দীর্ঘ সংকটের পর অবশেষে সরকার টিকিয়ে রাখতে পারলেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ কিন্তু এজন্য অভিবাসন নীতির প্রশ্নেও ছাড় দিতে হয়েছে তাঁকে৷ ম্যার্কেলের উদারপন্থি নীতি এখন কেবলই ইতিহাস বলে মনে করছেন ডয়চে ভেলের এডিটর-ইন-চিফ ইনেস পোল৷
বিজ্ঞাপন
গত দুই সপ্তাহে যে কেবল চ্যান্সেলর হিসেবে ম্যার্কেলের ভাগ্যই নির্ধারণ হয়েছে, তা নয়, ইউরোপের অভিবাসন নীতির ব্যাপারেও হয়েছে বিস্তর আলোচনা৷ সীমানায় রাশ টানার পক্ষে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ওকালতি করছেন, জয় হয়েছে তাঁদেরই৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাঁরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছেন, এই রাজনীতিবিদরা তাঁদের আটকাতে চান৷
শুধু সীমান্তে কড়াকড়িই নয়, উত্তর আফ্রিকায় নির্মাণ করা হবে শরণার্থী ক্যাম্প৷ ইউরোপে প্রবেশের যোগ্য কিনা জানার আগ পর্যন্ত তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে সেসব ক্যাম্পেই৷ তাঁদের আশ্রয়প্রার্থনার অধিকার যেমন রয়েছে, তাঁদের শ্রমও প্রয়োজন ইউরোপের৷ এখন সবকিছুই করা হবে খুব দ্রুততার সঙ্গে৷ যাঁদের ঢুকতে দেয়া হবে, তাঁদের আবাসনের ব্যবস্থা দ্রুতই করা হবে, ফেরতও পাঠানো হবে দ্রুত৷
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিহাস
গত সপ্তাহে ইউরোপের অন্য নেতাদের সাথে সমঝোতায় আসতে গিয়ে ম্যার্কেলকে তাঁর মুক্ত সীমান্ত নীতিতে ছাড় দিতে হয়েছে৷ এই সমঝোতার ফলে হর্স্ট সেহোফারও তাঁর অবস্থান থেকে কিছুটা পিছিয়ে এসে জার্মান সরকারকে ভেঙে পড়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও৷
ম্যার্কেলের পর কারা হতে পারেন চ্যান্সেলর?
চতুর্থবারের মতো চ্যান্সেলর মেয়াদে অভিবাসন নীতি নিয়ে ঘরে বাইরে বেশ লড়াই করতে হচ্ছে আঙ্গেলা ম্যার্কেলেকে৷ তার পরিবর্তে কারা হতে পারেন জার্মান চ্যান্সেলর? এ নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: Reuters/H. Hanschke
আনেগ্রেট ক্রাম্প-কারেনবাউয়ার
ক্রাম্প-কারেনবাউয়ারকে ম্যার্কেলের নিজের পছন্দের প্রতিনিধি মনে করা হয়৷ কিন্তু জার্মানি জুড়ে তাঁর পরিচিতি বেশ কম৷ সিডিইউ-এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার আগে ক্রাম্প-কারেনবাউয়ার সারল্যান্ডের রাজ্য প্রধান হিসেবে সিডিইউ-এসপিডি জোটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন৷ ম্যার্কেলের উদার অভিবাসন নীতির সমর্থক তিনি৷
ছবি: Reuters/H. Hanschke
ফল্কার বুফিয়ার
হেসের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ২০১০ সাল থেকে রাজ্য প্রধান বুফিয়ার৷ বর্তমানে ভিসবাডেনে সিডিইউ-গ্রিন জোটের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন৷ ম্যার্কেলের সিডিইউ পার্টির নির্বাহী কমিটির পাঁচ ডেপুটি চেয়ারপার্সনের একজন তিনি৷
ছবি: Reuters
ভোলফগাং শয়েবলে
কয়েক দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শয়েবলের৷ সিডিইউয়ের সবচেয়ে অভিজ্ঞ নেতাদের একজন তিনি৷ ৭৫ বছর বয়সি এই সাবেক আইনজীবী ২০১৭ সালে জার্মান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ম্যার্কেলের অধীনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন৷ জার্মানির অভিবাসন নীতির সমালোচনা করলেও ম্যার্কেলের সাথে তাঁর সম্পর্ক বেশ ভালো বলেই ধরে নেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Fischer
ইয়েনস স্পান
চ্যান্সেলর হওয়ার দৌঁড়ে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে কনিষ্ঠতম স্পান৷ ২০০২ সালে সংসদ সদস্য এবং পরবর্তীতে জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন তিনি৷ ২০১৬ সালে ম্যার্কেলের বিরুদ্ধে গিয়ে সিডিইউ সম্মেলনে দ্বৈত নাগরিকত্ব বাতিলের প্রস্তাব পাশ করাতে ভূমিকা রাখেন৷ জার্মানির দারিদ্র্য নিয়ে মন্তব্যে তাঁকে সম্প্রতি বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে৷
ছবি: Reuters/K. Pfaffenbach
উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন
জার্মানির প্রথম নারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী তিনি৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণস্বাস্থ্যের ওপর তাঁর পড়াশোনা৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বিত প্রতিরক্ষার অন্যতম সমর্থক তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/M. Kappeler
ইউলিয়া ক্ল্যোকনার
ক্ল্যোকনার বর্তমানে ম্যার্কেলের কৃষিমন্ত্রী৷ তবে ম্যার্কেলের চেয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত তিনি৷ গর্ভপাত এবং ভ্রূণ নিয়ে গবেষণার বিরুদ্ধে তিনি৷ ম্যার্কেলের অভিবাসন নীতির বিকল্প প্রস্তাবেরও একজন সমর্থক ক্ল্যোকনার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
