যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ সংকটের দায় কার?
১ নভেম্বর ২০২২কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সাহায্যপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন সমস্যায় পড়ল কেন?
অর্থের অভাব
উৎকর্ষ ও ঐতিহ্যের নিরিখে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছে। এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বশাসিত, আর্থিক অনুদান দেয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। রাজ্য বেতন-সহ অন্যান্য খরচ জোগায়, প্রকল্প সংক্রান্ত ব্যয়ের জন্য অর্থবরাদ্দ করে কেন্দ্রীয় সরকার। দুই সরকারের অর্থে পোষিত প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান আসছে না। একইসঙ্গে রাজ্য সরকারের বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ক্রমশ কমছে। আর্থিক অনুদানের ক্ষেত্রে এই অধোগতি কোভিডের সময় থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অতিমারির পর্ব কেটে গেলেও বরাদ্দ আগের জায়গায় পৌঁছায়নি।
রাজ্য ও কেন্দ্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র অনুযায়ী, বেতন ছাড়া বছরে ৪৫ কোটি টাকা লাগে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায়। এ ক্ষেত্রে ১২ কোটি টাকা কর্তৃপক্ষ পেয়েছেন। আরো ছয় কোটি টাকার বরাদ্দ এলে এই সংখ্যা পৌঁছবে ১৮ কোটিতে। তাতেও প্রয়োজনীয় অর্থের ঘাটতি থাকবে। রাজ্যের বঞ্চনার অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তার বক্তব্য, ''রাজ্য সরকার ২৮ কোটি টাকা দিয়েছে যাদবপুরকে, নইলে পঠনপাঠন, গবেষণার কাজ চালানো যেত না। কেন্দ্রের কাছ থেকে যে ৩০ কোটি টাকা প্রাপ্য, তা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া হচ্ছে না।'' কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডা. সুভাষ সরকার পাল্টা
রাজ্যকে দুষে বলেছেন, ''যাদবপুরের বার্ষিক খরচ ৪৫-৫০ কোটি। কিন্তু রাজ্য মাত্র ২০ কোটি টাকা দেয়। ছাত্র থেকে শিক্ষক সকলের এর প্রতিবাদ করা উচিত।''
সমস্যায় পড়ুয়ারা
এই চাপানউতোরের মধ্যে সমস্যা কিন্তু বাড়ছে যাদবপুরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএডপড়ুয়া তর্পণ সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ করতে চাইছেন না, এমন নয়। কিন্তু টাকা নেই। রাষ্ট্রীয় উচ্চশিক্ষা অভিযানের টাকাও কোভিডের সময় থেকে বন্ধ। ফলে গবেষকরা সাম্মানিক ছাড়াই কাজ করছেন।'' ছাত্রছাত্রীরা জানাচ্ছেন, নতুন বই থেকে ল্যাবরেটরির সরঞ্জাম, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থ সংকটের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
সমাবর্তনে অনিশ্চয়তা
এই পরিস্থিতিতে চলতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ঘিরে সংশয়ের মেঘ জমেছে। সমাবর্তনে কৃতী পড়ুয়াদের পুরস্কৃত করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সেই সমাবর্তন অর্থের অভাবে নাও হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের একাংশ। তবে এর থেকেও বড় চিন্তা, ভবিষ্যতে বরাদ্দ অর্থ পাওয়া না গেলে সংকট আরো গভীর হবে। তাতে দৈনন্দিন পঠনপাঠন, পরীক্ষা গ্রহণে প্রভাব পড়বে না তো?
অগ্রণী যাদবপুর
অথচ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক সূচকে এক অগ্রণী প্রতিষ্ঠান। গত সপ্তাহে এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ফের সেই ছবি উঠে এসেছে। কিউ এস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং-এ বিশ্বের ৭০০টি বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই তালিকায় আট নম্বরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। অক্টোবরে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তাতে ভারতের প্রায় চার হাজার গবেষকের নাম ছিল। এর মধ্যে যাদবপুরের বিজ্ঞানীর সংখ্যা ৪২।
বিস্মিত প্রাক্তনীরা
সেই প্রতিষ্ঠানের এমন দুরবস্থায় অবাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী থেকে শিক্ষকরা। অধ্যাপক মিরাতুন নাহার যাদবপুরে পড়েছেন পাঁচ দশক আগে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১। পরে এখানেই পিএইচডি করেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''আমি যখন যাদবপুরেপড়েছি, সেই সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এটা শিক্ষাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে।''
যাদবপুরের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক তরুণ নস্কর এমনই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''বিশ্ববিদ্যালয়কে বেসরকারিকরণের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে কর্পোরেট পুঁজির কাছ থেকে সাহায্য চাইতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন ভাড়া দিতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অনেক বেশি ফি নিতে হবে।''
সহযোগিতার আশ্বাস
প্রতিকূলতা কাটাতে কী করণীয়, তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারক কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। সংকট কাটাতে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে সেই ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাক্তনীদের একাংশ এগিয়ে এসেছেন। তারা কথা বলেছেন উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের সঙ্গে। এই প্রাক্তনীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চান। কিন্তু তাতে কি এত বড় প্রতিষ্ঠানের কাজ চালানো যায়?