বেলজিয়ামে মার্সি কিলিং বা যন্ত্রণামুক্তির জন্য স্বেচ্ছামৃত্যু আইনসিদ্ধ৷ এখন মরণাপন্ন বাচ্চা রোগীরাও যাতে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিতে পারে সে ব্যাপারে তর্ক বিতর্ক চলছে দেশটিতে৷
বিজ্ঞাপন
যে সব বাচ্চা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, ব্যথা বেদনায় কাতর তাদের কেন বড়দের মতো মৃত্যু বরণ করার সুযোগ দেওয়া হবে না? এই প্রশ্ন করেন ব্রাসেলসের মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্সি কিলিং সংক্রান্ত গবেষণা গ্রুপের প্রফেসর ইয়ান ব্যার্নহাইম৷
‘‘কঠিন রোগে আক্রান্ত শিশুরা অবাক করার মতো স্পষ্ট চিন্তা ভাবনা করতে পারে৷ ক্যালেন্ডারের বয়সের চেয়ে তারা যেন অনেক বেশি পরিণত৷ মানসিক দিয়ে দিয়ে তারা অনেক বেশি পরিপক্ক ও বয়স্ক৷ মৃত্যুর ইচ্ছা প্রকাশ করলে এই সব বাচ্চাদের সাহায্য করার পক্ষে শিশু চিকিৎসকদের অধিকাংশই'', ডয়চে ভেলেকে জানান ক্যানসার গবেষক ব্যার্নহাইম৷
‘শিশু কাঁদলে, তাকে কোলে তুলে নিন’
বাচ্চা কাঁদলে কোলে তুলে নেয়াটাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে উপ-মহাদেশের বাবা-মা এবং পরিবারের মানুষদের কাছে৷ এ নিয়ে তাঁদের মনে কোনো প্রশ্ন নেই৷ কিন্তু জার্মানিতে? চলুন বিস্তারিত জানা যাক এই ছবিঘর থেকে৷
ছবি: Fotolia/st-fotograf
শিশুরা কাঁদে কেন?
যে কোনো শিশুই চিৎকার করে কেঁদে তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর জানিয়ে দেয়৷ তারপরও কারণে-অকারণেই ওরা কাঁদে৷ এই সুন্দর ভুবনের সাথে মানিয়ে নিতে ওদের যেমন কিছুটা সময় লাগে, তেমনই নতুন মা-বাবারও লাগে খানিকটা সময় সব কিছু গুছিয়ে নিতে৷ যা খুবই স্বাভাবিক৷
ছবি: Fotolia/S.Kobold
আমার কান্না কেউ কি শুনছে না?
মাঝে মাঝে শিশুরা চিৎকার করে ওঠে, বিশেষ করে কাছাকাছি অনেকক্ষণ কোনো শব্দ শুনতে না পেলে৷ অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই হয়ত তখন কাঁদে তারা৷ মজার ব্যাপার, ঐ মুহূর্তে কেউ কাছে গিয়ে কথা বললে বা কোলে তুলে নিলে সাথে সাথেই শিশুদের কান্না থেমে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাঙালি বাবা-মায়ের সন্তান
দেশে সন্তান জন্মের পর থেকেই সে বাচ্চা কোলে কোলে থাকে৷ বাচ্চা কাঁদুক আর না কাঁদুক৷ নতুন মা সারাক্ষণই তাঁর শিশুটিকে নিয়ে ব্যস্ত আর সেই শিশু সর্বক্ষণই পেয়ে থাকে মায়ের শরীরের উষ্ণতা৷ শিশুকে কোলে নেওয়ার জন্য বাবা-মা ছাড়াও আত্মীয়স্বজন থাকেন৷ এছাড়া, বাচ্চাকে শুধু দেখাশোনা করার জন্য আলাদা লোকও অনেক সময় রাখা হয়৷
ছবি: picture-alliance/Joker
জার্মান শিশু
জার্মানিতে কোনো শিশু কাঁদলেই চট করে কোলো তুলে নেওয়া হতো না কয়েক বছর আগ পর্যন্তও৷ শিশু কাঁদলে ওকে শুইয়ে রাখা হতো৷ এক সময় সেই ছোট্ট শিশু কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পরতো৷ কারণ, মা সারাক্ষণ বাচ্চাকে কোলো নিলে বাড়ির অন্য কাজ কে করবে? রাতে প্রতিদিন ঘড়ি ধরে একই সময়ে বাচ্চাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হতো ঘর অন্ধকার করে৷ বলা বাহুল্য জার্মানিতে গ্রীষ্মকালে প্রায় ১১টা পর্যন্ত বাইরে সূর্যের আলো থাকে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Timothy Clary
সময় পাল্টেছে, বদলেছে চিন্তাধারা
