যক্ষ্মা রোগকে এককালে বলা হত রাজরোগ৷ যক্ষ্মা রোগের একমাত্র টিকার বয়স ১০০ পার হতে চলেছে৷ তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি গবেষণা প্রকল্পে একটি নতুন, ‘জীবন্ত’ টিকা তৈরি নিয়ে কাজ চলেছে৷
বিজ্ঞাপন
যক্ষ্মার নতুন টিকা তৈরির চেষ্টা
04:25
স্পেনের উত্তরে একটি হাসপাতালে এমন একটি রোগের চিকিৎসা করা হয়, যা বস্তুত ইউরোপ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে – অথবা যাবার কথা৷
যক্ষ্মা রোগী আলফ্রেদো কাবালেইরো বেসাদা বলছিলেন, ‘‘যক্ষ্মা ধরা পড়ার পরে আমার শুধু দু'টো উপায় ছিল: হয় বহুদিন ধরে হাসপাতালের কামরায় বদ্ধ থাকা, যেখানে মানুষজনকে বিশেষ মুখোশ পরে আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে; নয়তো বাড়িতে একা একা থাকা আর চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন হাসপাতালে এসে একজন নার্সের উপস্থিতিতে একটি ইনজেকশন নেওয়া ও ২২ রকম ওষুধের বড়ি খাওয়া৷ আমি দ্বিতীয় পন্থাটাই বেছে নিই৷ তবে বাড়ির বাইরে, যেমন রুটির দোকান কিংবা অন্য কোথাও যেতে হলে আমাকে মুখোশ পরে যেতে হয়৷’’
যক্ষ্মার সঙ্গে লড়তে ‘নায়ক ইঁদুর’!
ফসলের ক্ষতি করে বলে ‘ইঁদুর নিধন অভিযান’-এর কথা আমরা হামেশাই শুনি৷ কিন্তু মানুষের যক্ষ্মা রোগ সারাতে ইঁদুরের সহায়তা নেয়া হয়, তা কি শুনেছেন? তানজানিয়ায় কিন্তু এমন কাণ্ডই চলছে৷
ছবি: APOPO
চিনে নিন নায়ক ইঁদুরকে
টিউবারকুলোসিস, অর্থাৎ টিবি বা যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ে সহায়তার জন্য বেলজিয়ান বেসরকারি সংস্থা আপোপো বিশেষ প্রজাতির ইঁদুরের প্রজনন করাচ্ছে৷ আফ্রিকার এই ধরনের ইঁদুরের নাম দেয়া হয়েছে ‘গিলবার্ট’৷ তানজানিয়ার মোরোগোরো শহরের পরীক্ষাগারে এক চৌকোনা খাঁচায় মানুষের থুথুর নমুনা রাখা হয়৷ গিলবার্টরা গন্ধ শুঁকেই জানিয়ে দেয় থুথুতে সংক্রমণ হয়েছে কিনা৷ এমন চল্লিশটি ‘নায়ক ইঁদুর’ আছে সেই পরীক্ষাগারে৷
ছবি: Jeroen van Loon
ইঁদুরেরও চাই প্রেরণা
সংক্রমণ সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে এমন থুথুর নমুনায় গিলবার্ট যতবার তার সামনের থাবা দিয়ে আঁচড় কাটে, ততবারই তাকে পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয় কলা আর মটরশুঁটি মেশানো খাবার৷ খাবার পেলে নতুন উদ্যমে আবার কাজ শুরু করে গিলবার্ট৷
ছবি: Jeroen van Loon
গিলবার্টরা আরো জানে...
শুধু যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়েই নয়, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা এবং কম্বোডিয়ার মতো দেশে ভূমি মাইন খুঁজে বের করায় সহায়তার জন্যও গিলবার্টদের কাজে লাগায় আপোপো৷ সামান্য এক ইঁদুরের সহায়তা নিয়ে শুধু মোজাম্বিকেই ২ হাজার ৫৮৭টি ভূমি মাইন খুঁজে বের করে ধ্বংস করা হয়েছে৷ এছাড়া এক হাজারেরও বেশি এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস আর প্রায় ১৩শ আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদেরও সন্ধান দিয়েছে এই ইঁদুর৷
ছবি: Jeroen van Loon
পয়সা উসুল...
