সারা বিশ্বে কয়েক লক্ষ মানুষ প্রতি বছর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়৷ আক্রান্তের সংখ্যা তো আরো বেশি৷ তবে সম্প্রতি মার্কিন গবেষকরা একটি নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন, যা এই রোগ দমনে বিপ্লব আনতে পারবে বলে ধারণা৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্বব্যাপী বছরে আনুমানিক ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়৷ মারা যায় ৬০০,০০০ মানুষ৷ অ্যানোফিলিস প্রজাতির স্ত্রী মশার কামড়ে রোগটি সংক্রমিত হয়৷ এর ফলে প্লাসমোডিয়াম প্যারাসাইট মানুষের রক্তে মিশলে প্রচণ্ড জ্বর, কাঁপুনি, পেটে গোলমাল ইত্যাদি দেখা দেয়৷
সঠিক সময়ে শনাক্ত করা হয় না
রোগটি এত বিস্তৃত হওয়ার কারণ, ঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে এটি শনাক্ত করতে না পারা৷ অনেক অঞ্চলে প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরও অভাব রয়েছে৷
টেক্সাসের রাইস ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যার মাধ্যমে শুধু দ্রুতই নয়, সঠিক ও সুলভ মূল্যে রোগ শনাক্ত করা যাবে৷ এটিকে বলা হয় ‘ভেপার ন্যানোবাবল্ টেকনোলজি'৷ আর এই কাজটি করা হয় লেজার দিয়ে৷
ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট প্রবেশ করলে ‘হিমোজোইন' নামে এক ধরনের উপাদান দেখা যায় রক্তে৷ অর্থাৎ রক্তের সুস্থ লোহিত কণিকায় এই পদার্থটি থাকে না৷ এর ফলে রোগটি শনাক্ত করা সহজ হয়৷ এই পদ্ধতির উদ্ভাবক দিমিত্রি লাপোটকো বলেন, ‘‘আমরা এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি, যার মাধ্যমে কয়েক মুহূর্তে রক্তের নমুনা ছাড়াই ম্যালেরিয়া শনাক্ত করা যায়৷''
দেহের খুব অল্প শতাংশ ‘সেল' বা কোষ আক্রান্ত হলেও ম্যালেরিয়া চিহ্নিত করা সম্ভব৷ অন্তত ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে এই ফলাফল পাওয়া গিয়েছে৷
অতি দ্রুত ধরা পড়ে
লেজারের সাহায্যে এক সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ সময়ে সম্ভাব্য সংক্রমিত সেল শনাক্ত করা যায়৷ লেজারের তেজ হিমোজোইন-ক্রিস্টালকে প্রচণ্ড উত্তপ্ত করে৷ এর ফলে ক্রিস্টালের চারপাশে অতিক্ষুদ্র ন্যানোমিটার আকারের বাষ্পীয় বুদবুদ তৈরি হয়৷ এগুলি ফেটে গেলে এক ধরনের ধ্বনি-সংকেত সৃষ্টি করে৷ লেজার সংযুক্ত শ্রবণযন্ত্রের মাধ্যমে এই সংকেত নির্ণয় করা যায়৷ এতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ অর্থাৎ সুস্থ সেলকে ম্যালেরিয়া সংক্রমিত বলে ভুল করা হয় না৷
ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য
সাম্প্রতিক সময়ে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে আশানুরুপ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ৷ ফলে মৃত্যুহার কমার পাশাপাশি, আক্রান্তের হারও কমে যাচ্ছে৷ মূলত সরকার ও বেসরকারি সহায়তায় এসেছে সাফল্য৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
ঘাতক রোগ ম্যালেরিয়া
ম্যালেরিয়া পৃথিবীজুড়ে এখনো একটি ঘাতক রোগ হিসেবে পরিচিত৷ বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ার কারণে প্রাণ হারান৷ জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, ২০১০ সালে ২১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল, এর মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার মৃত্যুবরণ করে৷ মৃতের এই সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে অবশ্য তথ্যের ভিন্নতা রয়েছে৷
ছবি: Paula Bronstein/Getty Images
বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া
বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দশ বছর আগে সারা দেশে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ আক্রান্ত হত ম্যালেরিয়ায় এবং মারা যেত প্রায় পাঁচশ৷ তবে ২০০৭ সাল থেকে ম্যালেরিয়া শনাক্ত ও চিকিৎসা সুবিধা বাড়ায় এই রোগে মৃত্যুহার যেমন কমেছে, তেমনি রোগের বিস্তারও নিয়ন্ত্রণ করা গেছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Getty Images
সমন্বিত উদ্যোগে সাফল্য
মূলত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে৷ বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি বেশি৷ তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ও বনাঞ্চল সহ সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ এখনো পুরোপুরি দূর করা যায়নি৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Paula Bronstein/Getty Images
কীটনাশকযুক্ত মশারি
ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে এখন ভালো ভূমিকা রাখছে কীটনাশকযুক্ত মশারি৷ আগে এসব মশারি ধোয়া নিয়ে যে জটিলতা ছিল তাও দূর হয়েছে৷ ‘লাইফ-নেট’ নামক এক ধরনের মশারি তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা, যার কৃত্রিম তন্তুতেই ঢোকানো থাকে কীটনাশক৷ এই মশারি ধোয়াও যায় নিশ্চিন্তে৷ আর মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে সেরা উপায় আজও মশারি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ম্যালেরিয়ার টিকা
তবে ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচার সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো টিকা তৈরি করা৷ সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর গবেষণার পর সম্প্রতি একটি টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মানুষের শরীরে রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম৷ ব্রিটিশ ওষুধ কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বা জিএসকে-র আশা, তাদের এই টিকা ২০১৫ সালের মধ্যে সর্বত্র ব্যবহৃত হবে৷
ছবি: Reuters
নতুন আশঙ্কা
ম্যালেরিয়ার টিকা আবিষ্কার যেমন আশার কথা শোনাচ্ছে তেমনি নতুন ধরনের ম্যালেরিয়ার খবর জাগাচ্ছে শঙ্কা৷ ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকা সম্প্রতি এক রিপোর্টে নতুন ধরনের ম্যালেরিয়া জীবাণুর কথা জানিয়েছে৷ জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের বরাতে পত্রিকাটি জানায়, ভৌগলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন ধরনের ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিজ্ঞানীদের সাফল্য
বিজ্ঞানীরাও থেমে নেই৷ ম্যালেরিয়া সৃষ্টিকারী এমন একটি প্রোটিন বা এনজাইমের সন্ধান তাঁরা পেয়েছেন, যার চক্র থামানো গেলে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ বা নির্মূল করা সম্ভব৷ ঐ এনজাইমের নাম ফসফেটিডাইলিনোজাইটল-ফোর-কাইনাস বা পিআইফোরকে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: DW/G. Manco
জার্মানিতেও উপদ্রব
জার্মানিতেও ম্যালেরিয়া নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে জার্মান মশারাও৷ মারাত্মক জীবাণু বহন করছে তারা৷ বিভিন্ন দেশের মশারা পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের সাথে জার্মানিতে চলে আসে৷ কিছুদিন তারা বেঁচেও থাকে৷ তারপর আবার শীত এলে বিলীন হয়ে যায়৷
সফটওয়্যার জায়ান্ট মাইক্রোসফটের চেয়ারম্যান বিল গেটস মনে করেন, বিশ্বে ইন্টারনেট সংযোগ বৃদ্ধির চেয়ে বেশি জরুরি ম্যালেরিয়া নিরাময়৷ সম্ভবত তিনি চাচ্ছেন, বিশ্বের বিত্তশালীরা ইন্টারনেটের প্রসারের পাশাপাশি এই বিষয়টির দিকেও মনোযোগ দিক৷ গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিল গেটস এবং তাঁর স্ত্রী বিভিন্ন দেশে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
সব জায়গায় নেওয়া যায়
পরীক্ষাটি ব্যাটারিচালিত যন্ত্রে চালানো যায় বলে সব জায়গায় বহন করে নেওয়া যায়৷ ভবিষ্যতে বছরে ২০০,০০০ পর্যন্ত মানুষের ম্যালেরিয়া নির্ণয়ের কাজ লাগবে যন্ত্রটি৷ ‘‘এই পদ্ধতিটি দ্রুত ও নিশ্চিতভাবে ম্যালেরিয়া শনাক্ত করতে সক্ষম৷ এটি চালানোর জন্য খুব বেশি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না৷'' বলেন বাল্টিমোরের জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ম্যালেরিয়া গবেষক ডেভিড সালিভ্যান৷
প্রতিটি পরীক্ষার জন্য খরচ পড়ে মাত্র ৫০ সেন্টের মতো৷ যে কোনো জায়গায় পরীক্ষা করা যায় বলে ল্যাবরেটরি ও কর্মীর খরচও বাঁচে৷ এছাড়া এই পদ্ধতিতে রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয় না বলে কষ্টকরও নয়৷ ইঁদুরের ওপর সফল পরীক্ষা চালিয়ে ২০১৪ সালের প্রথম থেকে মানুষের ওপরও পরীক্ষা চালানো হচ্ছে৷
বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ
এটি সফল হলে ম্যালেরিয়া দমনে এক বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ রাখা হবে৷ ম্যালেরিয়া নির্ণয়ে এখনকার পদ্ধতি পুরোপুরি সঠিক নয়, সময় ও ব্যয়সাপেক্ষও৷ আগামী দেড় বছরে মধ্যে প্রথম পরীক্ষাসিরিজ সম্পন্ন হবে৷ এরপর লাপোটকোর যন্ত্রটি কার্যক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যাবে৷
লেজার প্রযুক্তি অনেকের মনে ভীতির সৃষ্টি করতে পারে৷ গবেষক লাপোটকো এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমাদের যন্ত্রটি অত্যন্ত নিরাপদ৷ এর মাধ্যমে মানুষের ত্বক বা রক্তের সেল ক্ষতিগ্রস্ত হবে না৷ মানুষ কোনো ব্যথা বা ভয়ভীতিও অনুভব করবে না৷''