গঙ্গার পর উত্তর ভারতের দ্বিতীয় পবিত্রতম নদী যমুনা৷ দিল্লিতে ঢোকার আগে এই নদীর পানি অনেকটা পরিষ্কার থাকলেও দিল্লি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পানি অনেক বেশি দূষিত হয়ে যায়৷ এছাড়া দিল্লিতে এসে নদীটি অনেকটা মৃত হয়ে যায়৷
হিমালয় থেকে উৎপত্তি হয়ে যমুনা নদী ১,৩০০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে প্রয়াগরাজে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছেছবি: NIHARIKA KULKARNI/AFP
বিজ্ঞাপন
কিন্তু দিল্লিতে কেন এটি মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে? ওখলা ব্যারেজ এলাকায় বসে পরিবেশকর্মী পঙ্কজ কুমার জানান, ‘‘এখানে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ফেকাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ১৮ লাখ এমপিএন৷ দিল্লি দূষণ নিয়ন্ত্রণ কমিটির মতে সংখ্যাটি ৫০০ এমপিএন হওয়া উচিত৷ আর সর্বোচ্চ সংখ্যাটি হতে পারে আড়াই হাজার এমপিএন৷ সুতরাং আমরা যদি এখানকার ফেকাল কলিফর্মের সংখ্যাটা দেখি তাহলে বুঝতে পারি যে, মানুষ ও পশুর অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে৷''
দিল্লিতে ৩৫টির বেশি পয়ঃশোধনাগার আছে৷ তারপরও পরিবেশ সংস্থা আর্থফাইভআর এর হিসেব বলছে, প্রতিদিন ৮০০ মিলিয়ন লিটার অপরিশোধিত বর্জ্যপানি নদীতে মিশছে৷
জরিপ বলছে, যমুনা নদীর ৮৫ শতাংশের বেশি দূষণ আসে ঘরবাড়ির বর্জ্যপানি ও অপরিশোধিত মল থেকে৷
পঙ্কজ কুমার জানান, ‘‘দিল্লির সাত থেকে আটটি পয়ঃশোধনাগার খুব কার্যকরভাবে বর্জ্যপানি শোধন করে থাকে৷ আপনি যদি সেই পানি দেখেন তাহলে বিশ্বাসই করবেন না যে, এটা একসময় বর্জ্য ছিল৷ যদি সবগুলো পয়ঃশোধনাগার এমনভাবে কাজ করতো তাহলে যমুনা নদীর অবস্থা অনেক ভালো হতো, আর পানিতেও গন্ধ থাকতো না৷''
ভারতে যমুনার পানি কেন কালো?
04:31
This browser does not support the video element.
দিল্লিতে প্রবেশের আগে যমুনা নদীর পানি তুলনামূলক অনেক পরিষ্কার থাকে৷
ওয়াজিরাবাদ বাঁধে যমুনার পানি পরিশোধিত করে দিল্লির বাসিন্দাদের সরবরাহ করা হয়৷ এভাবে তিন কোটি বাসিন্দার পানি চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ পূরণ করা হয়৷
তবে ওয়াজিরাবাদ বাঁধ থেকে নিম্নাঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়ে যমুনা নদী তার প্রথম ও সবচেয়ে বড় নালার সঙ্গে মিশেছে, যার নাম নাজাফগড় নালা৷ ২২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত ঐ এলাকার ২৩টি বড় নালা থেকে নিয়মিত বিরতিতে বর্জ্যপানি ছাড়া হয়৷
টেরি স্কুল অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজের গবেষণা স্কলার ঋতু রাও বলেন, ‘‘ভারতে যেটা হয়েছে সেটা হলো, আলাদা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিবর্তে নগরায়নের কারণে মলমূত্র ও গৃহস্থালীর বর্জ্যের সঙ্গে কারখানার বর্জ্য মিশে নদীতে গিয়ে পড়ছে৷ বর্জ্যপানিপ্রবাহের পথ পরিবর্তন করে এসব ড্রেন ও নদীতে ফেলার কারণে নদীগুলি উন্মুক্ত নর্দমা বা ড্রেনে পরিণত হয়েছে৷''
