আফ্রিকায় এই টিকার পরীক্ষা হয়েছে। সাফল্যের হার ৩০ শতাংশ। তা সত্ত্বেও এই টিকা অনুমোদন করা হয়েছে। এই টিকার চারটি ডোজ নিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশা, এই টিকা আফ্রিকায় হাজার হাজার শিশুর জীবন বাঁচাবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দুই বিশেষজ্ঞের কমিটি টিকাকে ছাড়পত্র দিয়েছে। তারপর সংস্থার প্রধান জানিয়েছেন, এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
টিকা সম্পর্কে যা জানা গেছে
এই ভ্যাকসিনের নাম মসকুরিক্স। গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইন(জিএসকে) ১৯৮৭ সালে এই ভ্যাকসিন তৈরি করে। বহু বছর ধরে পরীক্ষার পর এবার তা অনুমোদন করা হলো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল বলেছেন, ''এই ভ্যাকসিনটি আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা আফ্রিকায় বসে তৈরি করেছেন। তাই আমরা গর্বিত। এই ভ্যাকসিন ব্যবহার করে হাজার হাজার প্রাণ বঁচানো সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করছি।''
ঘানা, কেনিয়া, মালাউয়িতে ২০১৯ থেকে আট লাখ বাচ্চার উপর এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা হয়েছে।
ম্যালেরিয়া হলো মশাবাহিত রোগ। এতদিন পর্যন্ত মশা ঠেকানোর জন্য মানুষ মশারি ও মশা মারার স্প্রে ব্যবহার করত। পুরসভাও মশা মারার জন্য ড্রেনে তেল দিত ও স্প্রে করত। কিন্তু এবার ভ্যাকসিনও ব্যবহার করা যাবে।
ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা আমাদের কাছে খুব পরিচিত৷ কিন্তু এমন অনেক রোগ রয়েছে, যার নামও হয়ত আমরা জানি না৷ মশাবাহিত নানা ধরনের রোগ নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: CC/somaskandaগর্ভবতী নারী মশাদের কামড়ে এই রোগ ছড়ায়৷ ৩০ ধরনের ভিন্ন প্রজাতির লাইশম্যানিয়াসিস জীবাণু রয়েছে৷ এর মধ্যে ১০টি মানবদেহে রোগ ছড়ায়৷ প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর ও মাথা ব্যাথা দেখা দেয়৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্কিন আলসার হয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়৷ তবে দ্রুত ডাক্তার না দেখালে যকৃত, বৃক্কসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে লাইশম্যানিয়াসিস৷
ছবি: WHO/C.Blackকুলেক্স নামের নিশাচর মশা এই রোগের ভাইরাস বহন করে৷ মূলত আফ্রিকায় পাওয়া গেলেও সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে মানবশরীরে এই জীবাণুর অস্তিত্ব পেয়েছেন৷ এই মশার কামড়ে তীব্র জ্বর ও মস্তিষ্কে প্রদাহ দেখা দেয়৷ আরো ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন হাড়ের সংযোগেও প্রদাহের সৃষ্টি হয়৷ কয়েক সপ্তাহ পর এ রোগ এমনিতেই সেরে যায়৷ এর কোনো ওষুধ নেই৷
ছবি: Imagoটাইগার মশা এবং এডিস প্রজাতির আরো কিছু মশার মাধ্যমে ইয়েলো ফিভার ছড়ায়৷ সাধারণভাবে একে ফ্লাভিবাইরাসও বলা হয়ে থাকে৷ আফ্রিকার ৩৪টি এবং দক্ষিণ ও মধ্য অ্যামেরিকার ১৩টি দেশে ইয়েলো ফিভারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি৷ শুরুতে জ্বর এলেও পরে তা বমি, এবং একসময় মেনিনজাইটিসে রূপ নেয়৷ গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়া, এমনকিসম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/P. Whitakerএডিস ইজিপ্টাই নামের মশার কামড়ে আক্রান্ত হলে শরীরে ব্যাথা হয়, লাল গুটি দেখা দেয়, মাংসপেশী ও হাড়ের জোড়াতেও ব্যাথা হয়৷ চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে রক্তক্ষরণে মৃত্যুও হতে পারে৷ প্রথমবারের ধাক্কা সামলে উঠলেই যে মুক্তি তা কিন্তু নয়৷ ডেঙ্গু রোগে কেউ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তা প্রথমবারের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে৷
