1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যত ধাপ তত ঘুস

১৬ জানুয়ারি ২০১৮

ঘুস অনেকটাই যেন সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে বাংলাদেশে৷ টিআইবি'র এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন সেবা পেতে বছরে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা ঘুস দিতে হয় সাধারণ মানুষকে৷ তবে ৯০ ভাগ মানুষ ঘুসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চান৷

Symbolbild Bestechung und Korruption in Bengali
ছবি: Privat

দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি অমিতোষ পাল৷ ঘুস নিয়ে তিনি একাধিক আলোচিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন৷ বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের ঘুস বাণিজ্য নিয়ে তার প্রতিবেদনগুলো আলোচিত৷ 
‘‘সিটি কর্পোরেশনের যে কোনো কাজে ঠিকাদারকে কাজ পাওয়া থেকে শুরু করে বিল নেয়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে ঘুস দিতে হয়৷ যত ধাপ তত ঘুস৷ এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে৷'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷
‘‘একটি সড়কের কাজের শুরু হয় দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে৷ আর দরপত্র দাখিলের পর থাকে একটি মূল্যায়ণ কমিটি৷ কাজ পেতে হলে শুরুতেই এই কমিটিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুস দিতে হয়৷ কাজটা পাওয়ার পর যাদের কাজ বা যারা টেন্ডার আহ্বান করেছে সেই নির্বাহী প্রকৌশলীকে টাকা দিতে হয়৷ এরপর ফাইলটি উপরে উঠতে যেসব ধাপ পেরোতে হয় তা হলো, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও মেয়র৷ এই ধাপগুলো পেরিয়ে কার্যাদেশ পাওয়া যায়৷ প্রতিটি ধাপেই টাকা দিতে হয়৷ তবে সৎ কর্মকর্তাও আছেন, যারা ঘুস নেন না৷ যারা নেন না তাঁদের টেবিলের জন্য বরাদ্দ অর্থ বেচে যায়৷''

‘কাজ পাওয়া থেকে শুরু করে বিল নেয়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে ঘুস দিতে হয়’

This browser does not support the audio element.

অমিতোষ পাল জানান, ‘‘কাজটি শেষ হওয়ার পর বা মাঝখানে ঠিকাদারকে বিল পেতে আবার একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়৷ তখন ওই ধাপগুলো ছাড়াও ঘুসের তালিকায় আরো একটি বিভাগ যোগ হয়৷ আর তা হল অ্যাকাউন্টস সেকশন৷ সব মিলিয়ে যদি এক কোটি টাকার কাজ হয় তাহলে তার ৩০ ভাগ মানে ৩০ লাখ টাকা ঘুস হিসেবেই দিতে হয় ঠিকাদারকে৷ এরপর ভ্যাট ট্যাক্স মিলিয়ে দিতে হয় আরো প্রায় ২০ ভাগ৷ ঠিকাদার যদি কমপক্ষে ১০ ভাগও ব্যবসা করেন তাহলে এক কোটি টাকার টেন্ডারে কাজ হয় ৪০ লাখ টাকার৷ কিন্তু ঠিকাদারা ২০ থেকে ৩০ ভাগ লাভ করেন৷ তাই শেষ পর্যন্ত এককোটি টাকার কাজ বাস্তবে হয় ২০-৩০ লাখ টাকার৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘এ কারণেই একটি সড়ক যেখানে পাঁচ বছর টেকার কথা সেখানে তা এক বছরের বেশি টেকে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘সিটি করপোরেশনে একটি কাজে ঠিকাদারদের অন্তত ১৬ ধাপে ঘুস দিতে হয়৷ আর এটা স্বীকৃত৷ আমি এক্সপার্টদের সাথে কথা বলে দেখেছি৷ তারা মনে করেন কাজের এই ধাপগুলো কমিয়ে ঘুসের পরিমাণ হয়তো কমিয়ে আনা সম্ভব৷''
বাংলাদেশে এই সময়ে আলোচিত একটি ঘুসের ঘটনা হল এক থানার একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার৷ গত ২৭ ডিসেম্বর নরসিংদীর মনোহরদী থানার ওসি গাজী রুহুল ইমাম ওই এলাকার ব্যবসায়ী আসলাম শেখের কাছে ঘুস হিসেবে ৬৫ ইঞ্চি এলসিডি টিভি দাবি করেন, যার দাম তিন লাখ ৬৫ হাজার টাকা৷


