালে বুয়েনস আইরেসের কাছে নিজের বাড়িতে মাত্র ৬০ বছর বয়েসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যান ডিয়েগো ম্যারাডোনা।
ফুটবল-বিশ্বে ম্যারাডোনা সর্বকালের সেরা ফুটবলারের মধ্যে একজন। ছবি: Agustin Marcarian/REUTERS
বিজ্ঞাপন
ফুটবল মাঠের রাজা হলেও রোগী হিসেবে 'অসহযোগী' এবং 'উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ' ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। মৃত্যুর আগে তার চিকিৎসাকারী ডাক্তাররা সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বৃহস্পতিবার একথা জানান।
দীর্ঘদিন কোকেন এবং মদে আসক্তির সঙ্গে লড়াই করেন তিনি। মস্তিষ্কে জমাট বাঁধা রক্ত অস্ত্রোপচারের পর তার চিকিৎসা চলছিল।
তাকে চিকিৎসারত সাতজন স্বাস্থ্যকর্মীর বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে খুনের সম্ভবনায় আট থেকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। তারা তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সাক্ষীদের বয়ান
তার মারা যাওয়ার আগে ৩ নভেম্বর ক্লিনিকে ম্যারাডোনার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়। সেই ক্লিনিকের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান সেবাস্টিয়ান নানি আদালতকে জানান এই প্রাক্তন ফুটবলার 'উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ' রোগী ছিলেন। মাদক প্রত্যাহারের কারণে তার অতিরিক্ত সেবার প্রয়োজনীয়তা ছিল।
তিনি আরো জানান, নিউরোসার্জেন লিওপোল্ডো লুক এবং মনোবিদ অগাস্টিনা কোসাচভ ম্যারাডোনাকে হাসপাতালের বাইরে রেখে পরিচর্যা করার কথা বলেন। হাসপাতাল এর সঙ্গে একমত ছিল না।
মামলা চলাকালীন ম্যারাডোনার স্ত্রী এবং আরেক ডাক্তারও ফুটবলারকে হাসপাতাল ছেড়ে অন্যত্র চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। নিজের বাড়িতে না রেখে তাকে নেশামুক্তি কেন্দ্রে রাখা হল না কেন সেই নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
কথায়, তথ্যে ম্যারাডোনা
সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা৷ পেশাদার জীবন শেষে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটিয়ে, অন্যের সম্পর্কে মন্তব্য করে মাঝেমধ্যেই আলোচনায় আসতেন তিনি৷
১৯৮৪ সালে ক্লাওদিয়া ভিলইয়াফানিয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় তার৷ ২০০৪ সালে তা ভেঙে যায়৷ ডালমা ও খিয়ানিনা (আগুয়েরোর সাবেক স্ত্রী) নামে তাদের দুটি সন্তান আছে৷ এর বাইরে বিভিন্ন সময় অনেকের সঙ্গে জড়িয়ে আরও সন্তানের জনক হয়েছেন ম্যারাডোনা৷ তবে ডালমা ও খিয়ানিনাকেই তিনি তার বৈধ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ বাকিরা তার ‘টাকা আর ভুলের’ ফসল বলে মন্তব্য করেন ম্যারাডোনা৷ ছবিতে দুই মেয়ের সঙ্গে ম্যারাডোনা৷
ছবি: VALERY HACHE/AFP
‘চার্চ অফ ম্যারাডোনা’