আফ্রিকার এই ইঁদুরের ঘ্রাণশক্তি ভীষণ তীক্ষ্ম৷ অন্যান্য ইঁদুরের তুলনায় এরা বেশ শান্ত স্বভাবের৷ প্রতিটি ইঁদুরের প্রশিক্ষণের পেছনে গড়ে ৬শ ইউরোর মতো খরচ হয়৷ তাতে কী! এ ইঁদুর আট বছর বাঁচে৷ এদের পোষ মানানো সহজ, পুষতে তেমন কোনো ঝামেলাও নেই৷ সবচেয়ে বড় কথা, কুকুরকে যেমন একজন প্রশিক্ষক দিয়েই সব শেখাতে হয়, গিলবার্টদের তেমন বায়নাক্কাও নেই৷
ছবি: Jeroen van Loon
জন্ম থেকেই শুরু
আপোপো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের জায়গাতেই ইঁদুরের প্রজনন করায়৷ সংস্থাটি বুনো ইঁদুর পেলেই তাদের দিয়ে শুরু করে বংশ বৃদ্ধির কাজ৷ বাচ্চা ইঁদুর জন্মের পর চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় প্রশিক্ষণ৷
ছবি: Jeroen van Loon
গিলবার্ট যেভাবে বাঁচায়
সাভেরা কম্বা-র কাশি আর সারছিলই না৷ শরীরের ওজন কমে যাচ্ছিল৷ সবসময় ক্লান্ত লাগতো৷ হাসপাতালে ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, যক্ষ্মা হয়নি৷ অগত্যা থুথুর নমুনা পাঠানো হলো৷ গিলবার্ট শুঁকেই জানিয়ে দিল, যক্ষ্মা হয়েছে৷ যেন নতুন জীবন পেলেন তিনি৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)-র এক সমীক্ষা অনুযায়ী শুধু ২০১২ সালেই সারা বিশ্বে যক্ষ্মায় মারা গেছে ১৩ লাখেরও বেশি মানুষ৷সাভেরাকে বাঁচিয়েছৈ ইঁদুর৷
ছবি: Jeroen van Loon
নিশ্চিত হওয়া
হাসপাতালের পরীক্ষায় যক্ষ্মা ধরা পড়েনি, কিন্তু ইঁদুরের নাসিকায় ধরা পড়েছে, রোগীদের এমন থুথু আবার পরীক্ষা করে দেখছেন আপোপো ল্যাব-এর প্রশিক্ষিত কর্মীরা৷ পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর রোগীকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতে বলা হবে৷
ছবি: Jeroen van Loon
চটপটে গিলবার্ট
আপোপো-র ইঁদুরগুলোর বিশেষত্ব কী জানেন? ওরা খুব দ্রুত কাজ করে৷ ল্যাবরেটরিতে একজন মানুষ সারাদিনে যতগুলো থুথুর নমুনা পরীক্ষা করতে পারে গিলবার্ট তা করে ফেলে মাত্র সাত মিনিটে৷ যক্ষ্মা হওয়ার ঝুঁকি বেশি এমন সব জায়গা, যেমন শরণার্থী শিবির বা কয়েদখানায় ইঁদুর দিয়ে পরীক্ষা করালে মন্দ কি!
ছবি: Jeroen van Loon
চিকিৎসা শুরু
সাভেরা কম্বার ওজন এখনো মাত্র ৩৯ কেজি৷ তবে ওষুধ খেতে শুরু করার পর থেকে শারীরিক অবস্থার উন্নতি নিজেই বুঝতে পারছেন, তাই খুব খুশি মনেই ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘ইঁদুর না থাকলে আমি হয়ত মারাই যেতাম!’’
