মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোগ নির্ণয় খুব একটা সহজ নয়৷ এতে যে শুধু অনেক সময় লাগে তাই নয়, প্রচুর অভ্যাসেরও প্রয়োজন৷ তবে জার্মান বিজ্ঞানীরা এবার এমন এক যন্ত্র বানিয়েছেন যা ম্যালেরিয়া রোগ নির্ণয়ে সহায়ক হতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউট ফর ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটস একটি স্বয়ংক্রিয় মাইক্রোস্কোপের আদিরূপ নির্মাণ করেছে, যেটা ম্যালেরিয়া রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হতে পারে৷ পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই৷ এক্ষেত্রে মাইক্রোস্কোপ সম্বলিত একটি সাদা বাক্স কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করা হয় এবং যিনি রোগটি পরীক্ষাটি করবেন, তাঁর কাজ হলো একটি কার্টিজে ১০টি স্লাইড স্থাপন করা৷
ফ্রাউনহোফার ফিউচার ফাউন্ডেশনের ম্যালেরিয়া প্রকল্পের প্রধান আন্দ্রেয়াস রাইমান ডয়চে ভেলেকে জানান যে, এভাবে সিস্টেমটি স্লাইডগুলো স্ক্যান করে একসঙ্গে৷
জার্মানির বন শহরে ইউনিভার্সিটি ক্লিনিকের এক মেডিকেল টেকনিকাল সহযোগী সাবিনে নাক্টসহাইম জানিয়েছেন, সাধারণ পদ্ধতিতে কোনো রোগীর দেহে ম্যালেরিয়া আছে সন্দেহ হলে তাঁর শরীর থেকে রক্ত নিয়ে সেই রক্তে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে রঞ্জিত করা হয় এবং স্লাইডে রেখে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা হয়৷
রোগীর রক্তে যদি ম্যালেরিয়া পরজীবী থেকে থাকে, তবে কালো বেগুনি রঙের কিছু স্পট বা দাগ দেখা যায়৷ তবে এগুলি খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন৷ সাধারণ মাইক্রোস্কোপে এভাবে পরজীবী খুঁজে বের করায় অভ্যস্ত না হলে খুব সহজে তা দৃশ্যমান হয় না৷ এ কারণে সবাই এই পরীক্ষা করতে পারেন না৷ খুব কম সংখ্যক মানুষই জানেন সঠিকভাবে ম্যালেরিয়ার জীবাণু নির্ণয় পদ্ধতি৷ এমনকি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ইনস্টিটিউটগুলিও এই রোগ নির্ণয়ের জন্য সুদূর আফ্রিকা থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসে, জানান আন্দ্রেয়াস রাইমান৷
ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য
সাম্প্রতিক সময়ে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে আশানুরুপ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ৷ ফলে মৃত্যুহার কমার পাশাপাশি, আক্রান্তের হারও কমে যাচ্ছে৷ মূলত সরকার ও বেসরকারি সহায়তায় এসেছে সাফল্য৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
ঘাতক রোগ ম্যালেরিয়া
ম্যালেরিয়া পৃথিবীজুড়ে এখনো একটি ঘাতক রোগ হিসেবে পরিচিত৷ বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ার কারণে প্রাণ হারান৷ জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, ২০১০ সালে ২১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল, এর মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার মৃত্যুবরণ করে৷ মৃতের এই সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে অবশ্য তথ্যের ভিন্নতা রয়েছে৷
ছবি: Paula Bronstein/Getty Images
বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া
বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দশ বছর আগে সারা দেশে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ আক্রান্ত হত ম্যালেরিয়ায় এবং মারা যেত প্রায় পাঁচশ৷ তবে ২০০৭ সাল থেকে ম্যালেরিয়া শনাক্ত ও চিকিৎসা সুবিধা বাড়ায় এই রোগে মৃত্যুহার যেমন কমেছে, তেমনি রোগের বিস্তারও নিয়ন্ত্রণ করা গেছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Getty Images
সমন্বিত উদ্যোগে সাফল্য
মূলত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে৷ বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি বেশি৷ তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ও বনাঞ্চল সহ সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ এখনো পুরোপুরি দূর করা যায়নি৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Paula Bronstein/Getty Images
কীটনাশকযুক্ত মশারি
ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে এখন ভালো ভূমিকা রাখছে কীটনাশকযুক্ত মশারি৷ আগে এসব মশারি ধোয়া নিয়ে যে জটিলতা ছিল তাও দূর হয়েছে৷ ‘লাইফ-নেট’ নামক এক ধরনের মশারি তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা, যার কৃত্রিম তন্তুতেই ঢোকানো থাকে কীটনাশক৷ এই মশারি ধোয়াও যায় নিশ্চিন্তে৷ আর মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে সেরা উপায় আজও মশারি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ম্যালেরিয়ার টিকা
তবে ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচার সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো টিকা তৈরি করা৷ সুদীর্ঘ ত্রিশ বছর গবেষণার পর সম্প্রতি একটি টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মানুষের শরীরে রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম৷ ব্রিটিশ ওষুধ কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বা জিএসকে-র আশা, তাদের এই টিকা ২০১৫ সালের মধ্যে সর্বত্র ব্যবহৃত হবে৷
ছবি: Reuters
নতুন আশঙ্কা
ম্যালেরিয়ার টিকা আবিষ্কার যেমন আশার কথা শোনাচ্ছে তেমনি নতুন ধরনের ম্যালেরিয়ার খবর জাগাচ্ছে শঙ্কা৷ ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকা সম্প্রতি এক রিপোর্টে নতুন ধরনের ম্যালেরিয়া জীবাণুর কথা জানিয়েছে৷ জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের বরাতে পত্রিকাটি জানায়, ভৌগলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন ধরনের ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিজ্ঞানীদের সাফল্য
বিজ্ঞানীরাও থেমে নেই৷ ম্যালেরিয়া সৃষ্টিকারী এমন একটি প্রোটিন বা এনজাইমের সন্ধান তাঁরা পেয়েছেন, যার চক্র থামানো গেলে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ বা নির্মূল করা সম্ভব৷ ঐ এনজাইমের নাম ফসফেটিডাইলিনোজাইটল-ফোর-কাইনাস বা পিআইফোরকে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: DW/G. Manco
জার্মানিতেও উপদ্রব
জার্মানিতেও ম্যালেরিয়া নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে জার্মান মশারাও৷ মারাত্মক জীবাণু বহন করছে তারা৷ বিভিন্ন দেশের মশারা পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের সাথে জার্মানিতে চলে আসে৷ কিছুদিন তারা বেঁচেও থাকে৷ তারপর আবার শীত এলে বিলীন হয়ে যায়৷
সফটওয়্যার জায়ান্ট মাইক্রোসফটের চেয়ারম্যান বিল গেটস মনে করেন, বিশ্বে ইন্টারনেট সংযোগ বৃদ্ধির চেয়ে বেশি জরুরি ম্যালেরিয়া নিরাময়৷ সম্ভবত তিনি চাচ্ছেন, বিশ্বের বিত্তশালীরা ইন্টারনেটের প্রসারের পাশাপাশি এই বিষয়টির দিকেও মনোযোগ দিক৷ গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিল গেটস এবং তাঁর স্ত্রী বিভিন্ন দেশে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
বলা বাহুল্য, এ সব অভাবই এবার পূরণে করতে যাচ্ছে জার্মানির ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউটের তৈরি ১০ স্লাইড বিশিষ্ট নতুন যন্ত্রটি, যা কিনা স্লাইডগুলো উপর-নীচে নড়াচড়া করতে পারে৷ তাছাড়া এ সময় মাইক্রোস্কোপের অণুবীক্ষণ যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে টার্গেট এলাকাগুলোর দিকে নজর দেয়৷ কী ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে তার ছবি তুলতে থাকে ক্যামেরা এবং কম্পিউটার মেমোরিতে সেই তথ্যগুলো জমা রাখে সঙ্গে সঙ্গে৷ তারপর অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে ম্যালেরিয়া পরজীবীর ছবির সাথে মিল আছে এমন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন স্লাইডগুলো খুঁজে বের করে যন্ত্রটি, ফলে সহজেই সম্ভব হয় রোগ নির্ণয়৷ শুধু তাই নয়, পরজীবীর সংখ্যা কম না বেশি – তাও বের করে দিতে পারে এ যন্ত্রটি৷ পরে অবশ্য একজন চিকিৎসককে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়৷
এই পদ্ধতির সুবিধা হলো ডিজিটাল যেসব ছবি এভাবে তোলা হবে, তা অন্য দেশের বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়ে রোগ নির্ণয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে৷ এতে সময়ও বাঁচবে অনেক৷ বলা বাহুল্য, এই পদ্ধতিতে আফ্রিকার ম্যালেরিয়া কেন্দ্রগুলোতে খুব সহজেই রোগ নির্ণয় করা যাবে৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল ম্যালেরিয়া প্রোগ্রাম-এর কো-অর্ডিনেটর আন্দ্রেয়া বসমান বলেছেন, ইউরোপ ও অ্যামেরিকায় যথেষ্ট ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ নেই৷ তাই তাঁর মতে, নতুন এই পদ্ধতিটি আফ্রিকায় ম্যালেরিয়া নির্ণয়ে এবং ভ্যাকসিনেশনে বেশ সাহায্য করবে৷