হর্স্ট সেহোফার
জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেহোফারকেই বর্তমান সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ জার্মানির নতুন অভিবাসন নীতি নিয়ে মূলত সেহোফারই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন ম্যার্কেলকে৷ বাভারিয়া অঞ্চলে সিডিইউর সহযোগী দল সিএসইউর প্রধান সেহোফার৷ অক্টোবরে বাভারিয়ার নির্বাচনে তাঁর দল ভালো করার আশা করলেও বাকি জার্মানি তাঁকে চ্যান্সেলর হিসেবে না-ই দেখতে চাইতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
মার্কুস স্যোডার
বাভারিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যোডার৷ অভিবাসন বিষয়ে ম্যার্কেলকে চ্যালেঞ্জ করে তিনিও এসেছেন আলোচনায়৷ জার্মানির দক্ষিণের এই রাজ্যে অভিবাসনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়াদের দ্রুত নিজ দেশে ফেরত পাঠানো এবং রাষ্ট্রীয় ভবনে ক্রুশ স্থাপনসহ বেশকিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ সমালোচনাতেও পড়তে হয়েছে তাঁকে৷
ছবি: Reuters/L. Barth
পেটার আল্টমায়ার
জার্মান অর্থমন্ত্রী আল্টমায়ার ম্যার্কেলের অভিবাসননীতির সমর্থক৷ সারল্যান্ড থেকে আসা এই রাজনীতিবিদ আগে কাজ করতেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে৷ ম্যার্কেলের খুব ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আল্টমায়ার কাজ করেছেন পরিবেশমন্ত্রী হিসেবেও৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Schreiber
আরমিন লাশেট
উদারপন্থি এই নেতাকে বিরোধীরা ‘রাজনীতির জন্য একটু বেশিই নরম’ বলে সমালোচনা করে থাকেন৷ সিডিইউর হয়ে গত বছর জার্মানির সবচেয়ে বড় রাজ্য নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার রাজ্য প্রধান নির্বাচিত হন লাশেট৷ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের জন্য এই পরাজয় ছিল বিশাল এক ধাক্কা৷ সাবেক এই সাংবাদিকও ম্যার্কেলের পাঁচ ডেপুটির একজন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Berg
10 ছবি1 | 10
এটা শুধু জার্মানি নয়, পুরো ইউরোপের জন্যই ভালো খবর৷ কেবল পপুলিস্টরাইজার্মান সরকারের এমন সংকটে বেশসুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছিল৷ তবে জার্মানিতে স্থিতিশীলতা খুবই প্রয়োজন৷ এ কারণেই ম্যার্কেল এত দ্রুত ইউরোপীয় সম্মেলন ডেকে অভিবাসন ও শরণার্থী নীতিমালার একটি মোটামুটি ধারণা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছেন৷ ইউরোপ জানে, ম্যার্কেল এই মুহূর্তে কী দিতে পারেন৷
সত্যিকারের সমাধান!
সমস্যার আপাত সমাধান হয়েছে বটে, কিন্তু চ্যালেঞ্জের সঠিক উত্তর মেলেনি৷ উত্তর আফ্রিকার কোন কোন দেশে ক্যাম্প তৈরি হবে? ন্যূনতম মানবাধিকার রক্ষা করা যাবে কোন দেশে?
আলজেরিয়ার উদাহরণ খুবই কষ্টদায়ক৷ হাজার হাজার মানুষকে পাঠানো হয়েছে মরুভূমিতে৷ ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ক্ষুধা, পিপাসায় মারা গেছে তাঁদের অনেকেই৷ পুরো ইউরোপ মিলে যে পরিমাণ শরণার্থী নিয়েছে, লেবানন একাই নিয়েছে তার চেয়ে বেশি৷ এসবই ইউরোপের বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিবাসন নীতির ফল৷
উত্তরের চেয়ে প্রশ্নই বেশি
ইউরোপে এখন উত্তরের চেয়ে প্রশ্নের পরিমাণ বেশি৷ কোন সরকার ইটালি এবং গ্রিসের ওপর থেকে বোঝা কমাতে প্রস্তুত? সিডিইউ এবং সিএসইউ এত দ্রুত একমত হতে পেরেছে, কারণ, আসলে কোনো বিষয়েই সঠিক কোনো মীমাংসা হয়নি৷ শুধু একটা বিষয়েই পরিষ্কার হওয়া গেছে, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এখন থেকে আরো জোরদার হবে৷ এতে শুধু ইউরোপিয়ান বর্ডার ও কোস্ট গার্ড এজেন্সি, ফ্রন্টেক্স এবং বেড়া প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে৷
তিন বছর ধরে একটি মানবিক অভিবাসন নীতির পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ম্যার্কেল৷ তাঁর অনেক ভুলও হয়েছে৷ কিন্তু এখন তাঁকে তাঁর নিজ দেশের রাজনীতি, নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ইউরোপের পরিস্থিতি, এমনকি জোট সরকারে শরিক দল সিএসইউও তাঁকে বাধ্য করেছে কঠোর পথে আসতে৷
তবে অসহায়দের পক্ষে দাঁড়াতে ম্যার্কেলের নিজের যে অবস্থান, তা পালটাবে বলে মনে হয় না৷ শুধু বেড়া নির্মণের দিকে মনোযোগ দিলেই হবে না, সঠিক অভিবাসন নীতিমালা, আফ্রিকার দেশগুলোকে সহায়তায় নতুন সমোঝোতা এবং যুদ্ধকবলিত দেশগুলোতে যাতে দেশের মানুষ নিজ দেশেই থাকতে পারেন, তা নিশ্চিত করাও তাঁর দায়িত্ব৷