ইউরোপীয় ইউনিয়নে গতিবেগ আনে জার্মানি ও ফ্রান্স৷ স্ট্রাসবুর্গে চ্যান্সেলর ম্যার্কেল ও প্রেসডেন্ট ওলঁদ-এর আবির্ভাব প্রতীতি উৎপাদন করেছে৷ এবার চাই কথার সঙ্গে কাজ, বলে মনে করেন ব্যার্ন্ড রিগ্যার্ট৷
বিজ্ঞাপন
দু'জনে সব কিছু একসঙ্গে করেছেন৷ এমনকি ম্যার্কেলের কোট ও ওলঁদের টাই-এর রং একই ছিল৷ দু'জনে একত্রে ইউক্রেনের পরিত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন, উদ্বাস্তু ত্রাণ করেছেন, এবং যারা জনতাকে খ্যাপাচ্ছে, তাদের হাত থেকে ইউরোপকে বাঁচিয়েছেন৷ উভয়ের বার্তা ছিল স্পষ্ট: তাঁরা দু'জনে একসঙ্গে৷ ইউরোপ তার অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশ নীতি জনক চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করতে পারবে একটি জোরালো ফরাসি-জার্মান ইঞ্জিন থাকলে৷ ঠিক আজ থেকে ২৬ বছর আগে হেলমুট কোল ও ফ্রঁসোয়া ওলঁদ যেভাবে ইউরোপীয় সংসদে একসঙ্গে ভাষণ দিতে আসেন৷ তখন বিতর্কিত বিষয় ছিল পূর্ব-পশ্চিম সংঘাত ও জার্মানি তথা ইউরোপের ঐক্য৷ আজকের বিষয় হলো উদ্বাস্তু সংকট এবং ইইউ-এর ২৮টি সদস্যদেশে জাতীয়বাদী প্রবণতা পুনরায় মাথা চাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা৷ এ-ও একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ৷
শরণার্থীদের নিয়ে সংকটে ইউরোপ
ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে দেখা দেয়া সংকট দিনে দিনে বড় হচ্ছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ ফ্রন্টেক্স-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এ বছরের প্রথম সাত মাসে ৩ লক্ষ ৪০ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী ঢুকেছে ইউরোপে৷
ছবি: Reuters/L. Balogh
জার্মানির ওপর বহুমুখী চাপ
শরণার্থীদের নিয়ে জার্মানিতে উদ্বেগ বাড়ছে৷ বেশ কিছুদিন ধরেই আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলছেন, শরণার্থী সংকট ইউরোপের সবচেয়ে বড় সংকট হতে চলেছে৷ আশঙ্কা সত্যি হওয়ার কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে৷ এ বছর আট লাখেরও বেশি শরণার্থী জার্মানিতে আসবে বলে জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশঙ্কা৷ শরণার্থীবিরোধী বিক্ষোভ দানা বাঁধছে৷ তার ওপর নতুন দুশ্চিন্তা হয়ে উঠেছে হাঙ্গেরি থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জার্মানির দিকে ঠেলে দেয়ার হিড়িক৷
ছবি: Reuters/L. Foeger
জার্মানি ও অস্ট্রিয়ায় ট্রেনবোঝাই শরণার্থী
সোমবার শরণার্থীতে ভরা ট্রেন ঢুকেছে জার্মানির হামবুর্গ ও অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে৷ ট্রেনগুলো এসেছে হাঙ্গেরি থেকে৷ যাত্রীদের বেশিরভাগই সিরিয়ার নাগরিক৷ তবে তাদের কাছে কোনো পাসপোর্ট, ভিসা বা বৈধ কাগজপত্র নেই৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Kisbenedek
শরণার্থীদের চাপে বুদাপেস্ট রেল স্টেশন বন্ধ
হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের কেন্দ্রীয় রেল স্টেশন সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে৷ মঙ্গলবার কয়েক হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী ভিয়েনা এবং মিউনিখ যাওয়ার জন্য স্টেশনে হাজির হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেয় রেল কর্তৃপক্ষ৷ ভিয়েনার পুলিশ জানায়, বুদাপেস্টের কেলেটি স্টেশনে ৩ হাজার ৬৫০ অভিবাসনপ্রত্যাশী প্লাটফর্মে অপেক্ষারত ভিয়েনা-মিউনিখগামী ট্রেনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে৷ পরে সবাইকে স্টেশন থেকে বের করে দেয়া হয়৷
ছবি: Reuters/L. Balogh
হাঙ্গেরিকে আর্থিক সহায়তার আশ্বাস
এই মুহূর্তে হাঙ্গেরি খবরে এলেও, অভিবাসনপ্রত্যাশীরা এতদিন মূলত গ্রিস এবং ইটালি হয়েই ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা করতো৷ এ বছর অন্তত ৩ লাখ অভিবাসনপ্রত্যাশী ঢুকেছে ইটালি ও গ্রিসে৷ এ কারণে দুটি দেশই ইইউর আর্থিক সহায়তা পেয়ে আসছে৷ ইইউর অভিবাসন বিষয়ক দূত জানিয়েছেন, হাঙ্গেরিকেও এ সহায়তা দেয়া হবে৷
ছবি: Reuters/B. Szabo
শরণার্থীদের বিক্ষোভ
গত সপ্তাহেই ৭১ জন শরণার্থীর গলিত লাশ পাওয়া গিয়েছিল হাঙ্গেরি সীমান্তবর্তী ভিয়েনার এক রাস্তায়৷ মর্মন্তুদ সেই ঘটনার পর শরণার্থীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দেয়৷ সোমবার ২০ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশীর বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে ভিয়েনায়৷ বিক্ষুব্ধ শরণার্থীদের দাবি, ইউরোপে প্রবেশের বৈধ রুট খুলে দিতে হবে, কেননা, ‘মানবতাই সবচেয়ে বড়’৷ ওপরের ছবিতে ভিয়েনা রেল স্টেশনে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/L. Foeger
শরণার্থী নিতে রাজি তবে মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকায় আপত্তি পোল্যান্ডের
মধ্যপ্রাচ্যের কোনো শরণার্থী নিতে রাজি নয় পোলিশ সরকার৷ সরকারের যুক্তি- ইউক্রেন সংকটের কারণে সেখান থেকে যাঁরা আসছে তাদের গ্রহণ করছে পোল্যান্ড, তাই আর শরণার্থী নেয়া সম্ভব নয়৷ পোল্যান্ড এতদিন সব মিলিয়ে মাত্র ২ হাজার ২০০ শরণার্থী নিতে রাজি ছিল৷ তবে ইইউ অঞ্চলে শরণার্থী সংকট বেড়ে যাওয়ায় পোল্যান্ড আরো বেশি শরণার্থী গ্রহণ করার চিন্তা করছে৷ ছবিতে পোল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া এক চেচেন পরিবার৷
ছবি: WOJTEK RADWANSKI/AFP/Getty Images
সাইকেল চালিয়ে....!