ছবি: Jeroen van Loon
তবু স্বীকৃতি নেই
ইঁদুর দিয়ে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের এই পদ্ধতিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো স্বীকৃতি দেয়নি৷ গত বছর তানজানিয়ায় মোট ১৭শ রোগীর সুচিকিৎসা সম্ভব হয়েছে প্রশিক্ষিত ইঁদুরদের কল্যাণে৷ আপোপো তাই ডাব্লিউএইচও-র স্বীকৃতির আশায় বসে নেই৷ তানজানিয়ার পর মোজাম্বিকেও একটি যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় কেন্দ্র খুলেছে৷ ভবিষ্যতে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এমন পরীক্ষাগার চালু করার পরিকল্পনা আছে আপোপোর৷
ছবি: Jeroen van Loon
10 ছবি1 | 10
যক্ষ্মা রোগে পৃথিবীতে বছরে ১৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারান৷ শুধুমাত্র ইউরোপেই প্রতি বছর এক লাখ নতুন যক্ষ্মা রোগের ঘটনা ধরা পড়ে৷ ফুসফুস বিশেষজ্ঞ রাফায়েল ভাস্কেস জানালেন, ‘‘যক্ষ্মা রোগে ফুসফুস ঝাঁঝরা হয়ে যায়৷ রক্তচলাচলের ফলে যক্ষ্মা রোগ ফুসফুস থেকে শরীরের অন্যান্য অংশে, যেমন মস্তিষ্ক কিংবা হাড়ে বা যেখানেই রক্ত প্রবাহিত হয়, সেখানে ছড়িয়ে পড়তে পারে৷’’
হাসপাতালের কাছে এই বায়ো-ফার্মাসিউটিক্যাল ল্যাবরেটরিতে যক্ষ্মা রোগ নিয়ে গবেষণা চলেছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পটিতে বিজ্ঞানীরা যক্ষ্মা রোগের নাটকীয় ফলশ্রুতির মোকাবিলা করার চেষ্টা করছেন৷
সারাগোসা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্ট কার্লোস মার্তিন বললেন, ‘‘আশির দশকের গোড়ায় আমি যখন ডাক্তারির ছাত্র ছিলাম, তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন ২০০০ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূল করার কথা ভাবছিল৷ এখন বিশেষজ্ঞরা যক্ষ্মা নির্মূল করার সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে ২০৫০ সালের কথা বলছেন৷ কিন্তু সেজন্য আরো তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা করতে হবে; ওষুধ প্রতিরোধের ক্ষমতা সম্পন্ন নতুন ধরনের যক্ষ্মার জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ ও টিকার ব্যবস্থা করতে হবে৷’’
নতুন টিকা
প্রকল্পের প্রথম ফল হলো একটি নতুন টিকা, যা এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিতে তৈরি করা হয়েছে৷ এই নতুন টিকা যক্ষ্মা রোগেরএকমাত্র পরিচিত টিকার মতো নয় – সে টিকার বয়সও আজ ১০০ পার হয়েছে! নতুন টিকাটি যক্ষ্মা রোগের জীবাণুর একটি দুর্বলতর সংস্করণ৷ এই নতুন টিকা আরো বেশি নিরাপদ ও কার্যকর হবে বলে গবেষকদের আশা৷
সবচেয়ে বেশি যক্ষ্মা রোগীর দেশ ভারত
আগে বলা হতো ‘যার হয় যক্ষ্মা, তাঁর নাই রক্ষা’৷ যক্ষ্মা এখন চিকিৎসাযোগ্য৷ অনেক দেশ থেকেই এই রোগ প্রায় নিশ্চিহ্ন৷ তবে ভারতে যক্ষ্মার রোগী এখনো খুব বেশি৷ সবচেয়ে বেশি যক্ষ্মা রোগীর দেখা তাই মিলবে ভারতেই৷
ছবি: imago
সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ কম কার্যকর
দুই সপ্তাহের বেশি সর্দি-কাশি? তাহলে ধরে নিতে হবে আপনার টিবি বা যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা আছে৷ এ কথা জানিয়ে নাগরিকদের সতর্ক করার চেষ্টা কয়েক বছর আগেই শুরু করেছে ভারত সরকার৷ কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না৷ দেশে যক্ষ্মা রোগী বেড়েই চলেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রোগী বাঁচাতে গিয়ে সেবিকার মৃত্যু
পশ্চিমবঙ্গের সিউড়ির এক হাসপাতালের একটি খবর কয়েকদিন আগে সংবাদ শিরোনামে এসেছিল৷ হাসপাতালটি যক্ষ্মা রোগীদের জন্যই বিশেষায়িত, অথচ সেখানে রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে এক নার্সই মারা গেলেন যক্ষ্মায় ভুগে৷ এমন খবর সংবাদমাধ্যমের নজর তো কাড়বেই!