নগর এলাকার পানি সম্পদ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে ঋতু রাও প্রায় হাঁটা কর্মসূচির আয়োজন করেন৷ তিনি মনে করেন, প্রকৃতিকে রক্ষার প্রথম ধাপ হচ্ছে এর সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা৷ ‘‘এমনকি সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও সচেতনতার অভাব আছে৷ সরকারকে স্কুল, হাউজিং সোসাইটি ও জনপরিসরে সচেতনতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে৷ সেখানে জলাশয় ও জলাভূমির গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে৷ এগুলো আমাদের বেঁচে থাকার জন্য জরুরি,'' বলেন ঋতু রাও৷
পঙ্কজ কুমার ও ঋতু রাও এর মতো মানুষেরা যমুনা রক্ষার জন্য আওয়াজ তুলে যাবেন৷ কিন্তু নদী রক্ষা ও এর পানি পরিষ্কার রাখার জন্য দিল্লিবাসীকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে৷ সাধারণ নাগরিক, রাজনীতিবিদ বা নীতিনির্ধারক, সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে৷
অশোক কুমার/জেডএইচ
আদিগঙ্গা: নদী, নাকি নর্দমা
নগরায়নের চাপে হারিয়ে গেছে বহু প্রাকৃতিক সম্পদ। বিলুপ্ত হয়েছে প্রচুর নদনদী। আদিগঙ্গা তেমনই এক বিলুপ্তপ্রায় নদী।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নালা নয়, নদী
লোহার ঝাঁঝরির নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া যে নোংরা জল ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সেটা একটা নদী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগরজীবনের কাছে হেরে যেতে থাকা এক নদীর অংশ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মেট্রোর তলায় নদী
কলকাতার দক্ষিণ শহরতলীর কবি নজরুল মেট্রো স্টেশানের নীচ দিয়ে বয়ে চলা খালের পাশেই নজরে পড়বে এই লোহার সেতুর অবশিষ্টাংশ। গড়িয়া অঞ্চলের পুরনো মানুষজন এটাকে দোলাপোল নামেই চিনতেন। গঙ্গা নদী বইতো এককালে এই পথে। এই দোলাপোল সেই নদীপারানীর পথ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ওলন্দাজ ইতিহাস
শোনা যায়, সরস্বতী-ভাগীরথীর মাঝখানে সাঁকরাইল থেকে বেতড় পর্যন্ত খালটি ছিল অত্যন্ত অগভীর। ভাগীরথীর প্রবাহপথে পণ্যবাহী জাহাজ নিয়ে যেতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল ওলন্দাজদের। তাই তারা সেই খালটিকেই কেটে আরো চওড়া করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। বাংলার তৎকালীন নবাব আলিবর্দি খাঁর সম্মতি নিয়ে খাল চওড়া করা হলো। নাম হল কাটাগঙ্গা। ওপরের ছবিতে আদিগঙ্গা এবং এখনকার গঙ্গা, দুইটিই দেখা যাচ্ছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ভাবনায় ভুল
কিন্তু এই কৃত্রিম সংযোগে ভাগীরথীর জল আদিগঙ্গায় এসে পৌঁছলো না। প্রাচীন নদীটি তো এতে মরলই, পাশাপাশি আদিগঙ্গার তীর ধরে গড়ে ওঠা জনপদ, জনবসতিরও বিপুল ক্ষতি হলো। ওপরের ছবিতে দইঘাট ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নোংরা নালাটিই হলো আদিগঙ্গা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মনসামঙ্গলে আদিগঙ্গা
বিপ্রদাস পিপলাই-এর মনসাবিজয় কাব্যে পাওয়া যায়, দেবী চণ্ডীর পুজো দিয়ে সপ্তডিঙা ভাসিয়ে আদিগঙ্গা বেয়ে কালীঘাটে এসেছিলেন চাঁদসদাগর। ধনপতির বাণিজ্যযাত্রা আদিগঙ্গা ধরেই। এই নদীর তীরেই চেতলা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পিছন দিকেই এই কালীঘাট ব্রিজ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নদীর দখল