ছবি: R. Richterএডিস ইজিপ্টাই, টাইগার মস্কিউটো এবং এডিস আলবোপিকটাস জিকা ভাইরাস ছড়ায়৷ ২০১৫ সালে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ৷ জিকার আক্রমণে ব্রাজিলে অসংখ্য শিশু মাইক্রোসিফেলি নামের ভয়াবহ প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে জন্মায়৷ এর ফলে শিশুদের মাথার আকৃতি বিকৃত হয়ে যায়৷ বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েরা জিকায় আক্রান্ত হলে শিশুদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Lacerdaবয়স্ক লোক বা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগ ভয়াবহ ক্ষতি বয়ে আনতে পারে৷ এর ফলে মেনিনজাইটিস ও মায়োকার্ডিটিস হতে পারে৷ অন্যান্য মশাবাহী রোগের মতো কাঁপুনি, ঠান্ডা লাগা, জ্বর, মাথা ব্যাথা, ঝিমুনি এবং ব়্যাশ দেখা দিতে পারে৷ এর কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Pleulচিকুনগুনিয়ার প্রভাবে জ্বর কাটিয়ে উঠতে তিন-চার দিন লাগে৷ কিন্তু এর পর হাড়ের জোড়ায় ভয়াবহ ব্যথা কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে চামড়ায় ক্ষত দেখা দিতে পারে৷ তবে আশার কথা, একবার চিকুনগুনিয়া হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই কমে যায়৷
ছবি: Imagoমশাবাহী রোগের মধ্যে ম্যালেরিয়া সবচেয়ে বেশি পরিচিত৷ অ্যানোফিলিস নামের মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়৷ এই রোগে আক্রান্ত হলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে৷ ম্যালেরিয়ার কার্যকর ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি৷ তবে আগে থেকে সতর্ক থাকলে এতে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা কমানো যেতে পারে৷
ছবি: Cécilia Conan তবে এই ভ্যাকসিন মাত্র ৩০ শতাংশ কার্যকর এবং এর চারটি ডোজ নিতে হবে। কারণ, এর সুরক্ষা কয়েক মাস পর্যন্ত থাকে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব বেশি হয় না। তবে জ্বর ও কনভালশন হতে পারে।
আফ্রিকায় প্রতি বছর চার লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা যান। তার মধ্যেো বেশিরভাগই পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু। ২০১৯ সালে আফ্রিকায় করোনায় যত না মানুষ মারা গেছেন, তার থেকে বেশি ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন।
প্রতি বছর দেড় কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে জিএসকে।
বিজ্ঞানীরা যা বলছেন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আফ্রিকা ডিরেক্টর মাতশিডিসো মোয়েতি বলেছেন, ''আজ আফ্রিকার জন্য একটা আশার কিরণ দেখা যাচ্ছে। আফ্রিকায় এই রোগের প্রকোপ খুব বেশি। আশা করব, আফ্রিকার বাচ্চারা ম্যালেরিয়ার হাত থেকে রেহাই পাবে, তারা সুস্থ অবস্থায় বেড়ে উঠবে।''
কেমব্রিজ ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল রিসার্চের ডিরেক্টর জুলিয়ান রেনার বলেছেন, ''এটা একটা বিশাল পদক্ষেপ। এটা একটা অসম্পূর্ণ টিকা। তা সত্ত্বেও তা হাজার হাজার শিশুর জীবন বাঁচাতে পারে।''
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান আলেজান্দ্রো ক্র্যাভিয়োটো বলেছেন, ''এখনো পর্যন্ত এর চেয়ে বেশি কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া যায়নি।''
লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের আজরা গনি বলেছেন, ''ভ্যাকসিন ৩০ শতাংশ কার্যকর হলেও বহু জীবন বাঁচবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরেও চাপ কমবে।''
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আরেকটি ম্যালেরিয়া ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। এক বছর ধরে ৪৫০ জনের উপর তার পরীক্ষা চলছে। এই ভ্যাকসিন ৭৭ শতাংশ সফল।
জিএইচ/এসজি (এপি, এএফপি, রয়টার্স)