সিরিয়া থেকে অনেকে নাকি সাইকেলেই পাড়ি দিচ্ছেন দীর্ঘ পথ৷ রাশিয়ায় প্রবেশ করেছেন অনেকে৷ কেউ কেউ ঢুকে পড়েছেন নরওয়েতে৷ নরওয়ের কিরকেনস শহরের পুলিশ কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, এ পর্যন্ত দেড়শ-র মতো সিরীয় সে দেশে ঢুকেছে৷ ইউরোপের দেশ হলেও নরওয়ে বা রাশিয়া ইইউ-র সদস্য নয়৷ তবে নরওয়ে সেঙেন অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত৷ তাই সেখান থেকে ইইউভুক্ত যে কোনো দেশে অনায়াসে ঢুকে পড়া যায়৷
ছবি: Reuters/J. Prakash
7 ছবি1 | 7
আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং ফ্রঁসোয়া ওলঁদ তাদের ভূমিকা নিখুঁতভাবে পালন করেছেন৷ ম্যার্কেল দ্বিধাগ্রস্ত ইউরোপীয়দের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তারা আপোশ করতে জানে – এবং তাদের আপোশ করার উৎসাহ দিয়েছেন৷ নয়ত আমরা যে ইউরোপকে চিনি, সে ইউরোপের অন্ত ঘটবে – সাবধান করে দিয়েছেন ওলঁদ৷ বলতে কি, দু'জনের বক্তব্যের মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না৷
উভয়ে পরস্পরের বক্তৃতা পাঠ করেও শোনাতে পারতেন৷ সম্ভবত বার্লিনে চ্যান্সেলরের দপ্তর আর প্যারিসে এলিসি প্রাসাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে দু'টি বক্তৃতার খসড়া তৈরি করা হয়েছিল৷
দু'জনে অতি স্পষ্টভাবে জানান দিয়েছেন যে, ইউরোপের নেতৃত্ব তাঁদের হাতে – এবং যাবতীয় জাতীয়তাবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, ইউরোনিন্দুকদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন৷ ‘‘আমরা পারব'', জার্মানির জনগণকে বলেছেন ম্যার্কেল, যদিও ঠিক ঐ ভাষায় নয়৷ তবে ‘‘ম্যার্কোলঁদ''-এর এই সব উক্তি ইউরোপের জনগণকে প্রভাবিত করবে কিনা, তা এখনও অজ্ঞাত৷ ইউরোপীয় ধারণার প্রতি তাদের আস্থা এমনিতেই কমে আসছিল, এবং তা এই উদ্বাস্তু সংকটের অনেক আগে থেকেই৷
তবে সিরিয়া সংঘাত সমাধানের কোনো বাস্তব পন্থা বাতলাতেন পারেননি ম্যার্কেল ও ওলঁদ – উদ্বাস্তুদের দেশত্যাগের কারণ দূর করার উপায়ও বাতলাতেন পারেননি তাঁরা৷ এক্ষেত্রে আগামীতে তাঁদের আরো অনেক কিছু করতে হবে, যদি ইইউ-তে জার্মান-ফরাসি নেতৃত্বের দাবি জোরদার করতে হয়৷ আগামী সপ্তাহের সূচনাতেই ব্রাসেলসে যাবতীয় ইইউ সদস্যদেশের শীর্ষবৈঠক৷ স্ট্রাসবুর্গের মৈত্রী ও প্রীতি ব্রাসেলসে না-ও টিঁকতে পারে, যখন ইউরোপীয় উদ্বাস্তু তথা রাজনৈতিক আশ্রয়দানের নীতিকে একটি লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতকে আনতে হবে৷ ফরাসি-জার্মান ঐক্য থাকলে তা হয়ত সম্ভব হবে, কিন্তু সেই ঐক্য ছাড়া তা একেবারেই অসম্ভব৷