অষ্টাদশ শতাব্দীতে আদিগঙ্গা, পুরনো কলকাতার অন্যতম বসতি গোবিন্দপুর গ্রামের দক্ষিণ সীমা নির্দেশ করত। তাই সেই সময় এই নদীর নামকরণ করা হয় গোবিন্দপুর খাঁড়ি। এডওয়ার্ড সারম্যান খননকাজ চালিয়ে এটির সংস্কার করেন বলে কিছুকালের জন্য এর নাম হয় সারম্যানের নালা। পুটিয়ারি অঞ্চলে নদীর এই অংশের ধারে বসেছে দৈত্যাকার জলের পাইপ। পরিবেশবিদদের মতে এভাবেই দখল হয়ে যাচ্ছে নদীগুলি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
খালের নাম আদিগঙ্গা
১৭৭৩ সালে কর্নেল উইলিয়াম টালি এই নালাটিকে আরও গভীর করে সার্কুলার খালের সঙ্গে যুক্ত করেন। তারপর এর নাম হয় ‘টালির নালা’। ১৭৭৫ সালে কর্নেল টালি আদিগঙ্গার সঙ্গে বিদ্যাধরী নদীর যোগ স্থাপন করেন। আদিগঙ্গার অনেকটা অংশকেই টালিনালা বলা হয়। ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে কুদঘাট অঞ্চলের মেট্রো স্টেশন। যার তলায় স্থবির নোংরা কালো জলই আসলে আদিগঙ্গা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
হারিয়ে গেছে নদী
গড়িয়া বাজারের কাছে লোহার ঝাঁঝরির নীচে নর্দমার পাইপের ভিতরে সমাধিপ্রাপ্ত নদীটিকে আবার খুঁজে পাওয়া গেল প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের কামালগাজী উড়ালপুলের নিচে। স্থানীয় মানুষদের অনেকেরই জানা নেই যে এটি একটি নদী। তাদের কাছে এটি আবর্জনা ফেলার জায়গা মাত্র।
ছবি: Subrata Goswami/DW
চৈতন্যের আদিগঙ্গা
শ্রীচৈতন্যদেবের নীলাচল যাত্রাতেও রয়ে গেছে এই নদীর কথা। আদিগঙ্গার তীরে একজায়গায় তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে বসেছিলেন কিছুদিন। সেই জায়গাই আজ পরিচিত বৈষ্ণবঘাটা নামে। সেই বৈষ্ণবঘাটায় নদীর বর্তমান চেহারা দেখলে শিউরে উঠতে হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নদীর উপর মেট্রোর থাম
গড়িয়া পর্যন্ত দক্ষিণে মেট্রোরেলের যে আট দশমিক পাঁচ কিলোমিটার পথ পরে সম্প্রসারণ করা হয়, সেটি পুরোপুরিই উড়াল পথে। এই উড়ালপথটি অনেকাংশেই আদিগঙ্গার উপরে অবস্থিত। সমাজকর্মীদের মতে, আদিগঙ্গার বুকের উপর মেট্রোরেলের থাম এই নদী শুকিয়ে যাওয়ার এক অন্যতম কারণ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নদীর ধারে ভাগাড়
বারুইপুর যাওয়ার পথে যদিও নদীটি কিছু সময়ের জন্য নর্দমা অবস্থা থেকে মুক্তি পায়, তবে শাসন রোড আর কৃষ্ণমোহন হল্টের মধ্যবর্তী অঞ্চলের এই ভাগাড় নদীর জলকে আবার নর্দমায় পরিণত করে। স্থানীয় মানুষ এই নদীকে খাল হিসেবেই জানেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
জয়া মিত্রের অভিমত
নদী বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকর্মী জয়া মিত্রের মতে, ''এইসব নদীর সঙ্গে মিলে এদেশের সমাজ হাজার বছর ধরে বাস করছে। অথচ দেশের প্রত্যেকটি সরকার নদীদের গুরুত্ব আর স্বভাবের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা করে নিজেদের খেয়াল মতো চলছে। সে জন্যই আজ এই নদীগুলির এমন অবস্থা।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তি
বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রশাসন নিজের দায়টুকু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু মানুষের সচেতনতা সর্বাগ্রে কাম্য।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মুছে গেছে ইতিহাস
প্রবীণ কিছু মানুষের অনুভূতি-- পচা দুর্গন্ধময়, মজে যাওয়া নর্দমার মতো আদিগঙ্গার তীরে গিয়ে দাঁড়ালে বড় কষ্ট লাগে। এককালে এই নদীতে জোয়ারভাটা খেলতো। গঙ্গাপাড়ের কত ইতিহাস, কত ধর্মস্থান, মানুষেরই প্রতিনিয়ত হস্তক্ষেপে মুছে গেছে আজ।