ম্যার্কেলের উত্তরসূরিদের নীতি কেমন হবে?
২৪ জুলাই ২০২১আসছে সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানিতে ফেডারেল পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে জিতলেও চ্যান্সেলর হিসেবে আসছেন নতুন কেউ৷ কেননা আঙ্গেলা ম্যার্কেল আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আর এই পদে লড়ছেন না৷
তার জায়গা পূরণে তিন প্রধান দল ইতোমধ্যে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে৷
ম্যার্কেলের নিজের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল বা ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) মনোনয়ন দিয়েছে আরমিন লাশেটকে৷ তিনি দেশটির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থ-রাইন ওয়েস্টফালিয়ার মুখ্যমন্ত্রী৷ সবুজ দল বা গ্রিন পার্টি প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ৪০ বছর বয়সি আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আনালেনা বায়েরবোককে৷ আর সামাজিক গণতন্ত্রী বা দ্য সোশ্যাল ডেমোক্রেটসদের (এসপিডি) প্রার্থী বর্তমান অর্থমন্ত্রী ওলাফ শলৎস৷
সরকার গঠনে জার্মানিতে সাধারণত একাধিক দল মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট গঠন করে৷ এরপর তারা নিজেদের মধ্য থেকে চ্যান্সেলর নির্বাচন করে৷ কে হবেন নতুন চ্যান্সেলর সেটি নির্ভর করবে পরবর্তী জোটের ধরনের উপরে৷ ম্যার্কেল সরকারের জোটে ছিল সিডিইউ/সিএসইউ ও এসপিডি৷ সবুজ দল পালন করেছে বিরোধী দলের ভূমিকা৷
এই সময়ে পার্লামেন্টে শরণার্থী, জলবায়ু ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন নীতিতে এই দলগুলো আর পরবর্তী চ্যান্সেলর প্রার্থীরা কী ধরনের অবস্থান নিয়েছেন তা বিশ্লেষণ করেছে ডয়চে ভেলে৷
শরণার্থী নীতি
দেড় দশকের বেশি সময় সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ ক্ষমতায় থাকাকালে ২০১৫ সালে হাঙ্গেরিতে আটকে থাকা শরণার্থীদের জন্য জার্মানিতে প্রবেশের দুয়ার খুলে দেওয়ার যে নীতি তিনি নিয়েছিলেন তা বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়৷ সংসদে ম্যার্কেলের দলের ভোট রেকর্ড থেকে দেখা যায়, তাদের এক চতুর্থাংশ আরো উদার অভিবাসন নীতিতে বিশ্বাস করে৷ তবে তার জোট ২০১১ সালে সিরীয় শরণার্থীদের বের করে দেয়ার উদ্যোগ বন্ধের একটি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল৷ এই প্রস্তাবটি তুলেছিল সবুজ দল৷ বায়েরবোক ও তার দল বরাবরই উদার শরণার্থী নীতির পক্ষে ভোট দিয়েছে৷
২০২০ সালে গ্রিসে শরণার্থী ক্যাম্পে আগুন লাগার প্রেক্ষিতে জার্মানির আরো শরণার্থী গ্রহণের পক্ষে কথা বলেছেন এসপিডির রাজনীতিকরা৷ সেই সঙ্গে ২০১৫ ও ২০১৬ সালের শরণার্থী স্রোতের সময় দ্রুত আবেদন নিষ্পত্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর উপর জোর দেন তারা৷ কিন্তু একইসঙ্গে ইইউ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপ ও প্রত্যাখ্যাত হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বিতাড়ন প্রক্রিয়া কঠোর করারও প্রস্তাব এসেছে তাদের কাছ থেকে৷
অন্যদিকে এই বিষয়ে আরমিন লাশেট বরাবরই ম্যার্কেলকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন৷ ২০১৫ সালে শরণার্থীনীতি নিয়ে ম্যার্কেল দলের ভিতরে ও বাইরে যখন চাপের মুখে, সেসময়ও পাশে থেকে তাকে সমর্থন যুগিয়েছেন লাশেট৷ বিপরীত দিক থেকে ম্যার্কেল যখন কড়া অবস্থান গ্রহণ করেছেন তখন তার পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন৷