নার্সের যক্ষ্মায় ভুগে মৃত্যু ওই হাসপাতালকে এতটাই আলোচনায় এনেছে যে, সব ত্রুটি-বিচ্যূতিই উঠে আসছে সংবাদমাধ্যমে৷ হাসপাতালে বিড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে – এমন ছবিও প্রকাশ করছে সংবাদমাধ্যমগুলি৷
ছবি: C. Khanna/AFP/Getty Images
ছুটিতে গেলে আর ফেরে না...
১২০’শ শয্যার ওই হাসপাতালটির এক কর্মী জানিয়েছেন, যক্ষ্মার ভাইরাসে সংক্রমিত বেশ কয়েকজন কর্মী অসুস্থতার কারণে ছুটি নিয়ে বাড়িতে গিয়ে আর ফেরেননি৷ তাঁরা বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তা জানে না৷
ছবি: C. Khanna/AFP/Getty Images
সব সরকারি হাসপাতালের অবস্থা এক
ভারতের সব সরকারি হাসপাতালের অবস্থাই প্রায় এক৷ সিউড়ির হাসপাতালটির মতো অ্যান্যান্য যক্ষ্মা হাসপাতালেও চিকিৎসক, নার্স এবং রোগীসহ সবাই কোনো ‘মাস্ক’ না পরেই ঘুরে বেড়ান৷ বেশির ভাগ সরকারি হাসপাতালই অপরিচ্ছন্ন৷ অথচ যক্ষ্মা হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রাখা তো বটেই, সেখানে সবার মাস্ক পরাটাও জরুরি৷
ছবি: DW/B. Das
6 ছবি1 | 6
ফার্মাকোলজিস্ট মারিয়া ইউগেনিয়া পুয়েন্তেস বললেন, ‘‘টিকা তৈরির জন্য যক্ষ্মা রোগের জীবন্ত জীবাণু ব্যাপক হারে উৎপাদন করাটা সহজ নয়৷ এটা এমন এক মাইক্রো-অর্গানিজম, যা খুব ধীরে ধীরে বাড়ে৷ তা নিয়ে টিকা তৈরির জন্য এক থেকে দু'মাস অপেক্ষা করতে হয়৷ এছাড়া আমরা একটি ‘জীবন্ত’ টিকার কথা বলছি৷ সে টিকা বাস্তবিক কর্মক্ষম হওয়ার জন্য উৎপাদন প্রক্রিয়া চলাকালীন জীবাণুগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সজীব রাখতে হবে৷’’
ভিগো থেকে ১,৮০০ কিলোমিটার দূরে, সুইজারল্যান্ডের লোসান শহরে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে প্রথম ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ শুরু হয়েছে৷ দেখা হচ্ছে, টিকাটা কতোটা নিরাপদ এবং দেহের যে অণুগুলি আমাদের যক্ষ্মা থেকে বাঁচায়, সেগুলি এই টিকার ফলে সক্রিয় হচ্ছে কিনা৷
ইমিউনোলজিস্ট ফ্রঁসোয়া স্পের্তিনির মতে, ‘‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম পর্যায়ে আমরা যদি দেখাতে পারি যে, স্বেচ্ছাসেবীদের দেহে এই রক্ষাকারী অণুগুলি রয়েছে, তাহলে খুব ভালো হয়৷ তার মানে, বাস্তব রোগীদের ক্ষেত্রে যাদের এই অণুগুলি আছে, তারা অধিকতর সুরক্ষা পাবেন৷ আমরা সেটাই নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি৷’’
বৈজ্ঞানিক বৈধতা পাবার জন্য নতুন টিকাকে তিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পাস হতে হবে৷ তার দশ বছরের মধ্যেই বাজারে ছাড়ার জন্য টিকা তৈরির কাজ শুরু হতে পারবে বলে গবেষকদের আশা৷