একদিকে যেমন জার্মানির মতো উন্নত দেশগুলিতে প্রযুক্তি দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশেরও কিছু বিষয় গ্রহণ করতে শুরু করেছে তারা৷ শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. গেন কামেদা বলেন, পশ্চিমের সংস্কৃতিটা এমন যে শিশুরা মায়ের শরীরের উষ্ণতা কম পায়, কারণ এ দেশে বাচ্চারা বিছানায় বেশি সময় থাকে আর এটাই হয়ত শিশুদের রাতে কান্নাকটি করার বড় কারণ৷
ছবি: Yuri Arcurs/Fotolia
নতুন বাবা-মা
নতুন মা-বাবার নানা প্রশ্ন, শিশুটির কান্নার কারণ তাঁরা বুঝতে পারেন না৷ ক্ষুধা, শরীর খারাপ, ক্লান্ত নাকি আদর, কি চায় বেবিটি? আসলে শরীরের উষ্ণতা পেলে শিশুরা সব কিছুই ভুলে যায়, যদি না বড় কোনো শারীরিক কষ্ট থেকে থাকে, বলেন ডা. কামেদা৷ তাঁর পরামর্শ, পিতা-মাতা হলে অনেককিছুই বাদ দিতে হয়, তাই বাইরে গেলে শিশুকে কোলে করে সঙ্গে নেবার চেষ্টা করবেন – যাতে শিশুটি শরীরের উষ্ণতা পায়৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ডাক্তারের পরামর্শ
নতুন বাবা-মায়ের জন্য ডাক্তার কামেদার আরো পরামর্শ, শিশুর কাছাকাছি থাকুন, শিশুকে সময় দিন, কোলে তুলে নিন৷ অল্প কিছুদিন পরেই দেখবেন, শিশু শুধু কাঁদেই না, বরং খুব শীঘ্রই তারা হাসতে শিখবে, হাসাবে মা-বাবাকেও৷
ছবি: Fotolia/st-fotograf
7 ছবি1 | 7
বেশ কয়েকটি দেশে এই আইন রয়েছে
বেলজিয়ামসহ ইউরোপীয় বেশ কয়েকটি দেশে মার্সি কিলিং-এর অনুমোদন রয়েছে৷ সম্প্রতি ১৬ জন খ্যাতনামা শিশু চিকিৎসক বেলজিয়ামের দুটি পত্রিকায় খোলা চিঠির মাধ্যমে শিশুদের ক্ষেত্রেও মার্সি কিলিং-এর পক্ষে মতামত দেন৷
এর বিরুদ্ধে ধর্মীয় সংগঠনগুলি এক যোগে তীব্র প্রতিবাদ জানান৷ এর মধ্যে রয়েছে ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট, অর্থডক্স খ্রিষ্টান, ইহুদি ও মুসলিমদের প্রতিনিধি৷ তাঁদের মতে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মৃত্যুতে সাহায্য করা নৈতিক কারণেই প্রত্যাখ্যান করা উচিত৷
ব্রাসেলস-এর ‘ইউরোপিয়ান ইন্সটিটিউট অফ বায়োএথিক্স'-এর মুখপাত্র কারিন ব্রোশিয়ে এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘একটি বাচ্চা বেলজিয়ামে কোনো বাড়ি কিনতে পারে না, অ্যালকোহল কিনতে পারে না৷ এই ধরনের আইন পাশ হলে তারা স্বেচ্ছা মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে৷ এটা একটা সমস্যা৷''
অন্য দেশে এই আইন এত শিথিল নয়
বেলজিয়ামে ১১ বছর ধরে ডাক্তারদের সাহায্যে মার্সি কিলিং আইনসিদ্ধ৷ ২০১২ সালে ১৪৩২ জন এইভাবে মৃত্যুবরণ করেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির মধ্যে নেদারল্যান্ডস ও লুক্সেমবুর্গের পাশাপাশি বেলজিয়ামের মার্সি কিলিং-এর আইন কানুন বেশ উদার৷ ইইউ-এর অন্যান্য দেশে এক্ষেত্রে আইন কানুন অতটা শিথিল নয়, বা একেবারেই নিষিদ্ধ৷
প্রফেসর ইয়ান ব্যার্নহাইম বলেন, ‘‘অসহ্য শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য মার্সি কিলিং অবিবেচকের মতো প্রয়োগ করা হয় না৷ ডাক্তাররা যদি বুঝতে পারেন রোগীর মৃত্যু এতটা সন্নিকটে নয়, তাহলে তৃতীয় একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেন তাঁরা৷ সাধারণত কোনো মনস্তস্ত্ববিদের৷ তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এক মাস চিন্তা ভাবনা করার সময় পাওয়া যায়৷''
অটিজম কি এবং কেনো?
অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয়৷ এটি মস্তিস্কের একটি বিকাশগত সমস্যা, যা একটা শিশুর তিন বছরের মধ্যেই প্রকাশ পায়৷ অটিজম প্রসঙ্গে সরকারি, বেসরকারি নানা উদ্যোগের কথা জানা যাবে এই ছবিঘরে৷
মানসিক রোগ নয়
বাংলাদেশের অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রধান রওনক হাফিজ এর মতে, অটিজম কোনো মানসিক রোগ নয়৷ এটি মস্তিস্কের একটি বিকাশগত সমস্যা, যা একটা শিশুর তিন বছরের মধ্যেই প্রকাশ পায়৷
ছবি: Getty Images
ছেলে ৪ : মেয়ে ১
মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অটিস্টিক হবার সম্ভাবনা বেশি৷ অনুপাতটা ৪:১ বলে জানিয়েছেন রওনক হাফিজ৷
ছবি: picture alliance/AP Images
লক্ষণ
রওনক হাফিজ বলেন, অটিজম আক্রান্ত শিশুরা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বয়সের তুলনায় পিছিয়ে থাকে৷ তারা একই ধরনের আচার-আচরণ বারবার করে৷ ঘুরে ফিরে একই কথা বার বার বলে৷ উপলব্ধি করার ক্ষমতা এদের মধ্যে ভীষণভাবে কম থাকে৷
ছবি: Rownak Hafiz
কারণ
অটিজমের অন্যতম বড় কারণ বংশগত সমস্যা৷ এর বাইরে পরিবেশ দূষণ, রাসায়নিক মেশানো খাদ্যগ্রহণ – এসবও অটিজমের জন্য দায়ী৷
ছবি: picture alliance/AP Images
ওষুধের ভূমিকা নেই
অটিজম চিকিৎসায় ওষুধের কোনো ভূমিকা নেই৷ এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ৷ সঠিক পদ্ধতিতে এগোলে প্রতিটি অটিস্টিক শিশুই উন্নতি করে৷ এমনকি অনেকে সাধারণ স্কুলে যাওয়ার মতোও হয়ে ওঠে৷
সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে মিরপুরে চালু হয়েছে ‘অটিজম রিসোর্স সেন্টার’৷ আর অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া সহ অন্যান্য প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠন করা হয়েছে ‘সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন’৷ এছাড়া ঢাকা শিশু হাসপাতালে রয়েছে ‘শিশু বিকাশ কেন্দ্র’৷
ছবি: picture alliance/landov
অটিজম স্কুল
অটিজম নিয়ে সরকার কাজ শুরু করেছে বেশি দিন হয়নি৷ তবে বেসরকারি পর্যায়ে অনেক আগে থেকেই অটিজম বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে৷ ইতিমধ্যে ঢাকায় অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা দেয়ার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে৷ ঢাকার বাইরেও রয়েছে কিছু৷
মার্সি কিলিং-এর বিরোধীরা যুক্তি দিয়ে বলেন, অসুস্থদের স্বেচ্ছা মৃত্যুতে সাহায্য করার চেয়ে চিকিৎসা করা উচিত৷
প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে
কারিন ব্রোশিয়ে সতর্ক করে বলেন, মার্সি কিলিং-এর আইনকানুন আরো শিথিল করলে এটিকে প্রয়োগ করার প্রবণতাও বেড়ে যাবে৷'' এর চেয়ে পালিয়াটিভ বা যন্ত্রণানশক চিকিৎসার প্রসার করার দিকে মন দেওয়া উচিত৷ কৃত্রিম উপায়ে খাওয়ানো ও শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা বাতিল করা উচিত৷
ক্যানসারের চিকিৎসক ব্যার্নহাইমও পালিয়াটিভ চিকিৎসার উন্নয়নের পক্ষে৷ তাঁর মতে, যাঁরা অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু বরণ করতে চান, তাঁদের মধ্যে ৩০ শতাংশের আবেদনই নাকচ করে দেওয়া হয়৷ এঁদের মধ্যে অনেকেই আবার সিদ্ধান্ত নেন বেঁচে থাকার৷ মার্সি কিলিংটা তাঁদের জন্য হলো শেষ পন্থা৷ এই সুযোগ থাকাটা তাঁদের নিশ্চিন্ত করে৷
আরো আলাপ আলোচনার প্রয়োজন
এই আইনের বিরোধীরা বেলজিয়ামের সমাজে আরো আলাপ আলোচনার আহ্বান জানান৷ রোগীদের পরিবার পরিজন, হাসপাতালের কর্মী, চিকিৎসকরা এই আইনের ফলে চাপের মুখে পড়েন৷ অনেক ডাক্তার সক্রিয়ভাবে মৃত্যুর সহায়তা করতে চান না৷ এমনকি ব্যথা বেদনা লাঘবের জন্য হলেও নয়৷ পরিসংখ্যানের বাইরে থাকা মার্সি কিলিং-এর সংখ্যাটা অনেক বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা৷ এ ব্যাপারে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন৷ মনে করেন এথিক ইন্সটিটিউটের কারিন ব্রোশিয়ে৷
তিনি এমন রোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, যারা তাদের চিকিৎসা ঠিকমত হচ্ছে না বলে শঙ্কিত৷ মার্সি কিলিং হাসপাতালগুলির জন্য দীর্ঘস্থায়ীভাবে দেখলে অর্থ সাশ্রয়ীও বটে৷ শিশু ও প্রাথমিক অবস্থায় ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য আইনটি শিথিল করলে এর সীমানা আরো বিস্তৃত হবে৷ আরো আলাপ আলোচনার পর বেলজিয়াম সংসদ কয়েক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে৷ জরিপ অনুযায়ী বেলজিয়ামের তিন চতুর্থাংশ মানুষ এই আইন শিথিল করার পক্ষে৷