আসলাম শেখ ও তার ভাই মো. সালাম শেখকে ভুয়া ডাকাতির মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে ঘুস হিসেবে ওই টিভি দাবি করেন ওসি রুহুল ইমাম৷ দাবি অনুযায়ী টেলিভিশন না দেয়ায় পুলিশ পাঠিয়ে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের হেনস্তা করান ওসি৷ এমনকি টেলিভিশন দিলে এলাকাছাড়া করা এবং ডাকাতি মামলায় জেল খাটানোরও হুমকি দেয়া হয়৷
ঘুস হিসেবে টেলিভিশন দাবির ফোনালাপের রেকর্ড সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর অবশ্য ওই ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ভুক্তভোগী আসলাম শেখ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়ে ওসি'র টার্গেটে পরিণত হই৷ এরপর ৬৫ ইঞ্চি টিভি ঘুস হিসেবে দাবির টেলিফোন রেকর্ড সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হলে আমি রক্ষা পাই৷ নয়তো আমাকে মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচতে ওই টিভি দিতেই হত৷ আর ওসিকে প্রত্যাহারের পর এখন অনেক ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে মনোহরদীর অনেকেই মুখ খুলছেন৷ ওসি'র ঘুস আদায়ের নানা কৌশল ও কাহিনী প্রকাশ পাচ্ছে৷''
থানায় ঘুসের অভিজ্ঞতার কথা ডয়চে ভেলেকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী৷ তিনি একটি মামলার বাদী৷ তিনি বলেন, ‘‘নির্মান কাজে চাঁদা দাবির ব্যাপারে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়ে আমার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ প্রথমে মামলা করতে টাকা লেগেছে৷ এরপর আসে আসামি ধরার পালা৷ সেখানেও টাকা ছাড়া পুলিশ আসামি ধরবে না৷ দিলাম টাকা৷ কিন্তু মূল আসামিদের না ধরে এলাকার কয়েকজন নিরীহ লোককে ধরে আনে পুলিশ৷ এবার আমার উল্টো বিপদ৷ তাদের ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলে পুলিশ আমার কাছেও টাকা চায়, আটকদের কাছেও টাকা চায়৷ পরে অবশ্য আটকরা পুলিশকে কিছু দিয়ে ছাড়া পায়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি দেখলাম মামলা করে উল্টো আমিই বিপদে৷ পুলিশ ধীরে ধীরে আসামিদের প্রতি সদয় হয়৷ জানতে পারি, তাদের কাছ থেকেও পুলিশ টাকা নিয়েছে৷ মামলার তদন্ত এগোয় না৷ আমি তদবির করতে গেলে পুলিশ উল্টো বিরক্ত হয়৷ আর একদিন পুলিশ আমাকে আসামিদের ‘এলাকার ছেলে পেলে' বলে সমঝোতা করে নেয়ার প্রস্তাব দেয়৷ তারপর আমি মামলাটি নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি৷''
গড়ে ৯৯ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে সেবা নিতে যান৷ ২০১৬ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশের ১৬টি সেবাখাতে ঘুস নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করে৷ জরিপে দেখা যায়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট ও বিচারিকসহ ১৬টি খাতের সেবা পেতে বছরে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয় সেবা প্রার্থীদের৷
জরিপে অংশ নেয়া নাগরিকদের ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ সেবা পেতে ঘুস দেয়ার কথা জানিয়েছেন৷ আর ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন৷
জরিপটি হয় ২০১৫ সালে৷ জরিপে বলা হয়, জাতীয় প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ ও জিডিপির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ৷ তুলানমূলক চিত্রে বলা হয়, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ১ হাজার ৪৯৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা বেশি ঘুস দিতে হয়েছে সেবা খাতে৷ টিআইবি এরপর আর ঘুসের জরিপ করেনি৷ তবে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই৷
ওই জরিপে আরো বলা হয়, ২০১৫ সালে পাসপোর্ট খাতে সেবা নিতে গিয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি মানুষ ঘুস বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন৷ ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশকে পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে ঘুস দিতে হয়েছে৷ আর পাসপোর্ট অফিসের ১০০ জনের মধ্যে ৭৬ জনই ঘুস নিয়েছেন৷
