রায়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ব্রেন্ডা হেল বলেছেন, আদালত এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য... তাকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরাশর্ম দেওয়ার সিদ্ধান্তও বেআইনি৷
গত ১০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট পরবর্তী পাঁচ সপ্তাহের জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হয়৷ এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী জনসন বলেছিলেন, আগামী ১৪ অক্টোবর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ নতুন সরকারের কার্মপরিকল্পনা নিয়ে পার্লামেন্টে ভাষণ দেবেন৷ সেই কাজ সুষ্ঠুভাবে করতেই পার্লামেন্টের সর্বশেষ অধিবেশন মুলতবি করা হয়েছে৷
তবে ওই দিনই প্রতিনিধি পরিষদে জনসনের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পার্লামেন্ট সদস্যরা৷ পার্লামেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত বেআইনির রায় যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালতের ১১ বিচারপতি সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করেছেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, আগামী ৩১ অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকরের সময়সীমা সামনে রেখে পার্লামেন্টের দায়িত্ব পালন বন্ধ করাটা ভুল ছিল৷ দেশের গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়গুলোর উপর এর প্রভাব ভয়াবহ বলেও রায়ে অভিমত দেয়া হয়েছে৷
ব্রেন্ডা হেল বলেন, রানিকে পার্লামেন্ট স্থগিতের অনুরোধের সিদ্ধান্ত আইনসম্মত ছিল না৷ কারণ এর প্রভাব ছিল হতাশাজনক৷ এর মধ্য দিয়ে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই পার্লামেন্টের সাংবিধানিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রদ করা হয়েছে৷
এখন কী হবে সে সিদ্ধান্তের ভার হাউজ অব কমন্স এবং হাউজ অব লর্ডসের স্পিকারদের উপর ছেড়ে দিয়েছে আদালত৷ আর আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে হাউজ অব কমন্সের স্পিকার জন বারকাউ বলেছেন, আর দেরি না করে পার্লামেন্ট বসবে, জরুরি ভিত্তিতে দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন৷
এই রায়ের পর বরিস জনসনকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন অনেকেই৷ লেবার পার্টির নেতা এবং বিরোধী দলের প্রধান জেরেমি কর্বিন জনসনকে এখনই তার পদ ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ব্রাইটনে লেবার পার্টির সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি বরিস জনসনকে ঐতিহাসিক ভাষায় তাঁর অবস্থান বিবেচনার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি৷’’
অবৈধভাবে সংসদ স্থগিত করে জনসন গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনকে অবজ্ঞা করেছেন বলেও অভিযোগ করেন কর্বিন৷
লিবারেল ডেমোক্র্যাটস নেতা জো সোয়েনসন বলেছেন, ‘‘আমরা যা জানতাম, বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উপযুক্ত নয়, এই রায়টি তাই নিশ্চিত করেছে৷ তিনি রানি এবং দেশকে ভুল পথে পরিচালনা করেছেন এবং জনগণের প্রতিনিধিদের অবৈধভাবে চুপ করিয়ে রেখেছেন৷’’
এসআই/এসিবি (এএফপি, রয়টার্স)