হ্যাঁ, সত্যিই ম্যারাডোনার নামে একটি ধর্ম আছে৷ ১৯৯৮ সালে আর্জেন্টিনার তিন সমর্থক ‘ইগলেসিয়া মারাডোনিয়ানা’ বা ‘চার্চ অফ মারাডোনা’ গড়ে তোলেন৷ ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর ম্যারাডোনা জন্মান৷ সে হিসেবে ২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর ছিল ৬০ ডি.ডি৷ ডি.ডি অর্থ ‘ডেসপুয়েস ডিয়েগো’ বা ডিয়েগোর পর৷ প্রতিবছর ৩০ অক্টোবর ক্রিসমাস পালন করা হয়৷ একশ’র বেশি দেশে এই ধর্মের অনুসারীরা রয়েছেন৷ ছবিতে এক অনুসারীকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Natacha Pisarenko/AP/picture alliance
ফিফা ‘প্লেয়ার অফ দ্য সেঞ্চুরি’
বিশ শতকের সেরা ফুটবলার নির্বাচনে ২০০০ সালে জরিপ করেছিল ফিফা৷ প্রথমে ইন্টারনেট জরিপে ৫৩ শতাংশ ভোট পান ম্যারাডোনা৷ পেলে পান ১৮ শতাংশ ভোট৷ কিন্তু ইন্টারনেট জরিপে ম্যারাডোনা-প্রজন্মের বেশি ভোট পড়া নিয়ে কথা ওঠায় ফিফা তার ম্যাগাজিনের পাঠক, বিভিন্ন দেশের কোচ, কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের নিয়ে দ্বিতীয় একটি জরিপ করে৷ তাতে ৭৩ শতাংশ ভোট পান পেলে৷ ম্যারাডোনা পান ৬ শতাংশ৷ ফলে দুজনকেই যৌথভাবে বিজয়ী ঘোষণা করে ফিফা৷
ছবি: Reuters//C. Platiau
ম্যারাডোনাকে নিয়ে পেলের মন্তব্য
যৌথভাবে ‘প্লেয়ার অফ দ্য সেঞ্চুরি’ নির্বাচিত হওয়ার পর ম্যারাডোনা সম্পর্কে পেলে বলেছিলেন, ‘‘যদি সে নিজেকে শতাব্দীর সেরা প্লেয়ার মনে করে তাহলে সেটা তার সমস্যা৷’’ এছাড়া ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্ব পাওয়া সম্পর্কে পেলে বলেছিলেন, ‘‘এটা ম্যারাডোনার ভুল নয়৷ ভুল হচ্ছে তার, যে তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে৷’’ অবশ্য ম্যারাডোনা মারা যাওয়ার পর পেলে এক টুইটে তার সঙ্গে স্বর্গে ফুটবল খেলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
পেলেকে নিয়ে ম্যারাডোনার মন্তব্য
আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্ব পাওয়ার পর পেলের করা মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘‘পেলের মিউজিয়ামে ফিরে যাওয়া উচিত৷ এবং সেখানেই থাকা উচিত৷’’ এছাড়া ২০০৬ বিশ্বকাপের উদ্বোধনীতে না যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘‘ব্লাডি পেলে আমার আশপাশে হেঁটে বেড়াবে সেটা দেখতে আমি আসিনি৷’’ অথচ ২০০৫ সালে টিভিতে নিজের টকশোর প্রথম অতিথি হিসেবে পেলেকে নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা৷
ছবি: picture-alliance/dpa//TASS/M. Metzel
‘হ্যান্ড অফ গড’
১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে করা প্রথম গোল সবসময় আলোচনায় থাকবে৷ ম্যাচ শেষে ম্যারাডোনা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সেই গোলের ক্ষেত্রে ‘ম্যারাডোনার মাথার সামান্য আর ইশ্বরের হাতের সামান্য’ (এ লিটল উইথ দ্য হেড অফ ম্যারাডোনা অ্যান্ড এ লিটল উইথ দ্য হ্যান্ড অফ গড) অবদান আছে৷ ঐ ম্যাচের রেফারি টিউনিশিয়ার আলী বিন নাসেরের সঙ্গে ২০১৫ সালে দেখা হয়েছিল ম্যারাডোনার৷ আলীকে তিনি ‘চিরকালের বন্ধু’ বলেছিলেন৷
ছবি: pictures-alliance/dpa/empics
‘হ্যান্ড অফ রিজন’
একবার এক আলোকচিত্রীর গাড়ির কাচ ভেঙে ফেলেছিলেন ম্যারাডোনা৷ এরপর বলেছিলেন, ‘‘আমি যুক্তির হাত দিয়ে (হ্যান্ড অফ রিজন) এটা করেছি৷’’ ছবিটি প্রতীকী৷
ছবি: Getty Images/A. Morton
১০ নম্বর তুলে রাখা?