২০১৫ সালে ভূমি প্রশাসন খাতে প্রায় ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ১ হাজার ৭০২ কোটি , বিদ্যুৎ খাতে ১ হাজার ৬১৩ কোটি, বিচারিক সেবা খাতে ৮০৮ কোটি টাকা ঘুস লেনদেন হয়৷ পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ ঘুসের কবলে পড়লেও এ খাতে ঘুসের পরিমাণগত অবস্থান সপ্তম৷ এ খাতে ঘুস লেনদেন হয়েছে ২৯৫ কোটি টাকা৷ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে হয়েছে ১৯২ কোটি টাকা৷
গড় হিসেবে গ্যাস সংযোগ নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঘুস দিতে হয়েছে৷ প্রতিটি খানায় যার গড় পরিমাণ ২৭,১৬৬ টাকা৷ এছাড়া বিমা খাতে ১৩,৪৬৫ টাকা, বিচারিক সেবায় ৯,৬৮৬ টাকা এবং ভূমি প্রশাসনে ৯,২৫৭ টাকা দিতে হয়েছে৷
দেশে সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা ও ঘুসের পরিমাণ উভয়ই বাড়ছে৷ ঘুস দিতে বাধ্য হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ৷ ঘুসের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ৷ পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি ঘুসের শিকার হন৷ আর শহরের চেয়ে গ্রামে ঘুসের শিকার মানুষের সংখ্যা বেশি৷
টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জরিপে এটাও উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের ৬৭.৮ শতাংশ মানুষ ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন৷ এর মানে হল এখানে ঘুস না দিলে কাজ হয় না৷ সেবা পাওয়া যায় না৷ এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ঘুস বাংলাদেশের অন্যতম সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এরকম হওয়ার অন্যতম কারণ হল ঘুস খেলে বা দিলে যে শাস্তি পেতে হয়, বিচারের মুখোমুখি হতে হয়, এটা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি৷ ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘুস খেয়ে পার পাওয়া যায়৷ সরকারি কর্মচারিদের বেতন বাড়ানোর সময় আশা করা হয়েছিল ঘুসের প্রবণতা কমবে৷ কিন্তু কমেনি৷ আর ঘুস খাওয়ায় সাথে অর্থনৈথিক দুরাবস্থার সম্পর্কও এখানে প্রমাণিত নয়৷ কারণ যে যত বড় পদে থাকেন তিনি তত বেশি ঘুস খান৷''
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘দুর্নীতির ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগসাজশ থাকে৷ এখানে যিনি ঘুস দেন আর নেন উভয়েরর অসৎ স্বার্থ থাকে৷ আর নানা খাতে অর্থ লোপাটের ঘটনা থাকে৷ দুর্নীতিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা মূল ভূমিকা পালন করে৷ কিন্তু ঘুসের ক্ষেত্রে সেটা নাও হতে পারে৷ তবে সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশে ঘুস এখন আর সামাজিকভাবে নিন্দিত নয়৷ এটা অনেক সময় বাহবাও পায়৷ যা ভযাবহ৷''
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঘুস বিরোধী মনোভাব বেশ প্রবল বলেই মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান৷ ‘‘টিআই-এর এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ নিরাপত্তা ও ভরসা পেলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চায়৷''
বিশ্লেষকরা অবশ্য মনে করেন, বাংলাদেশে ঘুস সংস্কৃতি কমে আসার একটি শুভ লক্ষণও দেখা গেছে৷ তা হল যে খাত যতটা বেশি ডিজিটালাইজড হচ্ছে সেই খাতে ঘুস তত কমছে৷ বাংলাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টারগুলো থেকে মানুষকে সেবা পেতে তেমন ঘুস দিতে হয় না৷ তাই ঘুস বন্ধে বিভিন্ন সেবা খাততে দ্রুত জিজিটাল করার পরামর্শ দিয়েছেন টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক৷

‘যে যত বড় পদে থাকেন তিনি তত বেশি ঘুস খান’

This browser does not support the audio element.

‘থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়ে ওসি'র টার্গেটে পরিণত হই’

This browser does not support the audio element.


আপনি কি কখনো ঘুস দিতে বাধ্য হয়েছেন? মন্তব্য করুন নিচের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