বিদেশে সামরিক মিশন
জার্মানির সৈন্যরা বর্তমানে সারা বিশ্বে ১২টি মিশনে নিযুক্ত আছে৷ সেনাবাহিনীর বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত সরকার নিয়ে থাকলেও তা অনুমোদন নিতে হয় পার্লামেন্ট থেকে৷
বিরোধী দল হিসেবে গ্রিন পার্টি এর কয়েকটিতে মাত্র সমর্থন দিয়েছিল৷ এছাড়া উদাহরণ হিসেবে বায়েরবোক বরাবরই ভূমধ্যসাগরের নিরাপত্তায় ন্যাটোর ‘সি গার্ডিয়ান অপারেশন'-এ জার্মানির সামরিক অংশগ্রহণের বিরোধী ছিলেন৷ একইভাবে ইরাক ও সিরিয়া মিশনেরও সমর্থন দেননি তিনি৷ তবে উত্তর আফ্রিকা ও লেবানন মিশনের পক্ষে অবস্থান নেন তারা৷
সবুজ দলের জলবায়ু নীতি
গ্রিন পার্টির প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু জলবায়ু৷ বুন্ডেসটাগে এ সংক্রান্ত অনেক প্রস্তাব হাজির করেছে তারা৷ ২০২২ সালের মধ্যে কয়লার ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা তার একটি৷ পাশাপাশি সরকারের জলবায়ু নীতি বিষয়ক বিভিন্ন উদ্যোগেও দলটি সমর্থন দিয়ে এসেছে৷ যেসব ক্ষেত্রে উদ্যোগগুলো যথেষ্ট নয় বলে মনে করেছে, সেখানে বিরোধিতা করেছে৷
অন্যদিকে সবুজ দলের অর্ধেকের বেশি জলবায়ু প্রস্তাব ম্যার্কেল ও তার জোট সমর্থন করেছে৷ জলবায়ু সুরক্ষা কর্মসূচী ২০৩০, বিমান শিল্পের উপর কর বৃদ্ধি করা তারই কিছু উদাহরণ৷ আবার বিপরীত দিক থেকে ম্যার্কেল ও তার দল সৌরবিদ্যুতে ভর্তুকির বিপক্ষেও ভোট দিয়েছে৷
জলবায়ু নিয়ে লাশেটের দ্বিধা
সংসদের ভোটের রেকর্ড থেকে জলবায়ু নীতি নিয়ে লাশেট বা শলৎস এর অবস্থান সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না৷ তবে জলবায়ু ইস্যুতে অল্প কয়েকটি ভোটের মধ্যে লাশেট প্রাণিকল্যাণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ নীতির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন৷ জনসম্মুখে জলবায়ু নীতি নিয়ে তাকে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়৷ তার নিজের রাজ্যে নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়ায় কয়লাই প্রধান জ্বালানি হিসেবে ভূমিকা রাখছে৷ যে কারণেই হয়ত জলবায়ু নিয়ে আলোচনায় তিনি বরাবরই শিল্প ও অর্থনীতির উপর গুরুত্বারোপ করেন৷
ইইউ নিয়ে অবস্থান
সংসদে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিষয়ক বিভিন্ন প্রস্তাব সাধারণত সরকার দলীয় জোটই উপস্থাপন করে আর সেগুলো সহজেই পাশ হয়৷ এক্ষেত্রে গ্রিন পার্টি নিজেরা উদ্যোগী না হলেও বিভিন্ন সময়ে সিডিইউ/সিএসইউ-এর প্রস্তাবগুলোকে সমর্থন দিয়েছে৷ এরমধ্যে গ্রিসের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা থেকে শুরু করে আলবেনিয়াকে ইইউতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ২০১৯ সালের আলোচনা বা ২০২০ সালের ইইউর মহামারি সহায়তা তহবিলে অংশগ্রহণের মতো বিষয়গুলো রয়েছে৷
বিরোধী দলে থাকা সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে গ্রিন পার্টি যেভাবে সরকারি জোটকে সমর্থন যুগিয়েছে তাতে অনেকটা বিস্মিত ইউনিভার্সিটি অব বামবের্গের অধ্যাপক উলরিশ সিবেরের৷ তিনি বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে তারা ভবিষ্যত সরকারে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ আপনি যদি পরবর্তীতে একসাথে তাদের সঙ্গে সরকার চালাতে চান তাহলে সবকিছুতে বিরোধিতা করতে পারবেন না৷’’
কিরা শাখট/এফএস