ম্যারাডোনাকে সম্মান জানাতে ফ্রান্সের মার্সেই ক্লাবের কোচ আন্দ্রেই ভিলাশ-বোয়াশ সব দল ও সব প্রতিযোগিতা থেকে জার্সি নম্বর ‘১০’কে অবসরে পাঠাতে ফিফার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷ এর আগে ২০০১ সালে আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশন তাদের জাতীয় দলে আর ১০ নম্বর জার্সি ব্যবহার না করতে ফিফার অনুমতি চাইলে ফিফা সেটি দেয়নি৷ তবে ২০০০ সাল থেকে নেপোলি ক্লাব আর কাউকে ১০ নম্বর জার্সি দিচ্ছে না৷
ছবি: picture alliance/Offside
মেসিকে সমর্থন
২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ ছিলেন ম্যারাডোনা৷ কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে হেরে সেবার বিদায় নিয়েছিল মেসির দল৷ এরপর মেসির সমালোচনা শুরু হলে ম্যারাডোনা তাকে রক্ষায় এগিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘‘যারা বলছেন বিশ্বকাপটা মেসির ভাল যায়নি, তারা বোকা৷’’ একমাত্র ম্যারাডোনা আর মেসিই অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ ও বিশ্বকাপ - দুটোতেই ‘গোল্ডেন বল’ জিতেছেন৷
ছবি: Jon Hrusa/dpa/picture alliance
সবচেয়ে বেশি ফাউলের শিকার
১৯৮২ সালে ইটালির সঙ্গে ম্যাচে ম্যারাডোনাকে ২৩ বার ফাউল করা হয়েছিল৷ এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ফাউলের শিকার হওয়া ফুটবলার তিনি৷ এরপর ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মোট ৫৩ বার ফাউল করা হয় তাকে৷ সেটিও একটি রেকর্ড৷ এক বিশ্বকাপে কোনো এক ফুটবলারকে এতবার ফাউল করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
নানি জানান, "হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর ম্যারাডোনার একশ শতাংশ দায়িত্ব বর্তায় লুকের উপর।" শেষ চার বছরে লুক ছিলেন ম্যারাডোনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। কোসাচভের দেওয়া ওষুধ শেষ দিন পর্যন্ত খেয়েছেন এই ফুটবলার।
লুক এবং কোসাচভ ছাড়াও মনোবিদ কার্লোস ডায়াজ, ডাক্তার ন্যান্সি ফ্লোরিনি এবং পেদ্রো দি স্পাইনা, নার্সিং সার্ভিসের কর্ণধার মারিয়ানো পেরনি এবং নার্স রিকার্ড আলমিরনের বিরুদ্ধেও মামলা চলছে।
'সিটি স্ক্যানের জন্য রাজি করাতে বেগ পেতে হয়'
এছাড়াও এদিন আদালতে সাক্ষ্য দেন নিউরোসার্জেন রোডলফো বেনভেনুটি। মৃত্যুর আগে হাসপাতালে থাকাকালীন ম্যারাডোনার সঙ্গে কথা হয়েছিল তার।
বেনভেনুটি জানান, ম্যারাডোনা রোগী হিসেবে চিকিৎসকদের সঙ্গে সহযোগিতা করতেন না। তিনি বলেন, "মারাদোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিবাদী ছিলেন। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের আগে সিটি স্ক্যানের জন্য রাজি করাতে বেগ পেতে হয়।"
সাক্ষীরা বলেন, ডাক্তার লুকের সঙ্গে হাসপাতালের বচসা হয়। লুক সার্জারি রিপোর্টে মিথ্যা বলে লিড সার্জেন হিসেবে তার নাম দাখিল করেন।
বেনভেনুটি বলেন, যখন ম্যারাডোনার চিকিৎসা বাড়িতে হবে স্থির হয় তখন তার সঙ্গে ফুটবল তারকার বাড়ির লোকের কথা হয়। তিনি আরো জানান প্রয়োজনে লুক ম্যারাডোনাকে চিকিৎসার জন্য রাজি করাবেন এমন কথাও স্থির হয়।
ম্যারাডোনা বাড়ি ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে অনড় ছিলেন বলেও জানান বেনভেনুটি।
তিনি বলেন প্রতিদিন ক্লিনিক থেকে তার বাড়িতে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কথা ছিল। তবে ম্যারাডোনার একগুঁয়েমির কারণে তা সপ্তাহে একদিনে এসে দাঁড়ায়।